শ্রদ্ধাঞ্জলি
‘এইখানে বহু শব, বহু মৃত, মাটিতে লুকিয়ে/ আছে স্থির উদাসীন; যেন তারা মৃত্যুকেই নিয়ে/ কী নিঃশব্দে খেলা করে: স্বাধীনতা যেন প্রিয় খেলা!/ মৃত্যু এক অদ্ভুত গহ্বর; কিন্তু সেও অবেলায়…’ (এইখানে বহু শব, বহু মৃত : জাহিদুল হক)। অবেলায় না হলেও যেন তাড়াতাড়িই আমাদের ছেড়ে গেলেন কবি জাহিদুল হক। প্রায় পঁচাত্তর বছরের জীবনের পুরোটাই সৃষ্টিশীলতায় ভরিয়ে তুলেছিলেন ‘পকেট ভর্তি মেঘ’-এর এই কবি। লেখালিখির শুরু বিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকে, স্কুলজীবনেই। ১৯৬৫ সালে দৈনিক সংবাদে তার প্রথম কবিতা প্রকাশ পায়। পরবর্তীতে কর্মজীবনে তিনি এই দৈনিকে দায়িত্ব পালন করেছেন সিনিয়র সহকারী সম্পাদকের। পেশাগত জীবনের বড় অংশ কাটিয়েছেন বাংলাদেশ বেতার এবং রেডিও ডয়চে ভেলেতে। প্রথম কবিতার বই ‘পকেট ভর্তি মেঘ’-এর প্রকাশ ১৯৮১ সালে। প্রকাশিত অন্যান্য কবিতার বইয়ের মধ্যে রয়েছেÑ তোমার হোমার, নীল দূতাবাস, সেই নিঃশ্বাসগুচ্ছ, পারীগুচ্ছ ও অন্যান্য কবিতা, এই ট্রেনটির নাম গার্সিয়া লোরকা এবং এ উৎসবে আমি একা। শুধু কবিতাই নয়, গল্প-উপন্যাসও লিখেছেন। ব্যালকনিগুলো এবং আমার ভালোবাসার অটম তার গল্পগ্রন্থ। তোমার না আসার বার্ষিকী এবং আমজাদ আলির মেঘবাড়ি তার লেখা উপন্যাস। ২০০২ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার পাওয়া জাহিদুল হকের রচনাসম্ভার খুব বিস্তৃত না হলেও সমৃদ্ধ। প্রতিভা এবং সৃষ্টিশীলতার তুলনায় প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যাকে হাতে গোনা, মাত্র ১৮টি। সাহিত্যে তিনি পরিমিতিবোধকে প্রাধান্য দিয়েছেন। শব্দ ব্যবহারেও ছিল তার দক্ষতা। যা ধরে রেখেছিলেন গীতিকার হিসেবেও। রচিত কয়েকশ গানের কয়েকটি গান শ্রোতাদের হৃদয়স্পর্শ করেছে, ছড়িয়েছে কণ্ঠে কণ্ঠে। শেখ সাদী খানের সুরে সুবীর নন্দীর কণ্ঠে গাওয়া ১৯৭৮ সালে রেকর্ড হওয়া তার রচিত ‘আমার এ দুটি চোখ পাথর তো নয়, তবু কেন ক্ষয়ে ক্ষয়ে যায়’ মর্যাদা পেয়েছে কালজয়ী গানের। পরবর্তীতে গানটি যুক্ত হয় ‘মহানায়ক’ চলচিত্রে।
জাহিদুল হকের
জন্ম চিকিৎসক পিতার কর্মস্থল ভারতের আসামের বদরপুর রেলওয়ে হাসপাতালে ১১ আগস্ট ১৯৪৯
সালে। বাবার চাকরি এবং পরবর্তীতে নিজের চাকরিসূত্রে ঘুরে বেড়িয়েছেন নানান দেশ। দেশভাগের
পর চলে আসেন বাংলাদেশে। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বেতারের শাহবাগ কেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত
কর্মকর্তা হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করা জাহিদুল হক ছিলেন প্রকৃতার্থেই নিভৃতচারী।
কবিতায় তিনি স্বপ্নের জাল বুনেছেন, স্বপ্ন দেখিয়েছেন। পাঠককে প্রত্যক্ষ করিয়েছেন নিজের
ভেতরের সত্তা, যা তার কবিতাকে দিয়েছে অনন্যতা।
তিনি বিশ্বাস
করতেন, ‘কবিকে চিরকাল নিজের কাছে এবং কবিতার কাছে সৎ থাকতে হয়। প্রচণ্ড একাগ্রতা নিয়ে
তাকে শুদ্ধতার পথে এগিয়ে যেতে হয়।’ তিনি সেই সততা, সেই একাগ্রতা, সেই শুদ্ধতা নিয়েই
কবিতাচর্চায় মগ্ন থেকেছেন। অপেক্ষা ছিল একুশে ও স্বাধীনতা পদকের। কিন্তু জীবদ্দশায়
সে সৌভাগ্য না হলেও ‘আমার আফসোস নেই, বরং অহংকার আছে’ বলে যে দৃঢ়তা তার ছিল, সেই অহংকার
নিয়েই তিনি চলে গেলেন। তাকে উদ্ধৃত করেই বলি, ‘তোমাদের মনে রাখি মৃতগণ, প্রিয় স্বজনেরা;/
যারা ছিল নেই; কিন্তু চিরকাল সুঘ্রাণের ঘেরা/ স্বপ্নের বাড়িতে, প্রান্তরে, দেশে, পতাকার
রঙে/ উৎসবে কি অনুৎসবে, কবিতায়, গানেদের অঙ্গে/ তোমাদের পাবো খুবই: তোমাদের স্মৃতিগুলো
খুবলে/ এনে আলো দেব সূর্যকে, চন্দ্রকে — ভালোবাসা উগলে!’ বিদায় পকেট ভর্তি মেঘের কবি,
জাহিদুল হক। যাওয়ার আগে এই নশ্বর পৃথিবীতে কোথায় যেন মায়া রেখে গেলেন। ক্ষয়ে ক্ষয়ে
যেতে যেতে রক্তমাংসে, হৃদয়ের চোখ আমাদের স্মৃতিগুলো খুবলে খুবই পাবে, আপনাকে, আপনার
সৃষ্টিকে।