× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অস্থিরতা

জাতীয় নিরাপত্তার জন্য অশনীসংকেত

মোহাম্মাদ আলী শিকদার

প্রকাশ : ১৯ জানুয়ারি ২০২৪ ১৫:০৪ পিএম

জাতীয় নিরাপত্তার জন্য অশনীসংকেত

১৪ জানুয়ারি প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কক্সবাজারের উখিয়ায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অস্থিরতা ক্রমাগত বাড়ছে। খুনখারাবি নিত্যনৈমিত্তিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। রোহিঙ্গা সংকট আমাদের জাতীয় সমস্যায় পরিণত হয়েছে, এ কথা বহুদিন ধরেই বলে আসছি। রোহিঙ্গাদের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব-সংঘাতের খবরও নতুন নয়। রোহিঙ্গাদের মধ্যে একাধিক জঙ্গি সংগঠনও তৈরি হয়েছে। প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এর প্রতিবেদনেই বলা হয়েছে, ইতোমধ্যে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সংঘটিত কয়েকটি সহিংস ঘটনার সঙ্গে সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান স্যালভেশন আর্মি অর্থাৎ আরসার সম্পৃক্ততা রয়েছে। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ভেতরেই বিভিন্ন সশস্ত্র জঙ্গি গোষ্ঠী তৈরি হয়েছে। এ সংগঠনগুলো অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতার জন্য বড় হুমকি হয়ে আছে। রোহিঙ্গাদের উপস্থিতি আমাদের জন্য বহুবিধ সংকট তৈরি করেছে। সামনে তা আরও জটিল আকার ধারণ করতে পারে। ২০১৭ সালে হত্যাযজ্ঞের শিকার রোহিঙ্গারা যখন বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে শুরু করে, তার আগেও এ দেশে রোহিঙ্গাদের বাস ছিল। এরা কীভাবে সীমানা পেরিয়ে এখানে এসেছে, ঠাঁই কীভাবে পেয়েছে এ বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য আমাদের কাছে নেই। যেকোনো রাষ্ট্রের জন্য বিষয়টি অভাবনীয় ও উদ্বেগের। বিশেষত ২০১৭ সালের পরপরই রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আরসার অপতৎপরতা বেড়েছে, এমন খবরও সংবাদমাধ্যমে মিলেছে। রোহিঙ্গারা এখানে আশ্রয় নেওয়ার শুরুতে তাদের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। নিরাপত্তাব্যবস্থার ক্ষেত্রে এক ধরনের শিথিলতা তৈরি হয়েছিল, যা ভয়াবহ আকার ধারণ করবে, এমন মন্তব্যও বিভিন্ন মহল থেকে উত্থাপিত হয়েছে।

২০২২ সালে মিয়ানমারের সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান স্যালভেশন আর্মির (আরসা) প্রধান আতাউল্লাহ আবু আম্মার ওরফে জুনুনির নির্দেশে ৩৬ সদস্য পরিকল্পিতভাবে গুলি করে রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহকে হত্যা করে। পুলিশের তদন্তে এরপর একাধিক হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে আরসার সম্পৃক্ততা খুঁজে পাওয়া গেছে। আরসা বাদেও বার্মিজ লিবারেশন আর্মিসহ একাধিক বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অবস্থান করছে। এ সংগঠনগুলো যেন কোনোভাবেই দেশের জননিরাপত্তা বিঘ্নিত করতে না পারে এবং কোথাও যেন ঠাঁই না পায় সেজন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে কঠোর তদারকির ব্যবস্থা নিতে হবে। আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সক্ষমতা রয়েছে। রয়েছে প্রযুক্তিগত সহযোগিতা নেওয়ার সুযোগ। অথচ ক্যাম্পে বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনগুলো এখনও কীভাবে সক্রিয় এবং ক্যাম্পের ভেতর অবৈধ অস্ত্রের সরবরাহের সূত্র সম্পর্কে কারওই কোনো ধারণা নেই বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন দাঁড়ায়Ñ রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বিচ্ছিন্নতাবাদী কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে কি না? যদি তা হয়ে থাকে তাহলে দেশের জননিরাপত্তার জন্য রোহিঙ্গারা বড় অশনিসংকেত।

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বিচ্ছিন্নতাবাদীরা যে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে তা সাম্প্রতিক কয়েকটি ঘটনায় স্পষ্ট। এ ধরনের ক্যাম্পে তিন বা পাঁচ মাস পর একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটা স্বাভাবিক। কিন্তু প্রতিনিয়ত এমন ঘটনা ঘটলে তা উদ্বেগের কারণ তো বটেই। বিষয়টি হালকাভাবে দেখার আর সুযোগ নেই। তা ছাড়া সীমান্তে ইতোমধ্যে মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সংকটের আঁচ লাগতে শুরু করেছে। ১৬ জানুয়ারি প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এর ভিন্ন এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মিয়ানমারের পশ্চিমে বাংলাদেশ ও ভারত সীমান্তের রাইখাইন অঞ্চলের একটি শহরের নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে জান্তা সরকার। শহরটির দখল নিয়েছে আরাকান আর্মি নামে একটি সংগঠন। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আরাকান আর্মিরও উপস্থিতির কথা জানা গেছে। তারা যদি ক্যাম্পকে আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে বিবেচনা করে তাহলে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে। সরকারকে এ সময় বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। আমরা জানি, রোহিঙ্গা সংকট জিইয়ে রাখার জন্য অনেক চক্র সক্রিয়। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে মানবিক সহযোগিতা পৌঁছে দিতে বহু বিদেশি সংস্থা রয়েছে। অনেক এনজিও রোহিঙ্গাদের নিয়ে কাজ করছে। এদের দিকে সরকারের মনোযোগ রাখা জরুরি। যেসব সংস্থা অন্য দেশের কেন্দ্রীয় পর্যায়ের নির্দেশে কাজ করছে তাদের জবাবদিহি রয়েছে। তবে লন্ডনভিত্তিক কিছু এনজিও রয়েছে যেগুলো ধর্মীয় উগ্রবাদী ভাবনার বিস্তারে কাজ করে, এমন অভিযোগ বিভিন্ন মহল থেকে বহুবার উত্থাপিত হয়েছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে শুরু থেকে এ ধর্মীয় উগ্রবাদী সংস্থাগুলোর উপস্থিতি রয়েছে। অর্থনৈতিক সহযোগিতা বা মানবিক সাহায্য দেওয়ার আড়ালে রোহিঙ্গাদের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে বিচ্ছিন্নতাবাদী কর্মকাণ্ডে যুক্ত করারও চেষ্টা হচ্ছে কি না খতিয়ে দেখা উচিত।

অর্থাৎ রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের অপতৎপরতার বিষয়টি হালকাভাবে নেওয়ার সুযোগ নেই। রোহিঙ্গা ক্যাম্প ঘিরে স্থানীয় মানুষের মনেও আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। আমরা জানি, দেশে শান্তিপূর্ণভাবে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন হলেও রাজনৈতিক সংকট এবং অস্থিতিশীলতা এখনও জিইয়ে আছে। কোনো কোনো বিশ্লেষক বলেছেন, রোহিঙ্গাদের উস্কে দিচ্ছে রাজনৈতিক স্বার্থান্বেষী কোনো কোনো মহল। তা ছাড়া রোহিঙ্গাদের কারণে জনভোগান্তিও কম হয়নি। সংবাদমাধ্যমে এও অভিযোগ উঠেছে, রোহিঙ্গারা কায়দাকৌশলে ক্যাম্প থেকে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ছে। তা ছাড়া বাংলাদেশি পাসপোর্ট ব্যবহার করে রোহিঙ্গাদের বিদেশে যাওয়ার বিষয়টিও পুরোনো। এ প্রেক্ষাপটে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নিরাপত্তা এবং শরণার্থী নীতি বাস্তবায়নে সরকারের উচ্চতর পর্যায় থেকে বিষয়টিকে নিবিড়ভাবে দেখার বিকল্প নেই। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কেন সহিংসতা বাড়ছে এর কারণগুলো চিহ্নিত করতে পারলে জননিরাপত্তাসংশ্লিষ্ট সমস্যার সমাধানও সহজ হবে। এ ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে পেশাদারি, প্রযুক্তি ব্যবহারে সক্ষমতা, বিচক্ষণতা, সৎসাহস এবং আধুনিক তদন্তের পথ অনুসরণ করার দক্ষতা দেখাতে হবে। জঙ্গি দমনে সরকারের কঠোর অবস্থান রয়েছে। ইতোমধ্যে জঙ্গি দমনে সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দৃশ্যমান সফলতাও দেখিয়েছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন নির্মূলের কাজটিও তাই কঠিন কিছু নয়। এটি আমাদের জাতীয় সমস্যা, এ সমস্যা সমাধানে বাড়তি মনোযোগ অত্যাবশ্যকীয়। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অবৈধ অস্ত্র সরবরাহের উৎস প্রথমে চিহ্নিত করে তা বন্ধ করতে হবে। ক্যাম্পের ভেতরে অবৈধ অস্ত্র রয়েছে এমন সাক্ষ্য মিলে বিদ্যমান পরিস্থিতিতে। আমি মনে করি, যেকোনো মূল্যে এই অস্ত্র উদ্ধার করার জন্য কৌশলী অবস্থান নিয়ে যা কিছু করণীয় তা দ্রুত করা বাঞ্ছনীয়। তাহলে খুনোখুনি অনেকটাই কমানো সম্ভব।

নতুন সরকারের সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো জননিরাপত্তা ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা। আমরা দেখছি, নির্বাচন-পরবর্তী সময়ও সংঘাত-সহিংসতা থামেনি। রাজনৈতিক কর্মসূচির কিংবা প্রতিবাদের নামে কোনো রাজনৈতিক পক্ষ আগ্রাসি হয়ে উঠলে জননিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়। জনমনে এক ধরনের আতঙ্ক বিরাজ করে। আগ্রাসি বলতে বোঝায়, কোনো ধরনের উস্কানি ছাড়াই যদি আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে কোনো পক্ষ। বিদ্যমান রাজনৈতিক সংকটে একটি পক্ষ আগ্রাসি হয়ে উঠছে। দেশে কোনো আগ্রাসি কর্মকাণ্ড যেমন গণপরিবহনে কিংবা স্থাপনায় আগুন দেওয়ার পর রাজনৈতিক পক্ষগুলো দায় স্বীকার করে না। একে অন্যের দিকে অভিযোগের আঙুল তুলে দেয়। তাতে রাজনৈতিক অঙ্গনে একদিকে ধোঁয়াশা তৈরি হয় অন্যদিকে জনজীবন স্বাভাবিক ছন্দ হারায়। ইতোমধ্যে আমাদের অর্থনীতি কিছুটা ধীরগতির হয়ে উঠেছে। এমন সময়ে কোনো রাজনৈতিক পক্ষ যদি আগ্রাসি হয়ে উঠতে চায়, তাহলে তা অর্থনীতি, রাজনীতি এবং সর্বোপরি আমাদের উন্নয়নের অগ্রযাত্রার জন্য বড় প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াবে। অর্থনীতি চাঙা করে তোলার জন্য বৈদেশিক বিনিয়োগ বাড়ানো জরুরি। কিন্তু রোহিঙ্গা সংকট, বিদ্যমান রাজনৈতিক বিভাজন আমাদের ভাবমূর্তির ক্ষতি করছে। দেশের মানুষ তো উদ্বেগে রয়েছেই, বিদেশিরাও এখানে বিনিয়োগের উপযুক্ত পরিবেশের অভাবে পিছিয়ে যেতে পারেন। এসব বিষয় বিবেচনা করেই সরকারকে সংকট নিরসনে বাড়তি মনোযোগ দিতে হবে। কোনো সংকটকে আলাদা না ভেবেও পৃথক পদ্ধতিতে সমাধান করা যেতে পারে। 


  • অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা