তৈরি পোশাক খাত
বাচ্চু মিয়া
প্রকাশ : ১৮ জানুয়ারি ২০২৪ ১৭:২৬ পিএম
আপডেট : ১৮ জানুয়ারি ২০২৪ ১৮:০৫ পিএম
আমাদের সমাজে একটি কথা প্রচলিত আছে—আগের কালের ছায়াছবির পরিচালকেরা প্রায়ই অদ্ভুত সব কাণ্ড করতেন। কিছু লোক ট্যাক্সি চেপে ঘুরে বেড়াচ্ছে, তারপর হুড়মুড়িয়ে নেমে ড্রাইভারকে ভাড়া না দিয়ে দিব্যি সরে পড়েছে। সারা শহর তারা ট্যাক্সিতে চেপে ঘুরে বেড়ালেন, ফুর্তি করলেন বা কাজের জায়গায় গেলেন আর তারপর কেমন জানি সেখানেই সব চুকে গেল। কাউকে কোনো গাঁটের কড়ি (টাকা) খসাতে হলো না। তারা সর্বদাই বসবাস করতেন দারুণ সব রাজপ্রাসাদে আর তাদের খানাপিনার জোগানও ছিল অফুরন্ত। তারা কখনও টেরই পেতেন না যে কাউকে এসবের সংস্থান করতে হয়েছে। আর এসব তদারক করতে হয়েছে মেহনত করে। ট্যাক্সি চড়লে যেমন ভাড়া দিতে হয়, তেমনই দারুণ সব প্রাসাদে থাকার জন্য মূল্য দিতে হয়েছে কাউকে কাউকে।
গত বছরের অক্টোবর থেকে তৈরি পোশাক শিল্পের
শ্রমিকদের আন্দোলন মনে করিয়ে দেয় মালিকদের কেউ কেউ তাদের কতটা বঞ্চিত করেছেন। আজকের
বাংলাদেশে তৈরি পোশাক শিল্পের বিকাশ এবং এর কর্ণধারদের নানামুখী সক্ষমতা অর্জন শ্রমিকের
শ্রমে-ঘামে নিশ্চিত করেছে, এমনটি বলা মোটেও অমূলক নয়। কিন্তু অনেকেই তা ভুলে গেছেন।
নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ জোসেফ স্টিগলিজ যথার্থই বলেছেন, ‘আর্থিক প্রতিষ্ঠানের
জীবনসমৃদ্ধি ঘটেছে অন্য সবার ক্ষতির বিনিময়ে’।
এশিয়ার মধ্যে অস্বাভাবিক নিম্ন মজুরি এবং অমানুষিক দীর্ঘ সময়ের পরিশ্রমের জাঁতাকল থেকে মুক্তি পেতে যে আন্দোলনে শ্রমিকরা
নেমেছিলেন তার উপহার পেলেন মর্মস্পর্শী চিত্র। আন্দোলন করতে গিয়ে তাদের অনেকেই হতাহতের
শিকার হন। বিস্ময়কর হলো এই শিল্পের ৪০ বছরের অব্যাহত বিকাশের পরও মালিকদের অনেকেই শুধু
যেন লোকসানই দেখেন! অথচ সরকার তাদের নানারকম সুযোগ-সুবিধা তো দেয়ই এবং তাদের সুরক্ষাব্যবস্থাও
নিশ্চিত করে এই বক্তব্যও অমূলক নয়। তৈরি পোশাক খাতে আয়করের হার ১৫ শতাংশ (সবুজ কারখানাগুলোর
জন্য ১০ শতাংশ)। অথচ অন্যান্য শিল্পে এই আয়কর
২০ থেকে ৪০ শতাংশ। তদুপরি, রপ্তানির সময় পোশাক শিল্পের মালিকেরা যে ১ শতাংশ হারে উৎস
কর দিয়ে থাকেন, সেটা তাদের আয়কর থেকে বিয়োগ করা হয়। ফলে তারা প্রায়ই কোনো আয়কর দেন
না, এই অভিযোগও খণ্ডানো দুরূহ।
দ্বিতীয়ত, তৈরি পোশাক শিল্পের মালিকেরা
এখনও `বন্ডেড ওয়্যারহাউস ' সুবিধা ভোগ করেন, যার ফলে তারা আমদানি করা শিল্প-উপকরণের
ওপর কোনো আমদানি শুল্ক দেন না। ড. মোয়াজ্জেমের
এক গবেষণায় দেখা যায়, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) হিসাব অনুযায়ী `বন্ডেড ওয়্যারহাউস
' ব্যবস্থার কারণে ২০১৯-২০২০ সালে মোট ১ লাখ ৫১ হাজার ৭৩৮ কোটি টাকার আমদানি শুল্ক
রেয়াত দেওয়া হয়েছিল। ওই রেয়াতের প্রায় ৮০ শতাংশ পেয়েছিল তৈরি পোশাক শিল্প—এ বার্তা মিলেছিল
একটি প্রচারবহুল দৈনিকের প্রতিবেদনে। এ ছাড়াও এই শিল্পের মালিকেরা ১৫ শতাংশ হারে `নগদ
প্রণোদনা ' পেয়ে থাকেন। তাদের অনেকেই এখন রাজনীতিতেও
যুক্ত। দ্বাদশ জাতীয় সংসদে ২৯৮টি আসনের ফলাফলে ১৯৯ জনই ব্যবসায়ী, এই তথ্য মিলেছে টিআইবি
ও সুজন-এর বিশ্লেষণে।
মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত
এই বাংলাদেশে সাম্য প্রতিষ্ঠা করাই ছিল মূল অঙ্গীকার। কিন্তু দেশের উন্নয়ন-অগ্রগতি
অনেক সাধিত হওয়া সত্ত্বেও বৈষম্যের ছায়া আজও সরল না, তা বিস্ময়কর বৈকি! মূল্যস্ফীতির
অভিঘাতে তৈরি পোশাক শ্রমিকদেরই শুধু নয়, নিম্ন আয়ের মানুষদের পক্ষে স্বাভাবিক জীবনযাপন
কঠিন হয়ে পড়েছে। ভারতবর্ষের শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাস ঘাটলে পাওয়া যাবে শ্রমিকরা সংগ্রামের
জন্য প্রস্তুত থাকলেও সংগঠন পরিচালনার দায়িত্ব ন্যস্ত হয়েছিল অন্যদের হাতে। তখনও সমাজতন্ত্র,
শ্রমিক শ্রেণির ধ্যানধারণা বা শ্রেণি সংগ্রামের ভিত্তিতে কোনো রাজনৈতিক আন্দোলন সৃষ্টি
হয়নি। ফলে অন্যান্য শ্রেণি থেকে বিভিন্ন কারণে যে ‘বহিরাগত’ বা সাহায্যকারী
হিসেবে যারা সাংগঠনিক কাজে এগিয়ে এসেছিলেন। শ্রমিকরা যে শ্রেণি সংগ্রামের ভিত্তিতে
আন্দোলন চালাচ্ছিলেন ও বীরত্বপূর্ণ যে আন্দোলনের মনোভাব ছিল তা ক্ষতিগ্রস্ত করেছিল যারা নেতৃত্বে ছিলেন তাদের। এখনও বাংলাদেশের শ্রমিক রাজনীতির নেতৃত্বে সেই প্রভাব বজায়
রয়েছে।
গত বছর অক্টোবরে পোশাক শিল্পের জন্য
গঠিত মজুরি বোর্ডের ১০৪০০ টাকার প্রশ্নবোধক মজুরি উপস্থাপনার পরে শ্রমিকরা ২৩ হাজার
টাকার দাবিতে আন্দোলন করতে গিয়ে নানা নিপীড়ন-নির্যাতনের শিকার হন। এই পরিস্থিতি উন্নয়নের
সড়কে ধাবমান বাংলাদেশে কোনোভাবেই কাম্য নয়। কার্লমার্কস এর উপস্থিতিতে ১৮৬৪ সালে লন্ডনে
অনুষ্ঠিত ‘ইন্টারন্যাশনাল ওয়ার্কিং মেনস অ্যাসোসিয়েশন’ সম্মেলনে
ঘোষণা করা হয়েছিল, ‘শ্রমিকশ্রেণিকে নিজের মুক্তি নিজেকেই
অর্জন করতে হবে ; একটা শ্রেণির জন্য বিশেষ সুযোগ-সুবিধা ও একাধিপত্যই শ্রমিকশ্রেণির
মুক্তির লক্ষ্য নয়। এই সংগ্রামের লক্ষ্য হচ্ছে সমান অধিকার ও দায়িত্ব এবং শ্রেণি শাসনের
অবসান’। আমরা মনে
করি, সেই আলোকে শ্রমিকের অধিকার নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে পদক্ষেপ নেওয়া বাঞ্ছনীয়। মুক্তিযুদ্ধের
চেতনা বাস্তবায়ন করতে হলে সাম্য প্রতিষ্ঠা সর্বাগ্রে জরুরি।