× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

শিক্ষা

মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতিফলন চাই

এম আর খায়রুল উমাম

প্রকাশ : ১৭ জানুয়ারি ২০২৪ ১৪:২৪ পিএম

মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতিফলন চাই

বছরখানেক আগের কথা। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম প্রকাশিত ‘দ্য স্টোরি অব ভিয়েতনামস ইকোনমিক মিরাকল’ শীর্ষক একটি নিবন্ধের ওপর আলোকপাত করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর ড. মঈনুল ইসলামের একটি লেখা পড়েছিলাম। লেখাটিতে তিনি উল্লেখ করেছিলেন, ‘ভিয়েতনামের এ মিরাকলের পেছনে রয়েছে রাষ্ট্রীয় খাতের বিনিয়োগ প্রবলভাবে জোরদার করার মাধ্যমে মানবোন্নয়ন (শিক্ষা) ও ভৌত অবকাঠামো উন্নয়নকে প্রথম অগ্রাধিকারে পরিণত করা। বিশেষত, প্রাথমিক ও বৃত্তিমূলক (ভোকেশনাল) শিক্ষাকে সবচেয়ে বেশি অগ্রাধিকার দিয়ে ভিয়েতনাম ২০০০ সালের মধ্যেই তাদের সম্পূর্ণ জনসংখ্যাকে শতভাগ শিক্ষিত ও বিশাল একটি অংশকে প্রযুক্তিগত দক্ষতা অর্জনে সাফল্য দেখিয়েছে।’ দশকের পর দশক চরম বিধ্বংসী যুদ্ধ করে বিশ্বের বিক্রম দুই পরাশক্তিকে পরাজিত করে আমাদের চার বছর পর ১৯৭৫ সালে ভিয়েতনাম প্রকৃত স্বাধীনতা লাভ করে। কিন্তু বাস্তবতা এই, আজ মধুমতী সেতুতে যে ১৫০ মিটার স্টিলের স্প্যান বসিয়ে দৃষ্টিনন্দন করা হয়েছে তা ভিয়েতনাম থেকে তৈরি করে আনা হয়েছে। এ দৃষ্টিনন্দন স্টিল স্প্যানে কী এমন আছে যা ভিয়েতনাম পারে আমরা পারি না? সচেতন মানুষ বিশ্বাস করে সর্বত্র সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাবে, দেশপ্রেম-মানবপ্রেমের অভাবে ভিয়েতনাম যা পারে আমরা তা পারি না। স্বাধীনতার ৫০ বছরে যতগুলো সরকার ক্ষমতায় এসেছে সবাই শিক্ষার উন্নয়নে কমিশন গঠন করেছে। কিন্তু কমিশনের সুপারিশ মোতাবেক শিক্ষার উন্নয়নে কোনো সরকার শিক্ষা পরিকল্পনা করে উন্নয়নে ব্রতী হয়নি। এক যুগ আগে শিক্ষানীতি গৃহীত হয়েছে তবে অবস্থার কোনো পরিবর্তন দেখা যায়নি, শিক্ষাব্যবস্থার বেহাল দশা। অথচ সব সরকারেরই শিক্ষার উন্নয়নে অবদানের তালিকা বিশাল। সাধারণ মানুষ সেই বিশালত্বের মধ্যে নিজেদের হারিয়ে ফেলেছে। খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না শিক্ষার উন্নয়নে ব্রতী হওয়া কোনো একটিও সরকারের কর্মফল। আমাদের সরকারগুলো যেন বুঝতেই চাইছে না, পরিকল্পনাহীন যাত্রায় লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব হয় না। কর্মফল অনেক পরের কথা।

শিক্ষার উন্নয়নে প্রথমেই আসে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের কথা। প্রাথমিক ও বৃত্তিমূলক শিক্ষাকে সবচেয়ে অগ্রাধিকার দিয়ে ভিয়েতনাম মাত্র ২৫ বছরে তাদের পুরো জনসংখ্যার শতভাগকে শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে ও বিশাল অংশকে প্রযুক্তিগত দক্ষতা অর্জনে সফল হয়েছে। উন্নত বিশ্বের দিকে তাকালে আমরা এমন অনেক উদাহরণ দেখি। যারা নিজেদের শিক্ষার উন্নয়নে এ নীতি ধারণ করতে সক্ষম ও সফল হয়েছে। তুলনামূলকভাবে যে দেশ জনসংখ্যার যতটুকু অংশকে এ নীতির আওতায় আনতে সক্ষম হয়েছে তারা বিশ্বে নিজেদের অবস্থান সেভাবেই নিশ্চিত করতে পেরেছে। দেশগুলো নিজেদের জনসংখ্যা সম্পদে পরিণত করেছে। কিন্তু বাংলাদেশ জনসংখ্যাকে সম্পদ বিবেচনায় নিয়ন্ত্রণ না করেই প্রযুক্তিগত দক্ষতা অর্জনে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। সনদ বিক্রির কারখানা খুলেছে। শিক্ষাকে পণ্য করা হয়েছে আর এখন এসব জায়গা থেকে জনসম্পদের কোটা পূরণ হচ্ছে। সরকারি প্রাথমিক শিক্ষা পুরো শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে সবচেয়ে অবহেলিত। সরকারি হিসাবে ছয় প্লাস সব শিশুই এখন বিদ্যালয়ে আসে। শতভাগ পাসের ব্যবস্থা হয়েছে, উপবৃত্তি দেওয়া হয়, কিছু প্রতিষ্ঠানে খাবারের ব্যবস্থা রয়েছে, বছরের প্রথমে সব শিক্ষার্থীর হাতে নতুন বই তুলে দেওয়া হচ্ছে। তার পরও শতকরা ২০ ভাগের বেশি শিক্ষার্থী প্রাথমিক শিক্ষার মান অর্জনে ব্যর্থ। শিক্ষার্থীদের এ মান অর্জনকে ৮০-৯০ শতাংশে উন্নীত করতে না পারার প্রকৃত কারণ অনুসন্ধান হয়েছে বলে সচেতন নাগরিকরা মনে করে না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যোগ্য ও দক্ষ শিক্ষকের অভাব, নিয়মিত মনিটরিং না করার ফলে পঞ্চম শ্রেণি উত্তীর্ণরা যেখানে ঠিকমতো বাংলা রিডিং পড়তে পারে না, সেখানে ইংরেজির কথা তো ভাবতেই চাই না, সহজ অঙ্কগুলোও তাদের করতে শেখানো হয়নি।

শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি সাধারণ মানুষের দীর্ঘদিনের দাবি। ১৯৭২ সালে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ যা ছিল বর্তমানে তার কয়েকশ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু এ বৃদ্ধি শুধু টাকার অঙ্কে; শতাংশের হারে চোখ রাখলে বোঝা যাবে প্রতি বছর বরাদ্দ কমেই চলেছে। প্রাথমিক শিক্ষার্থীপ্রতি সরকারের নির্ধারিত ব্যয় কত তা দেখলেই পুরো বিষয়টা আরও পরিষ্কার হয়ে যাবে। তার ওপর প্রযুক্তিগত দক্ষতা অর্জনকারী শিক্ষার্থীদের জন্য সরকারি বরাদ্দ কত, এ দুটো পরিসংখ্যান সামনে আনলেই সরকারগুলোর সদিচ্ছা বোঝা সহজ হয়ে যাবে। মোদ্দাকথা হলো শিক্ষা ক্ষেত্রে শতাংশভিত্তিক বরাদ্দ বৃদ্ধি না হলে শিক্ষা আস্ফালনের মধ্যে থেকে যাবে, মানহীন শিক্ষা নিয়েই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। এখানে তাই রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের প্রয়োজন। নতুবা বিশ্বে অনেক বিষয়ের মডেল হওয়া যাবে, অনেক বিশ্ব সংস্থা থেকে পুরস্কার পাওয়া যাবে, পরিসংখ্যান দিয়ে এসডিজি অর্জন হয়ে যাবে কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হবে না। বাংলাদেশে স্বাধীনতার পর ৪০ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে একটা শিক্ষানীতি তৈরি করতে। তবে এ শিক্ষানীতি যারা করেছেন তারাই মানেন কি না সচেতন মহলের সন্দেহ আছে। আর গ্রহণের এক যুগ পরও শিক্ষানীতির কত শতাংশ বাস্তবায়িত হয়েছে তাও গবেষণার ব্যাপার। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, একটি দেশের শিক্ষানীতি থাকতে হয় তাই করে রাখা হয়েছে। যদিও অনেকে মনেই করেন না এ শিক্ষানীতি দেশ ও জাতির জন্য সম্পূর্ণরূপে কল্যাণকর। তার পরও নীতি বাস্তবায়নে স্বপ্নের যে রূপরেখা তা কাজির খাতায় জ্বলজ্বল করছে শুধু। এদিকে সাধারণ মানুষ এক যুগের অধিক সময় ধরে শিক্ষা আইন তৈরি নিয়ে রশি টানাটানি দেখছে। কবে আলোর মুখ দেখবে তা নির্ভর করছে কোন পক্ষ রশি টানাটানিতে জিতবে তার ওপর। শিক্ষকদের জন্য পৃথক বেতন স্কেলের গল্প রূপকথার মতো স্মরণীয় হয়েই আছে।

সচেতন মহল মনে করে, দেশ ও জাতির জন্য কল্যাণকর ও প্রয়োজনীয় বিবেচনা করে না বলেই স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও আমাদের কাঙ্ক্ষিত শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলা যায়নি। মানবসম্পদ সৃষ্টির জন্য যেভাবে শিক্ষাকে সাজানোর দরকার ছিল তার ধারে কাছে আজ দেশের শিক্ষা নেই। ভিয়েতনাম যেভাবে নিজেদের জন্য কল্যাণকর শিক্ষাব্যবস্থা স্বাধীনতার পরপরই শুরু করতে সক্ষম হয়েছিল, তা করতে আমাদের কত দিন অপেক্ষা করতে হবে কে জানে! দেশের কোনো মানবসম্পদ পরিকল্পনা নেই। কেউ জানে না কোন বিষয়ে কতজন পেশাজীবী প্রয়োজন। সে কারণে একদিকে শিক্ষা কমিশন গঠন করা হয় আর অন্যদিকে রাজনৈতিক ঘোষণা আসে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করার। শিক্ষা কমিশনের সুপারিশের ওপর কেউ ভরসা করে না। কিছু মানুষ তো আবার এ পরিবেশে অনুপ্রাণিত হয়ে পাড়ায় পাড়ায় ইংরেজি মাধ্যম স্কুল খুলছে, কলেজ খুলছে। একটা বাড়িতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও পলিটেকনিক শিক্ষার অনুমতি পাচ্ছে। কওমি মাদ্রাসার সর্বোচ্চ ডিগ্রিকে মাস্টার ডিগ্রির সমতুল্য ঘোষণা করা হচ্ছে। কী বিচিত্র এক ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে শিক্ষা এগিয়ে চলেছে। দেশের জনশক্তি রপ্তানির আয় অর্থনীতির প্রধান স্তম্ভ। অথচ নীতিনির্ধারকরা কখনও হিসাব করেছেন কি না জানি না কত মানুষের শ্রমে বাংলাদেশ কত আয় করে এবং ভিয়েতনাম কত মানুষের শ্রমে কত আয় করে? এ পার্থক্যের কারণ অনুসন্ধান করবে এমন ন্যূনতম প্রয়োজনবোধ কারও হয়নি। নীতিনির্ধারকরা জানেন সাধারণ মানুষের বেঁচে থাকার সংগ্রাম সহজ করে দিলে তাদের লাঠি দিয়ে ঠান্ডা করে রাখা যাবে না, শোষণ করা যাবে না। শিক্ষা মানুষকে চক্ষুষ্মান করে, সুজন করে। তাই জ্ঞানভিত্তিক ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা হলে বহুবিধ সমস্যার সমাধান হবে, মানুষ সচেতন হবে তাতো কাম্য নয়। ফলে সেসব কথা মাথায় রেখেই বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে। দেশে শিক্ষার নামে সনদ পাওয়া যাবে কিন্তু মানহীন শিক্ষা নিয়ে দেশ বেকারত্বের অভিশাপমুক্ত হতে পারবে না।

জার্মানি, জাপানের কথা চিন্তা করতে চাই না। অন্তত ভিয়েতনামের শিক্ষার অনুকরণে শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারলে দেশে বিনিয়োগ বাড়ত, বেকারত্ব কমত, উৎপাদন বাড়ত, বৈষম্য কমত, রিজার্ভ বাড়তো, মানুষ স্বাধীনতার সুখ পেত, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাস্তবায়ন দেখতে পেত। সর্বোপরি দেশ ও জাতি নিজেদের মঙ্গল বুঝতে সক্ষম হতো। সচেতন মানুষ মনে করে, দেশের নীতিনির্ধারকদের আসল সমস্যাটাই এখানে। তাই স্বাধীনতার ৫২ বছর পেরিয়ে এলেও অচিরে ন্যূনতম প্রাথমিক শিক্ষা মানসম্মত হবেÑ এমন আশা করা অবাস্তব ভাবনা বলেই মনে হয়।



  • সাবেক সভাপতি, ইন্সটিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স বাংলাদেশ (আইডিইবি)
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা