সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়
প্রকাশ : ১৫ জানুয়ারি ২০২৪ ১০:৫৯ এএম
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পুলিৎজার পুরস্কার বিজয়ী খ্যাতিমান সাংবাদিক
ও লেখক মার্ক ওবমাসসিকের পাহাড় নিয়ে উক্তিটি অত্যন্ত প্রণিধানযোগ্য। পাহাড়-সম্পর্কিত
তার একটি লেখায় তিনি লিখেছিলেন, ‘আমি পাহাড়কে ভালোবাসি কারণ তারা আমাকে এটা অনুভব করায়
যে আমি তাদের চেয়ে ছোট।’ মার্ক ওবমাসসিকের পাহাড় নিয়ে দীর্ঘ লেখায় তিনি এই গুরুত্বও
তুলে ধরেছিলেনÑপ্রকৃতির গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ পাহাড়-বনাঞ্চল ধ্বংস হওয়া মানেই জীবনের
সর্বনাশের খতিয়ান বিস্তৃত হওয়া। তার মন্তব্যগুলো ১৪ জানুয়ারি প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এ
প্রকাশিত, ‘বন অফিসের নাকের ডগায় নিত্য চলে পাহাড় কাটা’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনের
প্রেক্ষাপটে আরও বেশি গুরুত্ব অনুধাবন করার তাগিদ দেয়। ‘এক্সকাভেটর দিয়ে পটিয়ায় পাহাড়-টিলা
সাবাড়’ শিরোনামে গত বছরের ২১ মে প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এ একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
প্রতিবেদনটি হাইকোর্টের নজরে এলে সেদিন আদালত স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে রুলসহ আদেশ দেন। পটিয়া
ও চন্দনাইশ উপজেলার ইউএনওর উদ্দেশে হাইকোর্ট বলেন, ‘এক কোদাল মাটি কেটে নিলেও আইনে
সর্বোচ্চ যে শাস্তি আছে, তা নিশ্চিত করতে হবে। পাহাড় কাটলে মনে করবেন, আপনার শরীরে
আঘাত লাগছে- এই অনুভূতি নিয়ে কাজ করবেন। কোনো ধরনের অবহেলা দেখলে পরিণতির মুখোমুখি
হতে হবে। সুন্দরভাবে কাজ করেন।’ পরিবেশ রক্ষার ক্ষেত্রে কোনো ধরনের আপস নয় বলেও উল্লেখ
করেন হাইকোর্ট।
আমরা দেখছি, পাহাড়ের গায়ে কশাঘাত বন্ধে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা সত্ত্বেও
প্রশাসনের দায়িত্বশীলদের ঘুম ভাঙেনি, দায়িত্বহীনতা ঘোচেনি। ১৪ জানুয়ারি প্রতিদিনের
বাংলাদেশের প্রতিবেদনটি ফের এই সাক্ষ্যই দিল। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চট্টগ্রামের সাতকানিয়া
উপজেলার কেরানীহাট-বান্দরবান সড়কের পাশে মহল্লারটেকে বনাঞ্চলের বাগানের মধ্যে পাহাড়
কাটা হচ্ছে। পাহাড় ও বনাঞ্চল নিধনের এমন সর্বনাশা কাণ্ড নতুন নয়। সামাজিক ও সংরক্ষিত
বনাঞ্চল উজাড় হচ্ছে বন বিভাগের অসাধু দায়িত্বশীলদের সঙ্গে যোগসাজশে এমন বার্তাও প্রতিদিনের
বাংলাদেশসহ অন্য সংবাদমাধ্যমে ইতোমধ্যে বহুবার উঠে এসেছে। পরিবেশ আইনে পাহাড় কাটা সম্পূর্ণ
নিষেধ ও দণ্ডনীয় অপরাধ হলেও চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় পাহাড় কেটে মাটি বিক্রি করার যে
চিত্র ওই প্রতিবেদনে উঠে এসেছে তা আমাদের ক্ষুব্ধ করলেও বিস্মিত করে না। কারণ শুধু
চট্টগ্রামের ওই অঞ্চলেই নয়, দেশের বিভিন্ন স্থানেই পাহাড় কাটার আত্মঘাতী কর্মকাণ্ডের
অপছায়া কমবেশি বিস্তৃত। জরিমানা দিয়ে আবার একই অপরাধ করার মানে দেশের প্রচলিত আইন ও
বিচারব্যবস্থাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানো। সাতকানিয়ার ঘটনাটি এ থেকে বিচ্ছিন্ন কিছু নয়।
ইতঃপূর্বে অবিরাম পাহাড় কাটার দায়ে পাহাড়খেকো কাউকে কাউকে আর্থিক দণ্ডে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল
মহল দণ্ডিত করলেও ফের তারা একই অপকাণ্ডে মেতে উঠেছে এমনটিও সংবাদমাধ্যমে বহুবার উঠে
এসেছে। সুশাসন বা আইনের শাসন থাকা কোনো সমাজে এমনটি ঘটতে পারে না। কিন্তু পাহাড় কাটা
বা বনাঞ্চল ধ্বংস করা যেন নিত্যদিনের ঘটনায় পরিণত হয়েছে এবং বলবান চক্রের সঙ্গে অসাধু
দায়িত্বশীলদের উদরপূর্তির মহড়া যেন অপ্রতিরোধ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা প্রশ্ন রাখতে চাই,
বন বিভাগের দায়িত্বশীলদের নাকের ডগায় কীভাবে এই অপকর্ম চলছে?
খ্যাতিমান গীতিকার মোহাম্মদ রফিকুজ্জামান রচিত ও খন্দকার নুরুল আলম
সুরারোপিত প্রয়াত শিল্পী সুবীর নন্দীর কণ্ঠে গীত, ‘পাহাড়ের কান্না দেখে/ তোমরা তাকে
ঝর্ণা বলো/ ওই পাহাড়টা বোবা বলেই কিছু বলে না…’ এই গানটির ব্যাপ্তি কিংবা মর্মার্থ
কত ব্যাপক নতুন করে এর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের প্রয়োজন পড়ে না। নির্বাক পাহাড় সবাক মানুষকে
প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকেই শুধু সুরক্ষা দেয় না, একই সঙ্গে প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা করে
মানুষের স্বচ্ছন্দ জীবনযাপনের পথও সুগম করে রাখে। কিন্তু যে পাহাড় ও বনের মানুষের কল্যাণে
এত বড় ভূমিকা প্রকৃতির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই দুই উপাদেয়র ওপরই কতিপয় মানুষের অপরিণামদর্শী
কর্মকাণ্ডের বিরূপ ফল কতটা মর্মস্পর্শী হয়ে উঠতে পারে এই নজিরও তো আমাদের সামনেই রয়েছে।
কিন্তু তারপরও সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল মহলেও অসাধুসহ লোভাতুর ক্ষমতাবানদের হুঁশ ফিরছে
না সর্বনাশের পথ রুদ্ধ করতে। তাদের কাছে নিজেদের উদরপূর্তির যে ঘৃণ্য কর্মকাণ্ড প্রতিপালনীয়
তা অত্যন্ত দুঃখজনক। আমরা মনে করি, এখনও সময় আছে, কঠোর প্রতিকারেই এর যথাযথ প্রতিবিধান
সম্ভব।
আমাদের স্মরণে আছে, জাতীয় সংসদের পরিবেশবিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির
জনৈক সদস্যের বিরুদ্ধে ২০২০ সালে পাহাড় কাটায় সম্পৃক্ত থাকা বা এ ধরনের কর্মকাণ্ডে
জড়িতদের প্রশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ উঠেছিল। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে হাইকোর্ট কক্সবাজারের
সাতটি উপজেলার পাহাড়, টিলা, পাহাড়ি বন কাটা রোধে এবং সমুদ্রসৈকত রক্ষা বিষয়ে রুল জারি
করেছিলেন। অভিযোগ আছে, পরিবেশবিধ্বংসী এমন অপকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের একটি বড়
অংশ রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী এবং স্থানীয় জনপ্রতিনিধি। আমরা দেখছি, পাহাড় ও বন কাটার
সঙ্গে জড়িত শ্রমিকদের মাঝেমধ্যে আটক করা হলেও মূল হোতারা থেকে যাচ্ছে অস্পর্শিত। আর
পাহাড় কাটার বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে বা পরিবেশ আদালতে মামলা করেই যেন পরিবেশ অধিদপ্তর
দায়িত্ব শেষ করার পথ খোঁজে। আমরা এর নিরসন চাই। এ নিয়ে আমরা কোনো কথা শুনতে চাই না,
কাজের কাজ দেখতে চাই। আমরা বিশ্বাস করি, আইনের দুর্বলতা দূর করে সুষ্ঠু প্রয়োগ নিশ্চিত
করা গেলে অর্থাৎ সুশাসন নিশ্চিত হলে এমন অপরিণামদর্শী কর্মকাণ্ডের পথ সংকুচিত হতে বাধ্য।
আমরা প্রত্যাশা করব, সরকারের দায়িত্বশীল প্রত্যেকটি সংস্থার ঘুম ভাঙবে। আমরা দেখছি
পাহাড় ও বনাঞ্চলে কশাঘাতের ফলে বর্ষা মৌসুমে পাহাড় ধসে হতাহতের মর্মস্পর্শী ঘটনা ঘটছে
এবং অনেক ক্ষেত্রেই জলাবদ্ধতা প্রকট আকার ধারণ করে জনজীবনের জন্য বৈরী পরিস্থিতি সৃষ্টি
করছে। আমরা দেখতে চাই, অপশক্তির হাত আইনের হাতের চেয়ে লম্বা নয়। সরকারি যে সংস্থাগুলো
আদালতের নির্দেশনা মানছে না, অপরাধ দেখেও না দেখার ভান করছে, এরও প্রতিবিধান নিশ্চিত
করার দায় সরকারেরই।