মুহাম্মদ তাজুল ইসলাম
প্রকাশ : ২০ জানুয়ারি ২০২৪ ১৭:০৯ পিএম
আপডেট : ২০ জানুয়ারি ২০২৪ ১৯:১৪ পিএম
কদিন আগে গ্রামে গিয়েছিলাম।
সচরাচর গ্রামে বাড়ির আঙিনায় ছেলেমেয়েদের খেলতে দেখা যায়। কিন্তু এবার সে দৃশ্য
দেখতে পাইনি। শৈশবে গ্রামে ঘুরতে গেলে স্থানীয় ছেলেমেয়েদের ভীড় ছিল চোখে পড়ার মতো।
তবে সম্প্রতি ছেলেমেয়েদের খেলাধূলার প্রতি আগ্রহ অনেক কমেছে, এমনটিই প্রতীয়মান হচ্ছে।
ভাইয়ের কাছে জানতে চাইলাম তার ক্লাস নাইন পড়ুয়া ছেলের খোঁজ নেই। তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে
বললেন, ‘ছেলের পীড়াপীড়িতে নিরুপায় হয়ে
তাকে মোবাইল ফোন কিনে দিয়েছি। সারাক্ষণ সেটা নিয়ে ব্যস্ত থাকে। গেম না কি যেন খেলে।পড়াশোনায়
কোন মন নেই। কিছু বললে মান অভিমান করে’।
মোবাইলের বিকল্প কিছু দেয়া যায় কি-না এ নিয়েও আমাদের মধ্যে কিছুক্ষণ আলোচনা হয়। শৈশবে
আমরা দীর্ঘক্ষণ পুকুরে সাঁতার কেটেছে, মাঠ-ঘাট দাঁপিয়ে বেড়িয়েছি। বন্ধুদের সাধে হাডুডু,
দাড়িয়াবাঁধা এবং গোল্লাছুট খেলা ছিল প্রতিদিনকার ব্যাপার। খুব বেশিদিন আগের কথা নয়,
গ্রামে গ্রামে পাল্লা দিয়ে ফুটবল খেলা বা ক্রিকেট খেলা প্রতিযোগিতা হতো। এখন আর তেমনটি
দেখা যায় না। মোবাইল ফোনের গেমে আসক্তিতে আগামী প্রজন্ম জীবন উপভোগের বৈচিত্র্যতা থেকে
অনেক দূরে। প্রযুক্তি ব্যবহারে নিয়ন্ত্রণ আনার ব্যাপারে আমাদের মনোযোগের অভাব এক্ষেত্রে
অনেকটা দায়ি। ইন্টারনেটের বদৌলতে এখন যেকোনো তথ্য খুঁজে পাওয়া যায়। খুঁজে পাওয়া যায়
বিনোদনের নানা অনুসঙ্গ। তরুণ প্রজন্মের চোখে বিনোদনের যে রঙিন চশমা তারা চোখে সেঁটে
রেখেছে, তা তাদের বিপথগামী করে তুলছে।
অষ্টাদশ শতকে ফরাসি সভ্যতার মধ্যে মূল্যবোধ ও ন্যায্যতায় আপসহীনতা—এই দুটো বৈশিষ্ঠ্য লক্ষ্যনীয়
ছিল। স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর সামগ্রিক
সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে ন্যায্যতা, সাম্য ও ন্যায়বিচার এর জন্য লড়াই সংগ্রাম করেছেন।
সমসাময়িক ভারতীয় উপমহাদেশের অবস্থা ফরাসিদের সাথে তুলনীয় না হলেও সে সময় ভারতবর্ষে
যে মূল্যবোধের চর্চা ছিল না, তা বলা যাবে না। কিন্তু এখন সে অবস্থা আর অবশিষ্ট নেই।
স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়ে এ ক্ষেত্রে আমাদের দেশের অবস্থাটা আরো বেহালদশায় পৌঁছেছে।
যা স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র ও সভ্য সমাজের চরিত্র এবং বৈশিষ্ট্যকেই দুর্বল ও প্রশ্নবিদ্ধ
করছে বা ভবিষ্যতে করবে।মূল্যবোধের অনুপস্থিতিই অবক্ষয়ের সূচনা করে। অবক্ষয় বলতে আমরা
সাধারণত সামাজিক ও ব্যক্তি কেন্দ্রিক কিছু স্খলন বা চ্যুতি-বিচ্যুতিকেই বুঝি। যেমন-
মাদক; এল এসডি, ইভটিজিং, জুয়া, ক্যাসিনো, ইয়াবা, ফেনসিডিল, গাঁজা, হেরোইন, প্যাথেড্রিন,
পর্নোগ্রাফি আসক্তি অনিয়ন্ত্রিত-অন্যায্য এবং অপরিণত যৌনাচারসহ কিছু সামাজিক অপরাধকে
অবক্ষয় বলে সাব্যস্থ করা হয়। যদিও প্রকৃতপক্ষে এর ব্যাপ্তি আরো অনেক বেশি বিস্তৃত।
মূলত ক্ষয়প্রাপ্তি, সামাজিক মূল্যবোধ তথা সততা, কর্তব্য নিষ্ঠা, ধৈর্য, উদারতা, শিষ্টাচার,
সৌজন্যবোধ, নিয়মানুবর্তিতা, অধ্যবসায়, নান্দনিক সৃজনশীলতা, দেশপ্রেম, কল্যাণবোধ, পারস্পরিক
মমতাবোধ ইত্যকার নৈতিক গুণাবলি লোপ পাওয়া বা নষ্ট হয়ে যাওয়াকে বলে অবক্ষয়। কোনো কোনো
রাজনীতিবিদদের মাঝেও চরম মূল্যবোধের অবক্ষয় দেখা দিয়েছে, এ অভিযোগ নানা মহলের। সবার
মধ্যে রাতারাতি উচ্চবিত্ত হওয়ার স্বপ্ন।
মূল্যবোধ ও অবক্ষয় পরস্পর
বিরোধী এবং একে অপরের সাংঘর্ষিক। মূল্যবোধ যেখানে দুর্বল, অবক্ষয় সেখানেই প্রবল। আলো-আঁধারের
মধ্যে যেমন সহাবস্থান নেই, ঠিক তেমনিভাবে অবক্ষয় ও মূল্যবোধ একসাথে চলতে পারে না। মূল্যবোধ
স্বয়ংক্রিয়ভাবে জাগ্রত হয় না বরং রাষ্ট্রীয়, সামাজিক ও পারিবারিক পরিসরে এ জন্য অনুকূল
পরিবেশ সৃষ্টি করা আবশ্যক হয়ে পড়ে। এ ক্ষেত্রে নৈতিক শিক্ষার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
যেহেতু আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় রাষ্ট্রই নাগরিকের সবকিছুই দেখভাল করে, তাই মূল্যবোধের
লালন ও চর্চার পরিবেশ সৃষ্টির দায়িত্বও রাষ্ট্রের। তাই নাগরিকদের জন্য রাস্ট্রের প্রথম
কর্তব্য হবে নৈতিকশিক্ষা ও মূলবোধের চর্চাকে উৎসাহিত করা এবং সার্বিক পৃষ্ঠপোষকতা দেয়া।
এ ক্ষেত্রে সব নাগরিকের জন্য শিক্ষাকে অবারিত করাকে অধিকতর গুরুত্ব দেয়া জরুরি। তবে
সব শিক্ষিতই যে নৈতিক মূল্যবোধসম্পন্ন হবে বা অবক্ষয় মুক্ত থাকবে এমনটা আশা করাও ঠিক
নয়। যেসব মানুষ সুশিক্ষিত হতে পারেনি অর্থাৎ শিক্ষার মাধ্যমে সুকুমার বৃত্তির পরিপূর্ণ
বিকাশ ঘটাতে পারেনি তাদের মাধ্যমে মূল্যবোধ ও ন্যায্যতার চর্চা কখনো সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে
সুশিক্ষাই কাঙ্খিত ও প্রত্যাশিত। কেউ যখন সুশিক্ষিত হয়ে ওঠে তখন তার মধ্যে আপনা-আপনিই
নৈতিকতা ও মূল্যবোধের সৃষ্টি হয়। তিনি অবক্ষয় মুক্ত থাকার চেষ্টা করেন। আর তা ফুলে-ফলে
সুশোভিত করার জন্য প্রয়োজন হয় পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের অনুকূল পরিবেশ বা পৃষ্ঠপোষকতা।
সুশিক্ষিত তিনিই যিনি তার শিক্ষাকে সৎ আর ন্যায়ের পথে নিয়োজিত করেন। যৌক্তিক বিষয়াদিকে
যৌক্তিক বোঝার পর নিজ স্বার্থের দিকে নজর না দিয়ে, অযৌক্তিকতাকে দূরে ঠেলে দিয়ে সুন্দরকে
প্রতিষ্ঠিত করার ব্রত গ্রহণ করেন।জজ মিয়া নাটক বিষয়ে আমরা সবাই কমবেশি জানি।
সাম্প্রতিককালে পরকীয়া, নারী ও শিশু নির্যাতন, ধর্ষণ, হত্যা, ক্যাসিনো, সন্ত্রাস, নৈরাজ্য, বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গরিবের ত্রাণের চাল চুরি ও আত্মসাৎ, গুপ্তহত্যা, গুম ও অপহরণ বেড়েছে আশঙ্কাজনকভাবে। মূল্যবোধের অনুপস্থিতি ও অবক্ষয়ের ব্যাপক বিস্তৃতির কারণেই এ ধরনের অপরাধ এখন ক্রমবর্ধমান ও লাগামহীন। এ জন্য দেশে গণমুখী ও সুস্থধারার রাজনীতির বিচ্যুতিকেই অনেকেই দায়ী করেন। রাজনীতির পরিসর খুবই বৃহৎ। রাজনীতি দেশ ও জনগণের আমূল কল্যাণের জন্য আবর্তিত হয়। এতে মূল্যবোধ আর ন্যায্যতার ভিত্তি মজবুত না থাকলে কল্যাণের পরিবর্তে অকল্যাণই হয় বেশি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ন্যায়বিচারের কথা বলতে গিয়ে উল্লেখ করেন, ‘যদি কেউ ন্যায্য কথা বলে, আমরা সংখ্যায় বেশি হলেও, সে একজনও যদি হয়, তার ন্যায্য কথা আমরা মেনে নেব।’ রাজনীতিকদের যদি মূল্যবোধের স্তর নিম্নমানের হয় তবে তা আর রাজনীতি থাকে না বরং অপরাজনীতি হিসেবে বিবেচিত হয়। এর কুপ্রভাবে হাজারো মূল্যবোধ নষ্ট হয়। ব্যক্তির মূল্যবোধ নষ্ট হলে ক্ষতি শুধু একজনের কিন্তু শাসক শ্রেণীর মূল্যবোধ নিয়ে প্রশ্ন উঠলে পুরো রাষ্ট্রযন্ত্রেই এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। তাই প্রবাদ আছে, ‘রাজার দোষে রাজ্য নষ্ট হয়, প্রজা কষ্ট পায়’। আমাদের প্রেক্ষাপটও বোধহয় তা থেকে আলাদা নয়। বঙ্গবন্ধু তাঁর রাজনৈতিক জীবনে যে ন্যায্যতা, সাম্যবাদের বা ন্যায়বিচারের কথা বলেছিলেন বা ধারণ করতেন এই সময় এসে রাজনীতিবিদদের মধ্যে আমরা সেই উচ্চমানের মূল্যবোধের জায়গাটি ধরে রাখতে পারিনি বা কিছুটা হলেও অনুপস্থিত। শুধু রাজনৈতিক মূল্যবোধের বিষয় নয়, অবক্ষয়ের মূলে রয়েছে ধর্মবিমুখতা, ধর্মের অপব্যবহার, ধর্মীয় সঙ্কীর্ণতা, অসহিষ্ণুতা, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের অভাব এবং সর্বগ্রাসী অশ্লীলতার মতো আরো কিছু বিষয়। ধর্মের যথাযথ চর্চা ও অনুশীলন কখনোই ধর্মান্ধতা শেখায় না বরং ধর্মীয় আদর্শের মাধ্যমেই ধর্মান্ধতার অভিশাপ মুক্ত হওয়া সম্ভব।
সামাজিক অনাচার, ব্যভিচার, পরকীয়া, নারী ও শিশু নির্যাতন, মিথ্যা
মামলা দিয়ে ফাঁসানো, ত্রাণচুরি, ধর্ষণ, হত্যা, ক্যাসিনো, সন্ত্রাস, নৈরাজ্য, বিচার
বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুপ্তহত্যা, গুম ও অপহরণ বেড়েছে একথা তো সত্য। এটা মূল্যবোধের
অবক্ষয়ের ফল সেটিও ধ্রুবসত্য। আর আমি মনে করি ডেঙ্গু, মহামারি করোনা ভাইরাস, অন্যায়
যুদ্ধ গজব হয়ে আসমান থেকে নেমে এসেছে দুনিয়ায় এই সব মিথ্যাবাদী জুলুমবাজ লোক ও অসৎ
আমানতের খিয়ানতকারী এবং নৈতিকভাবে অধঃপতনে ও উচ্ছন্নে যাওয়া মানুষরুপী দানব গুলোকে
শায়েস্তা করতে। সুতরাং ভালো হয়ে মুল্যবোধ সম্পন্ন মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠার বিকল্প নাই।
তা নাহলে ডেঙ্গু, নিপাহ ও করোনা ভাইরাস প্রাকৃতিকভাবে প্রতিশোধ নিতে আপনার আমার উপরে
যে কোন সময় ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে না শুধু ইতোমধ্যে পড়েছে।মাসুদ ভালো হয়ে যাও এই ডায়ালগ
মূলত মাসুদকে উদ্দেশ্য করে নয় বরং সকল দায়িত্বশীল মানুষকে লক্ষ্য করে বলা। আসলে ভালো
হওয়ার বিকল্প কিছু নেই।