সম্পাদকীয়
প্রকাশ : ১৯ জানুয়ারি ২০২৪ ১৫:০৫ পিএম
যখন কোনো নীতিমালা কিংবা সিদ্ধান্ত
গৃহীত হয় তখন দায়িত্ব হয়ে দাঁড়ায় এর যথাযথ বাস্তবায়ন। নীতি যতই ভালো কিংবা জনকল্যাণমূলক
হোক না কেন বাস্তবায়ন না হলে সেটা অর্থহীন। আমাদের অভিজ্ঞতায় আছে সুনীতির বাস্তবায়ন
কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যপূরণের পথ সুগম করে। ১৮ জানুয়ারি প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এ প্রকাশিত ‘মূল্যস্ফীতি
নিয়ন্ত্রণে আরও সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি’ শিরোনামযুক্ত প্রতিবেদনটি এই বাস্তবতাই ফের
সামনে নিয়ে এসেছে। আমরা জানি, মূল্যস্ফীতির অভিঘাতে শুধু নিম্ন আয়ের মানুষই নয়, এখন
প্রায় সব শ্রেণির মানুষের ওপরই এর কশাঘাতের বিরূপ ফল দৃশ্যমান। এই প্রেক্ষাপটে দেশে
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আরও সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির সুফল মানুষের কাছে কাঙ্ক্ষিত মাত্রায়
নিয়ে আসার ক্ষেত্রে যে চ্যালেঞ্জ বিদ্যমান এই চ্যালেঞ্জ জয়ে শুধু বাংলাদেশ ব্যাংকই
নয়, সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকেই যূথবদ্ধভাবে প্রয়াস চালানোর বিকল্প নেই।
২০২৩-২৪ অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের
জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক সংকোচনমূলক যে মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে তাতে বলা হয়েছে, চলতি অর্থবছরে
সরকারের গড় মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা ৬ শতাংশ থাকলেও নতুন মুদ্রানীতিতে বাংলাদেশ ব্যাংক
তা ধরেছে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। একই সঙ্গে সুদহার ছাড়াও নতুন মুদ্রানীতিতে কমেছে বেসরকারি
খাতের ঋণপ্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা আর বিনিময় হার নির্ধারণে নতুন পদ্ধতিতে যাওয়ার পরিকল্পনা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণা করে বলেন, ‘বর্তমানে
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণই বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান চ্যালেঞ্জ। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের
পাশাপাশি সরকারকেও সহযোগিতা করতে হবে।’ আমরা আগেই বলেছি, সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সহযোগিতা
ভিন্ন মুদ্রানীতি বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। আমাদের অভিজ্ঞতায় আছে, ইতঃপূর্বে মূল্যস্ফীতি
নিয়ন্ত্রণে মুদ্রানীতি যে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য নিয়ে প্রণীত হয়েছিল এর উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন
অনেক ক্ষেত্রেই সম্ভব হয়নি। মূল্যস্ফীতি নামিয়ে আনা, ঋণখেলাপিতে লাগাম টানা ও আর্থিক
খাতে সুশাসন নিশ্চিত করার তিন চ্যালেঞ্জ অগ্রাধিকার দিয়ে যে মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হলো
আমরা মনে করি, এজন্য বাংলাদেশ ব্যাংককেই গুরুত্বপূর্ণ সমন্বয়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে
হবে।
আমরা এ-ও মনে করি, বিদ্যমান
পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে আরও কিছু জরুরি পদক্ষেপ নেওয়া বাঞ্ছনীয়। ব্যবসা-বাণিজ্যের
পথ মসৃণ করার পাশাপাশি বাজারে চাহিদামাফিক পণ্যের সরবরাহ নিশ্চিত করা একই সঙ্গে অতিমুনাফালোভী
সিন্ডিকেটের হোতারা যাতে বাজারে কারসাজি চালিয়ে তাদের উদর আরও পূর্তি করতে না পারে,
সেই লক্ষ্যে কঠোর অবস্থান নেওয়া জরুরি। আমাদের অভিজ্ঞতায় এ-ও আছে, সমাজে বহুল প্রচলিত
সিন্ডিকেটের হোতারা একের পর এক তুঘলকি কাণ্ড ঘটিয়েও পার পেয়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ পরিস্থিতির
বিশ্লেষণে দেখা যায়, বাজারের নাটাই ওই দুষ্টচক্রের মুঠোবন্দি। সর্বাগ্রে এর প্রতিবিধান
নিশ্চিত করতে হবে। তা না হলে সুদহারে হেরফের ঘটিয়ে কিংবা আমদানির ক্ষেত্রে সুযোগ-সুবিধা
বাড়িয়েও এবং আমদানিকারকদের প্রণোদনা দিলেও এর কোনো সুফল মিলবে না। আমরা জানি, সাধারণত
বাজারে টাকার সরবরাহ বাড়িয়ে বা কমিয়ে এর জোগান নিয়ন্ত্রণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু
এরও কাঙ্ক্ষিত ফল মেলেনি। আমরা মনে করি, বিদ্যমান কঠিন পরিস্থিতিতে মুদ্রানীতিতে মূল্যস্ফীতি
নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি গুরুত্ব দেওয়ার সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে ‘হবে-হচ্ছে’র জটাজাল
ছিন্ন করতে হবে। কারণ আমরা দেখেছি, কোনো কোনো ক্ষেত্রে নীতি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে ওই
‘হবে-হচ্ছে’র জটাজালেই যেন অনেক কিছু জড়িয়ে থাকে।
২০২৩ সালের ডিসেম্বর মাসে সার্বিক
মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৪১ শতাংশ। যা আগামী জুনের মধ্যে ৭ দশমিক ০৫ শতাংশে নামিয়ে
আনার লক্ষ্য রয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের। কিন্তু এই লক্ষ্য বাস্তবায়ন মোটেও সহজ হবে না,
যদি যূথবদ্ধ প্রয়াস চালিয়ে জিইয়ে থাকা অসংগতিগুলো দূর করা সম্ভব না হয়। পাশাপাশি ব্যাংকিং
খাতের তারল্য সংকট দূর করার জন্যও সমগুরুত্ব দিতে হবে। অনেক বিশ্লেষকই নতুন মুদ্রানীতির
আলোচনা-সমালোচনা করতে গিয়ে তাদের যে অভিমত ব্যক্ত করেছেন, তা খুব আশাব্যঞ্জক কিছু
নয়। আমরা মনে করি, নতুন সরকারের সামনে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি আর্থিক খাতে
শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা অন্যতম বড় দায়। এক্ষেত্রে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়সহ অন্য পক্ষগুলোকে
শুধু বাজারে তদারকি-নজরদারি বাড়িয়েই দায় শেষ করার অবকাশ নেই। আর্থিক খাতে বিদ্যমান
বিশৃঙ্খলা নিরসন করে খেলাপি ঋণ আদায়ে নির্মোহ কঠোর অবস্থান গ্রহণেরও কোনো বিকল্প নেই।
এককথায় সর্বাগ্রে প্রয়োজন সুশাসন। আমরা বিশ্বাস করি, সুশাসন নিশ্চিত হলে কদাচারের ছায়া
স্বাভাবিকভাবেই দূরীভূত হবে এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে শুধু আর্থিক খাতেই নয়, সব খাতেই শৃঙ্খলা
প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হবে।