× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

বাজার পরিস্থিতি

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাজনৈতিক সদিচ্ছাই বড় শক্তি

এএমএম শওকত আলী

প্রকাশ : ২১ জানুয়ারি ২০২৪ ১২:৩৮ পিএম

এএমএম শওকত আলী

এএমএম শওকত আলী

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে নতুন ভাবে যাত্রা করেছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিমন্ত্রী দায়িত্বভার কাঁধে নিয়েই বলেছেন, ‘জবাবদিহি ও স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠা করতে পারলে সিন্ডিকেট নিয়ে অভিযোগ আর থাকবে না।’ আমরা জানি, এ সরকারের সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ। এর মধ্যে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সামাল দেওয়া, মূল্যস্ফীতি বা দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণই অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ। কিন্তু তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, এ ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার বিকল্প নেই। শুধু বক্তব্য দিলেই হবে না, বাজারে অস্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে কার্যকর উদ্যোগ জরুরি। কার্যকর উদ্যোগ নেওয়ার জন্য চাই টেকসই পরিকল্পনা এবং এর ধারাবাহিক বাস্তবায়ন। মূল্যস্ফীতি শুধু নতুন সরকারের জন্যই চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে তা কিন্তু নয়। বিদায়ি সরকারের সময়ও মূল্যস্ফীতি বড় সমস্যা ছিল। মূল্যস্ফীতির চাপে পিষ্ট জনজীবনে শুধু প্রতিশ্রুতি পরিবর্তন আনবে না। দীর্ঘদিনেও কোনো সরকার বাজার তদারকির টেকসই সমাধান গড়ে তুলতে পারেনি। ফলে বারবার বাজারে সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যের অভিযোগ ওঠে। কোনো কোনো মন্ত্রী সিন্ডিকেটের কারসাজির কথা স্বীকার করলেও স্থায়ী কোনো প্রতিবিধান নিশ্চিত করতে পারেননি। প্রশ্ন হচ্ছে, কেন?

আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। তবে বছরের শুরুতেই ভোজ্য তেল, পেঁয়াজ, ডাল, গমসহ প্রায় ১৩টি নিত্যপণ্যের দাম আরও এক দফা বেড়েছে। অর্থনীতিবিদ ও বাজার-বিশ্লেষকরা বলছেন, উৎপাদন ও পরিবহন খরচ, বিদ্যুৎ ও ডিজেলের দাম এবং ডলার সংকটের কারণে আমদানি ব্যাহত হওয়াÑ এ তিন কারণে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ সহজ হবে না। আমাদের বাজারব্যবস্থার যে প্রকৃতি তা বিবেচনা করলে, বাজারে নিয়ন্ত্রণ সুফল এনে দিতে পারে না। বাজারে যেন অনিয়ম না হয় কিংবা অসাধু ব্যবসায়ীরা ভোক্তাদের ভোগান্তিতে ফেলতে না পারেন এজন্য সরকারকে কড়া নজরদারি রাখতে হবে। নিত্যপণ্যের মূল্য সহনীয় পর্যায়ে না থাকলেই বাজারে তদারকি বাড়াতে হয়। উৎপাদন এবং আমদানি পণ্যের সরবরাহের ব্যবস্থাসহ নানা মাপকাঠির বিচারে বাজারদর ওঠানামা করাটাই স্বাভাবিক। পণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে আমাদের বাজারব্যবস্থায় সমস্যার সমাধান প্রত্যাশা করা ঠিক হবে না। পণ্যের দাম ভোক্তার কাছে সহনীয় পর্যায়ে রয়েছে কি না নিশ্চিত করার জন্যই নজরদারি জরুরি। ভোগ্যপণ্যের দাম ও নজরদারিব্যবস্থার মধ্যে সমন্বয় করার কাজ কিছুটা জটিল। তবে এজন্য ধারাবাহিক ও টেকসই পরিকল্পনার কার্যকর বাস্তবায়ন দরকার। শুধু বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ই নয়, এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আছে আরও কয়েকটি মন্ত্রণালয়। সবাইকে যূথবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে।

গত সপ্তাহে প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এর একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কোনো যৌক্তিক কারণ ছাড়াই সব ধরনের চালের দাম কেজিতে প্রায় ৫ থেকে ১০ টাকা বেড়ে গেছে। অথচ ইতোমধ্যে নতুন ধান কাটা এবং মাড়াই প্রায় শেষের দিকে এবং বাম্পার ফলনের খবরও পাওয়া গেছে। গুদামগুলোয়ও যথেষ্ট চাল মজুদ আছে। আর প্রায় দেড় মাস পরই পবিত্র মাহে রমজান। সংবাদমাধ্যমে ইতোমধ্যে উঠে এসেছে, রমজানে যেসব নিত্যপণ্যের চাহিদা বাড়ে সেগুলোর দাম ইতোমধ্যে এক দফা বেড়ে গেছে। এও অভিযোগ আছে, রমজানে যেসব পণ্যের চাহিদা বাড়ে সেগুলো নিয়ে কারসাজির ছক কষছেন অসাধু ব্যবসায়ীরা। রমজান এলে মানুষের খাদ্যাভ্যাসে বদল আসে। কিন্তু নিত্যপণ্যের দাম বাড়লে মানুষকে সমন্বয় করতে হয়। ১৩ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় নবনিযুক্ত মন্ত্রীদের সঙ্গে প্রথম আনুষ্ঠানিক বৈঠকে নির্দেশ দিয়েছেন পবিত্র রমজানে পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যবস্থা নিতে। সরকারপ্রধানের এ নির্দেশনা শেষ পর্যন্ত কতটা কার্যকর হবে অভিজ্ঞতার আলোকে এ নিয়ে অনেকেই সংশয় প্রকাশ করেছেন। আমরা দেখছি, বাজারে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার জন্য ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর কাজ করছে। তবে জরিমানা কিংবা সাময়িক সময়ের জন্য কার্যক্রম বন্ধের সাজা দিয়ে সিন্ডিকেট বা অসাধু ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য বন্ধ করা যাবে না। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সঙ্গে কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)-এর মতো সংগঠনের নিবিড় যোগাযোগ গড়ে তোলা জরুরি। ক্যাবের মতো আরেকটি সংগঠনও গড়ে তোলা সময়ের দাবি। সবার আগে জরুরি সুশাসন। সুশাসনের আলো দৃশ্যমান করতে সরকারের দৃঢ় ও নির্মোহ অবস্থান জরুরি। কথায় কাজ হবে না, প্রয়োজন কার্যকর পদক্ষেপ।

একই সঙ্গে এও মনে করি, বাজার মনিটরিংয়ের জন্য সরকারের যে তথ্য-উপাত্ত জরুরি তা সংগ্রহের দায়িত্ব কোনো বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া যেতে পারে। কোনো বিদেশি সংস্থা ও দেশের বেসরকারি কোনো সংস্থার সমন্বয়ে বাজার সমীক্ষা করার ব্যাপারে কর্মপরিকল্পনার বাস্তবায়ন সুফল দিতে পারে। এ সমীক্ষার ভিত্তিতে বাজারের চরিত্র, পণ্য সরবরাহের ধরন, বাজারের চাহিদা, বাজারে রাজনৈতিক প্রভাব ইত্যাদি বিষয় তুলে আনা জরুরি। এসব তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে টেকসই পরিকল্পনা সাজাতে হবে। সদ্য বিগত সরকারের বাণিজ্যমন্ত্রী, কৃষিমন্ত্রী, পরিকল্পনামন্ত্রীসহ দায়িত্বশীল অনেকেই সিন্ডিকেটের কারসাজির কথা স্বীকার করেছেন। কিন্তু তারা কেউই কারসাজি বন্ধ তো করতে পারেনই নি, কখনও কখনও সিন্ডিকেট নিয়ে এমন কথাও বলেছেন যা শুনে মনে হয়েছে সিন্ডিকেটের হোতাদের কাছে তাদের যেন অসহায় আত্মসমর্পণ। এ ক্ষেত্রে বাজার সম্পর্কে পর্যাপ্ত তথ্য না থাকা একটি বড় কারণ অবশ্যই। আবার সিন্ডিকেটের সঙ্গে রাজনৈতিক প্রভাবের বিষয়টিও এড়ানোর নয়। দেশের বাজারব্যবস্থায় দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে প্রতিবন্ধকতার ক্ষেত্রে বিশ্লেষকরা যে তিনটি প্রতিবন্ধকতার কথা বারবার তুলে ধরছেন এর থেকেও বড় প্রতিবন্ধকতা বাজারে রাজনৈতিক প্রভাবে সিন্ডিকেট গড়ে ওঠার বিষয়টি। সংবাদমাধ্যমে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির চিত্র উঠে আসছে। সাধারণ মানুষের অস্বস্তির কথাও জানা যাচ্ছে সমান্তরালে। একই সঙ্গে সংবাদমাধ্যমেই প্রতিনিয়ত চাঁদাবাজির খবরও উঠে আসছে। অনেক ক্ষেত্রে পণ্যের দামবৃদ্ধির সঙ্গে চাঁদাবাজির সরাসরি যোগাযোগ থাকে। অর্থাৎ রাজনৈতিক প্রভাবের বিষয়টি মাস্কিং অবস্থায় থাকে বিধায় সহজেই আমাদের চোখে পড়ে না। বাজারে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে তাই রাজনৈতিক সদিচ্ছা প্রধান হাতিয়ার।

নতুন সরকার এমন একটি পরিস্থিতিতে দায়িত্ব নিয়েছে যখন দেশের অর্থনীতি অন্য যেকোনো সময়ের তুলনায় দুর্বল। পাশাপাশি আর্থিক খাতের বিশৃঙ্খলা নিয়েও অনেক প্রশ্ন আছে। এ পরিস্থিতিতে বাজার নিয়ন্ত্রণে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে সমন্বয়ের পথে হাঁটতে হবে। ইতোমধ্যে খাদ্য, কৃষিসহ আরও কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে সমন্বয়ের ভিত্তিতে ভোগ্যপণ্যের দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা কশাঘাত থেকে মানুষকে মুক্তি দিতে নতুন কর্মকৌশল জরুরি। বাণিজ্য, খাদ্য, কৃষি মন্ত্রণালয়ের আন্তঃযোগাযোগ ও পরামর্শ বাড়াতে পারলে একটি টেকসই পরিকল্পনা গড়ে তোলা কঠিন কিছু নয়। আগেই বলেছি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমন্বয় কিংবা সহযোগিতার বিষয়ে। উৎপাদনব্যবস্থা থেকে শুরু করে সরবরাহ-বিপণন ব্যবস্থা সব দিকে মনোযোগ বাড়াতে হবে। উৎপাদিত পণ্যের সরবরাহ এবং বাজারে পণ্যের চাহিদার ভিত্তিতে ভোক্তার কাছে পৌঁছে দেওয়া পর্যন্ত সার্বিক নজরদারিতে যেন কোনো ত্রুটি না থাকে এজন্য বাস্তবমুখী পরিকল্পনা জরুরি।

কৃষি আমাদের অর্থনীতির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ খাত। সরকার নির্বাচনের আগে জ্বালানি ও বিদ্যুতে ভর্তুকি থেকে সরে আসার কথা বলেছে। তবে ভর্তুকি থেকে সরে আসার নামে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর চিন্তাও সরকারের রয়েছে এ কথাও বলা হয়েছে। অথচ আমাদের কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থার সঙ্গে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ অপরিহার্য। কৃষিতে ভর্তুকি পুরোপুরি উঠিয়ে দেওয়া ঠিক হবে না বলেই মনে করি। বিশেষত কৃষি খাতে জ্বালানি ও বিদ্যুতের নিরবচ্ছিন্ন সংযোগ নিশ্চিত করার জন্য আলাদা ব্যবস্থা গড়ে তোলা জরুরি। কাজটি কঠিন নয়। কৃষি মন্ত্রণালয় এবং বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয়ের মাধ্যমেই তা করা যেতে পারে। কৃষি খাতের উৎপাদনের নিরবচ্ছিন্নতা নিশ্চিত করার জন্য আলাদা টাস্কফোর্স গঠন করা যেতে পারে। ২০২২ সালে সরকার ১ কোটির বেশি কৃষককে স্মার্ট কৃষি কার্ড বিতরণের সিদ্ধান্ত নেয়। প্রকল্পাধীন ওই উদ্যোগের ধারাবাহিকতা সম্পর্কে আমাদের কাছে এখন পর্যন্ত সুস্পষ্ট কোনো তথ্য নেই। তবে উদ্যোগটি ছিল নিঃসন্দেহে ইতিবাচক। কৃষি খাতে কৃষকের দুর্ভোগ যত কম হবে এবং এ খাতের ডিজিটালাইজেশন যত বেশি হবে ততই লাভবান হব আমরা এবং জাতীয় অর্থনীতি। মূল্যস্ফীতি শুধু ভোক্তার জন্যই সংকট নয়। এ সংকট আমাদের অর্থনীতিরও। উৎপাদন পর্যায় থেকে ভোক্তা পর্যায়ে পণ্যের স্বাভাবিক সরবরাহের দিকে বিশেষ নজর দেওয়া দরকার। চাহিদার নিরিখে আমদানির ক্ষেত্রে সংকটকালে বাড়তি সহযোগিতা দানও সমগুরুত্বপূর্ণ। অতিমুনাফালোভী অসাধু চক্রের মূলোৎপাটন করতে হবে।

  • সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও বিশ্লেষক 
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা