বৈদেশিক সম্পর্কোন্নয়ন
এম হুমায়ুন কবির
প্রকাশ : ১৬ জানুয়ারি ২০২৪ ১৪:০৫ পিএম
দ্বাদশ জাতীয়
সংসদ নির্বাচন নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলের বিভাজন ছিল স্পষ্ট। একদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ
পশ্চিমা বিশ্ব এবং অন্যদিকে রাশিয়া-চীন ও ভারতসহ কয়েকটি দেশ এই নির্বাচনকে ঘিরে বিতর্কে
জড়িয়ে পড়েছিল। বড় ধরনের কোনো অনিয়মের অভিযোগ ছাড়াই নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে। ইতোমধ্যে
নতুন সরকারও নবযাত্রা শুরু করেছে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে পাশ্চাত্য মহল
অর্থাৎ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ একাধিক দেশ যেভাবে নির্বাচনী প্রক্রিয়া
যাচাই ও পর্যবেক্ষণ করতে চেয়েছে, নির্বাচনের পরও ওই একই দৃষ্টিকোণ থেকে তারা তা দেখেছে
বলেই প্রতীয়মান। নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা, ভোটারের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের পরিবেশসহ
অংশীদারত্বের প্রসঙ্গে তাদের ভাবনা প্রকাশ করেছে। অন্যদিকে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন
প্রসঙ্গে চীন-রাশিয়ার অবস্থান বহু আগে থেকেই স্পষ্ট ছিল। যেহেতু ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে
পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে চীন-রাশিয়ার এক ধরনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা রয়েছে, সেহেতু তারা
আমাদের নির্বাচন প্রসঙ্গে পশ্চিমা শক্তিগুলোর বিপক্ষে অবস্থান করেছে। ভারতের অবস্থান
অবশ্য কিছুটা ভিন্ন প্রেক্ষাপটে যাচাই করতে হবে। এই নির্বাচনকে ভারত বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ
বিষয় হিসেবেই দেখেছে। নির্বাচন পরিচালনার সময় পর্যন্ত সক্রিয়ভাবে ভূমিকা রাখার ক্ষেত্রেও
তারা এই অবস্থান থেকে সরেনি।
দ্বাদশ জাতীয়
সংসদ নির্বাচন ঘিরে বিদেশিদের বিতর্কে জড়িয়ে পড়ার বিষয়টিকে যদি আমরা বিবেচনা করি, তাহলে
এই তিন ধারার প্রতিক্রিয়া দেখতে পাই। আমরা দেখেছি, নির্বাচনী প্রক্রিয়া নিয়ে জাপানও
তাদের আগ্রহ দেখিয়েছে। আমার ধারণা, এই অঞ্চলে চীনের সঙ্গে তাদের অর্থনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার
বিষয়টি বিবেচনাধীন রেখে তারা সক্রিয় হয়েছে। যদিও মোটাদাগে জাপানের পাশ্চাত্য ধারার
কাছাকাছি থাকার কথা। কিন্তু আমাদের নির্বাচনী প্রক্রিয়ার বিষয়ে তারা ভিন্ন অবস্থান
দেখিয়েছে। অর্থাৎ দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে চালকের আসনে বসার জন্য চীনের তৎপরতাকালে তারা
যেন পিছিয়ে না পড়ে, সেজন্য জাপানও সক্রিয় হতে শুরু করেছে।
বিগত দিনের অর্থনৈতিক
অগ্রযাত্রাকে অব্যাহত রাখার লক্ষ্যকে প্রাধান্য দিয়ে সরকার ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছে।
সরকারের সামনে রয়েছে অনেক চ্যালেঞ্জ। অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিভাজন কূটনৈতিক প্রক্রিয়ার
জন্য প্রতিবন্ধকতা আরও বাড়িয়ে দিতে পারে। সম্প্রতি আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল
কাদের সরকারের সামনে থাকা তিনটি প্রধান চ্যালেঞ্জ চিহ্নিত করে সংবাদমাধ্যমে মতামত ব্যক্ত
করেছেন। তার চিহ্নিত এই তিনটি প্রতিবন্ধকতার বিষয়ে একমত পোষণ করছি। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক
এবং ভূরাজনৈতিকÑ এই তিনটি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় নজর গভীর করা জরুরি। বিগত এক বছরে নির্বাচনী
প্রক্রিয়াকেন্দ্রিক রাজনৈতিক সংকটের কারণে বৈদেশিক মহলের সামনে আমাদের ভাবমূর্তি খানিকটা
হলেও ক্ষুণ্ন হয়। এমনকি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও বিগত দিনে আমাদের উন্নয়নের গল্প ছাপিয়ে
বারবার রাজনৈতিক সংকটের প্রসঙ্গটিই উঠে এসেছে। এই প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের
কাছে গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করার কূটনৈতিক তৎপরতা চালাতে হবে।
গণতান্ত্রিক বিশ্বের অংশ হিসেবে নিজেদের ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধার করার বড় কাজটি সম্পন্ন
করতে হবে সুকৌশলে।
প্রশ্ন হচ্ছে,
কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে কী করে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধার করা যাবে। তাহলে
কোন সূত্র ধরে আমাদের এগোতে হবে? অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সংকট সমাধানের সূত্রসন্ধানের
মাধ্যমে কাজ শুরু করতে হবে। নতুন সরকার সহযোগিতামূলক রাজনৈতিক কাঠামো নির্মাণে কতটা
উদ্যোগী হবে, সেটাই এখন দেখার বিষয়। এই কাঠামোতে নাগরিক সমাজ কতটা ভূমিকা রাখতে পারবে,
তাও ভাবা জরুরি। যে পথে চলছে রাজনীতি, সে পথ পরিবর্তন করতে হবে। দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে
পরমতসহিষ্ণুতার চর্চা বৃদ্ধি এবং সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণমূলক পরিবেশ নিশ্চিত করার
কাজ শুরু করতে হবে। অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ওপর নির্ভর করবে আমাদের আগামী
দিনের ভাবমূর্তি।
রাজনৈতিক সংকটের
পাশাপাশি অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জওসরকারের সামনে নানা প্রতিবন্ধকতা তৈরি করবে। বৈশ্বিক
সংকটের কারণে ইতোমধ্যে অর্থনীতির নানা খাত সংকটে পড়েছে। মূল্যস্ফীতি, আর্থিক খাতে বিশৃঙ্খলাসহ
নানা কারণে জিইয়ে থাকা অর্থনৈতিক সংকট খুব শিগগির নিয়ন্ত্রণে আসবে, এমনটি বলা যাচ্ছে
না। অর্থনৈতিক প্রতিবন্ধকতার দুটো দিক রয়েছে। প্রথমত, অনিয়ন্ত্রিত বাজার ব্যবস্থা ও
মূল্যস্ফীতি, আর্থিক খাতে ব্যবস্থাপনার অভাব, ডলার সংকট, বৈদেশিক বিনিয়োগ কমে আসা,
আমদানি-রপ্তানি খাতে মন্থরগতি, রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে আসাসহ নানা কারণে দেশের অভ্যন্তরে
অর্থনীতির নানা খাত নাজুক হয়ে পড়েছে। দ্বিতীয় প্রতিবন্ধকতাটি বৈশ্বিক অর্থনীতির দরুণ।
বিশ্ব অর্থনীতিতেও ভালো খবর এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। কদিন আগেই বিশ্বব্যাংক জানিয়েছে,
‘চলতি বছর ২ দশমিক ৪ শতাংশ হারে বিশ্ব অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি হতে পারে’। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক
ফোরামের বিগত কয়েক দিনের বক্তব্যেও বিশ্ব অর্থনীতির বড় কয়েকটি চ্যালেঞ্জের কথা উঠে
এসেছে। এই দুটো দিক পাশাপাশি মিলিয়ে দেখলেও আমরা বুঝতে পারি, চলতি বছর অর্থনৈতিক পরিস্থিতি
ক্রমেই জটিল আকার ধারণ করবে। জটিল এই পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকারকে সাহসী কিছু উদ্যোগ
নিতেই হবে। এক্ষেত্রে বিগত কয়েক বছরে অর্থনীতি গতানুগতিক যে প্রক্রিয়ায় হেঁটেছে, তা
অনুসরণের সুযোগ নেই। গতানুগতিক প্রক্রিয়া অবলম্বনে সংকট আরও গভীর হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
অভ্যন্তরীণ অর্থনীতির
সক্ষমতার কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এই সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে তোলার জন্যই বৈদেশিক বিনিয়োগ
জরুরি। বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য অত্যাবশ্যকীয় কিছু অভ্যন্তরীণ উপাদানও থাকতে হবে।
এর মধ্যে সর্বাগ্রে জরুরি সুশাসন। যারা এদেশে বিনিয়োগ করবেন তারা সর্বপ্রথম প্রাতিষ্ঠানিক
ও আইনানুগ সুশাসন যাচাই করেই করবেন। সুশাসন তাদের জন্য বিনিয়োগের যথার্থতা যাচাইয়ের
মাপকাঠি। প্রতিষ্ঠানগুলো ঠিকভাবে কাজ করে কি না, সংঘাত-সহিংস পরিস্থিতি তৈরি হলে তা
নিরসনের উপযুক্ত কাঠামো আছে কি না, আইনের প্রতি সবাই শ্রদ্ধাশীল কি না, এসব বিষয় পর্যবেক্ষণ
করে তারা বুঝতে পারেন দেশের অভ্যন্তরে সুশাসন আছে কি না। ইতোমধ্যে বিশ্বব্যাংক আগামী
বছর আমাদের প্রবৃদ্ধির হার ৫ দশমিক ৬-এ নামিয়ে এনেছে। অর্থাৎ অর্থনীতি নানা ঘাত-প্রতিঘাতের
মুখোমুখি হবে বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। অর্থাৎ অর্থনীতি চাঙ্গা করতে হলে বৈদেশিক বিনিয়োগ
বাড়ানোর বিকল্প নেই। কিন্তু বৈদেশিক বিনিয়োগের বিষয়টি নির্ভর করবে অভ্যন্তরীণ সুশাসনকেন্দ্রিক
ব্যবস্থা গড়ে তোলার ওপর। সুশাসন প্রতিষ্ঠায় আমাদের সৃজনশীলতায় নির্ধারণ করে দেবে বৈদেশিক
সহযোগিতা এবং বৈদেশিক বিনিয়োগের পরিমাণ কত হতে পারে। মূল্যস্ফীতির কারণে ইতোমধ্যে জনজীবনে
অস্বস্তি বেড়েছে। জনজীবনে অস্বস্তির মাত্রা আরও বাড়লে সরকারবিরোধীরা রাজনৈতিক সংকট
পুঁজি করে স্বার্থসিদ্ধির চেষ্টা বাড়াতে পারে।
পাশ্চাত্য দুনিয়ার
সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার জন্য এখনও আমাদের নানা কাজ করতে হবে। রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক
অংশীদারত্ব বাদেও অর্থনৈতিকভাবেও পাশ্চাত্য দুনিয়ার সঙ্গে আমাদের রয়েছে গভীর সম্পর্ক।
রপ্তানি চাঙ্গা করতে হলে পাশ্চাত্য মহলের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের বিকল্প নেই। ২০২৬ সালে
আমরা উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উন্নীত হব। তখন ইউরোপীয় ইউনিয়নের কাছে জিএসপি প্লাস সুবিধা
পাওয়া অত্যাবশ্যকীয় হয়ে উঠবে। কিন্তু জিএসপি প্লাস সুবিধা পেতে হলে গণতান্ত্রিক অধিকার,
মানবাধিকার, বৈষম্য দূরীকরণসহ নানা বিষয় আমাদের পূর্বশর্ত হিসেবে পূরণ করতে হবে। তা
ছাড়া ডলার সংকটের কারণে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও টালমাটাল অবস্থায় রয়েছে। ডলার সংকট
পূরণে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ানো জরুরি। উল্লেখ, গত বছর যুক্তরাষ্ট্র থেকে সর্বাধিক
রেমিট্যান্স সংগ্রহ করেছি আমরা। আগামী দিনগুলোতে এর পরিমাণ আরও বাড়বে বলেই অনুমেয়।
অর্থাৎ এখন আমাদের পশ্চিমা মহলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার বিষয়ে জোর দিতে হবে।
ভারত আমাদের নিকটতম
প্রতিবেশী ও বন্ধুরাষ্ট্র। বাংলাদেশে ভারতের বড় আকারের বিনিয়োগ রয়েছে। দেশটি আমাদের
বৃহত্তম আমদানির বাজার এবং নিরাপত্তা খাতেও দেশটির সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক রয়েছে। আপাতত
এই সম্পর্কের বড় ধরনের পরিবর্তনের সুযোগ নেই। ভারতের সঙ্গে কমপ্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ
অ্যাগ্রিমেন্ট (সেপা) চুক্তি বাস্তবায়নের বিষয়ে আলোচনা চলছে। যদিও তাদের নির্বাচনের
প্রাক্কালে সেপা চুক্তি বাস্তবায়নে কতটা উদ্যোগী হতে পারবে দেশটি তা বলা মুশকিল। কিন্তু
আমাদের সামনে কাজ করার সুযোগ রয়েছে। চীনের সঙ্গে আমাদের অর্থনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে। চীনা
বিনিয়োগ আকর্ষণ করাটাই আমাদের লক্ষ্য। কিন্তু গত বছরে চীনা বিনিয়োগ আশানুরূপ ছিল না।
কারণ চীনের অর্থনীতি এখন চাপের মুখে রয়েছে। এই চাপের মুখে সামনে তারা বিনিয়োগ বাড়াতে
পারবে কি না, সেটিও বড় প্রশ্ন বটে। চীনের বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ভূরাজনৈতিক বিবেচনা এখন
বড় প্রভাবক হিসেবে কাজ করে।
চীন-রাশিয়ার ভূরাজনৈতিক সম্পর্ক এখন যে পর্যায়ে রয়েছে তা সামনেও একই থাকবে ধারণা করা যায়। চীন বা রাশিয়ার সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনের কোনো ইঙ্গিত এখন পর্যন্ত মেলেনি। তবে চলতি বছর থেকে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য রাশিয়া থেকে যে ঋণ নেওয়া হয়েছে তা ফেরত দেওয়া শুরু করতে হবে। অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের সময় এটিও একটি চ্যালেঞ্জ। ভারত, চীন, রাশিয়ার সঙ্গে এখন আমাদের সম্পর্ক যেমন রয়েছে তা থাকতে পারে। কিন্তু পশ্চিমা মহলের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নতির বিষয়ে বাড়তি মনোযোগ দিতে হবে। আইএমএফ থেকে আমরা ইতোমধ্যে দ্বিতীয় কিস্তির ঋণ পেয়েছি। আইএমএফের মতো সংস্থায় নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে কারা থাকেন, তা বিবেচনা করলেই পশ্চিমের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের গুরুত্ব উপলব্ধি করা কঠিন হবে না। ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়’Ñ আমাদের পররাষ্ট্রনীতির এই মূলমন্ত্র যতটা সম্ভব প্রয়োগযোগ্য করে রাখা উচিত।