সুশাসন
দেবব্রত চক্রবর্তী বিষ্ণু
প্রকাশ : ১৫ জানুয়ারি ২০২৪ ১০:৪৮ এএম
দেবব্রত চক্রবর্তী বিষ্ণু
মহাকাব্য মহাভারতের গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র পঞ্চপাণ্ডবের তৃতীয় পাণ্ডব
অর্জুন নানাভাবে জাজ্বল্যমান। তিনি যে ধনুকটি ব্যবহার করতেন সেটি ঐশ্বরিক ধনুক হিসেবে
বর্ণিত। মহাভারতে বলা হয়েছে, ধনুকটি ব্রহ্মা তৈরি করেছিলেন এবং এর নাম গাণ্ডীব। বৈশিষ্ট্যগত
দিক বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, গাণ্ডীব শক্তিশালী আত্মবিশ্বাস দেয়। ওই ধনুকটি একশ আটটি
স্বর্গীয় রজ্জু নিয়ে গঠিত এবং দুর্দান্ত শক্তিতে পরিপূর্ণ। বিশ্বাস করা হয়, এক লাখ
ধনুকের শক্তি নিহিত ওই গাণ্ডীবে। এও বলা হয়েছে, গাণ্ডীব অবিনশ্বর ও স্বর্গীয়।
এই গৌড়চন্দ্রিকার প্রেক্ষাপট তৈরি করেছে নবনিযুক্ত মন্ত্রিদের অঙ্গীকার-প্রতিশ্রুতি।
টানা চতুর্থবার এবং মোট পঞ্চমবারের মতো আওয়ামী লীগ প্রধান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা
এ মেয়াদে মন্ত্রিপরিষদ গঠন করে রীতিমতো চমক দিয়েছেনÑ এই বার্তা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম
তো বটেই সংবাদমাধ্যমেও প্রাধান্য পাচ্ছে। মন্ত্রীদের একেকজনের অঙ্গীকার-প্রতিশ্রুতি
অর্জুনের সেই গাণ্ডীবের কথাই মনে করিয়ে দিয়েছে। মনে পড়ছে আলবার্ট আইনস্টাইনের সেই বিখ্যাত
উক্তি, ‘প্রতিশ্রুতি হলো মেঘ, যার পরিপূর্ণ রূপ বৃষ্টি’। একই সঙ্গে স্মরণ করছি, অস্ট্রেলিয়ান
সাইক্লিস্ট ডেভিড নিকোলাসকে। তিনি বলেছিলেন, ‘যদি তুমি প্রতিশ্রুতি দিতে শিখে যাও,
তবে তা পরিপূরণ করাও শিখে নাও।’ আইরিশ কবি রবার্ট ফ্রস্ট বলেছিলেন, ‘তোমার প্রতিশ্রুতিই
মানুষের কাছে তোমার মুখের কথার মূল্য নির্ধারণ করবে।’ মহাভারত থেকে শুরু করে মানবসমাজের
খ্যাতিমানদের জীবন আখ্যানের উপলব্ধিতে যে অনুভূতির প্রকাশ ঘটেছে এ দৃষ্টিকোণ থেকে নতুন
মন্ত্রিপরিষদের সদস্যদের অঙ্গীকার-প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন শেষ পর্যন্ত কতটা সম্ভব হবে
এর পরিচয় মিলবে সেই প্রবাদের মধ্য দিয়ে, ‘বৃক্ষ তোমার নাম কী, ফলে পরিচয়’।
হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচং উপজেলার নাগুরায় জন্মগ্রহণকারী দেশের খ্যাতনামা
চিকিৎসক ডা. সামন্ত লাল সেনের মতো একজন সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক ব্যক্তিকে দেশের ভঙ্গুর
খাতগুলোর অন্যতম স্বাস্থ্য খাত অর্থাৎ স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী
হিসেবে নিয়োগ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চমকের মন্ত্রিসভার যেন আরও চমক দিলেন।
ডা. সামন্ত লালের সাধনা ও ব্রত চিকিৎসাসেবা, রাজনীতি তার কখনও ভাবনায় ছিল না। তিনি
বাংলাদেশ প্লাস্টিক সার্জন সোসাইটির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি শেখ হাসিনা
জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের প্রধান সমন্বয়ক ছিলেন, যেটি এশিয়ার
দগ্ধ রোগীদের অন্যতম চিকিৎসাকেন্দ্র হিসেবে ইতোমধ্যে খ্যাতি অর্জন করেছে। ডা. সেন প্রতিষ্ঠানটিকে
শ্রমে-ঘামে-চিন্তায় এবং কর্মদক্ষতায় একটি দৃষ্টান্তযোগ্য প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাঁড় করাতে
যে ভূমিকা পালন করেছেন, এর জন্য তিনি নিশ্চয়ই জনমনে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। তার মতো একজন
অরাজনৈতিক ব্যক্তি স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের টেকনোক্র্যাট মন্ত্রী হিসেবে
দায়িত্ব পেয়ে ১৪ জানুয়ারি প্রথম কার্যদিবসে সচিবালয়ে সাংবাদিকদের উদ্দেশে বলেন, ‘আমরা
যদি সবাই সিরিয়াসলি কাজ করি, অসম্ভব কিছু না। পাঁচ থেকে পাঁচশ বেডে (বার্ন ইউনিট) আসতে
আমার অনেক কষ্ট হয়েছে। আমি অনেকের কাছে গেছি প্রথম প্রথম। আমাকে অনেকে ফিরিয়ে দিয়েছেন
এবং ফাইল ছুড়ে মেরেছেন, এরকম ঘটনাও আমার আছে। কিন্তু আমি ধৈর্য ধরে আসছি এবং সবার সহযোগিতা
পেয়েই এ জায়গায় আসছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে চিকিৎসাসেবা পৌঁছে দেওয়ার
জন্য আমি চেষ্টা করব। ওটা করতে পারলে ঢাকা শহরের ফ্লোরে শুয়ে চিকিৎসা নিতে হবে না।
আমি প্রত্যেকটা হাসপাতালে যাব, কী কী সমস্যা আছে জানব। তারপর আমি একটা কর্মপরিকল্পনা
করব। একটি মেডিকেল কলেজ খুললেই হবে না, সেখানে চিকিৎসা লাগবে। আমি সব বিষয় দেখব। গ্রামে
ডাক্তার কেন থাকে না, তার কারণ বের করতে হবে। আমি চেষ্টা করব দুর্নীতি নিয়ে জিরো টলারেন্সে
থাকতে। আমি আগের মতোই থাকব, আমাকে একটু উপদেশ দেবেন। আপনাদের উপদেশ পেলে আমরা নির্ধারিতভাবে
কাজ করতে পারব।’ ডা. সামন্ত লাল সেনের দীর্ঘ বক্তব্য এই লেখায় উদ্ধৃত করার কারণ, একজন
প্রবীণের নবপ্রত্যয়ে আশান্বিত হওয়ার প্রেক্ষাপটে।
বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম বলেছেন, ‘স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি
প্রতিষ্ঠা করতে পারলে সিন্ডিকেট নিয়ে অভিযোগ থাকবে না।’ এ রকম প্রত্যয় নতুন মন্ত্রিসভার
আরও অনেকেই করেছেন। আমরা জানি, মূল্যস্ফীতির কঠিন অভিঘাত জনজীবন বিপর্যস্ত করে তুলেছে।
নিম্ন আয়ের মানুষ তো বটেই, সর্বস্তরের মানুষই এখন বাজারের চাপে-তাপে নাকাল। বাজার পরিস্থিতি
নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই কতটা উদ্বিগ্ন এরও সাক্ষ্য মিলেছে নতুন সরকারের
দায়িত্বভার নেওয়ার প্রারম্ভেই। ১৩ জানুয়ারি গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় তার নিজ বাসভবনে
নবনিযুক্ত মন্ত্রীদের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দেন, পবিত্র রমজানে
পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যবস্থা নিতে। যে দুজন মন্ত্রীর অঙ্গীকার-প্রত্যয় তুলে ধরলাম,
তারা মন্ত্রী হিসেবে একেবারেই নবীন। আগে মন্ত্রী পদে দায়িত্ব পালন করেছেন যাদের বেশ
কয়েকজন এই মন্ত্রীসভায়ও আছেন তাদের অঙ্গীকার-প্রত্যয় তুলে ধরতে গেলে নিবন্ধের কলেবর
অনেক বড় হয়ে যাবে। সেই কবে উচ্চারিত নিউফাউন্ডল্যান্ড এবং নর্থ আমেরিকান নৌবাহিনীর
উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা চার্লস ওয়াটসনের মতো প্রত্যাশা করব- আগামীকাল আরও একটা সুন্দর,
ঝকঝকে দিন আসতে চলেছে।
বিদায়ি মন্ত্রিসভার অনেক গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের রাজনৈতিক মন্ত্রীরা
এবার মন্ত্রিসভায় ঠাঁই পাননি। আমরা দেখছি, এবার যাদের মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্তি ঘটেছে
তাদের অনেকের মন্ত্রণালয় চালানোর মতো কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই। আবার কাউকে কাউকে এমন
মন্ত্রণালয়ে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে যাদের ভবিষ্যৎ কর্মধারা নিয়ে অনেকের মনে সংশয় আছে।
কারণ, এই বিষয়গুলোতে তাদের অনেকেরই পূর্বধারণা নেই। এই প্রেক্ষাপটে বলা যায়, পঞ্চমবারের
মতো প্রধানমন্ত্রী হয়ে শেখ হাসিনা অভিজ্ঞতার আলোকে চ্যালেঞ্জ জয়ের চ্যালেঞ্জ নিয়ে যাত্রা
শুরু করেছেন। সচেতন মানুষ মাত্রই জানা, অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সংকট এবং দেশ-বিদেশের নানা
মহল তো বটেই, কোনো কোনো দেশের সরকারেরও শ্যেন দৃষ্টির মধ্য দিয়ে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ
নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে। দেশ-বিদেশের পর্যবেক্ষকরা অভিমত দিয়েছেন, ভোটার উপস্থিতি কিছুটা
কম হলেও নির্বাচনের পরিবেশ ছিল সন্তোষজনক। আমরা দেখেছি, নির্বাচনকালে কিছু অনিয়ম-অভিযোগ
উত্থাপিত হলে কমিশন তাৎক্ষণিকভাবে এর প্রতিবিধান নিশ্চিত করেছে। এমনকি ভোটপর্বের প্রায়
অন্তিমলগ্নে একজন প্রার্থীর প্রার্থিতাও বাতিল হয়, যিনি ছিলেন ক্ষমতাসীন দলের মনোনীত
প্রার্থী। সমালোচকদের কাছে এই বিষয়গুলো কীভাবে পর্যালোচিত হবে জানি না। তবে মোটাদাগে
এ কথা বলা যায়, নির্বাচন কমিশন ও নির্বাচনকালীন তাদের সহযোগী শক্তি সরকার বড় একটি চ্যালেঞ্জ
জয় করে এসেছে।
নতুন সরকারের সামনে চ্যালেঞ্জ যেমন সারিবদ্ধ তেমনি সমান্তরালে রয়েছে জনপ্রত্যাশাও। ধারাবাহিক তিন মেয়াদের শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার সন্দেহাতীতভাবে দেশের উন্নয়ন-অগ্রগতির ক্ষেত্রে অভাবনীয় সাফল্য দৃশ্যমান করতে সক্ষম হয়। কিন্তু পাশাপাশি এই সত্যও কোনোভাবেই এড়ানো যাবে না, দুর্নীতি নির্মূলে সরকারের ‘শূন্য সহিষ্ণুতা’র অঙ্গীকার সত্ত্বেও কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় সুফল দৃশ্যমান করা যায়নি। আমরা দেখেছি, বিদায়ি সরকারের অনেক মন্ত্রী-এমপির নির্বাচনী হলফনামায় সম্পদের অস্বাভাবিক স্ফীতি। এমনকি এক্ষেত্রে তাদের স্ত্রী এবং কারও কারও আত্মীয়-স্বজনও পিছিয়ে নেই। তাদের অনেকেই নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে পারেননি। আবার যারা পার হয়েছেন তাদেরও অনেকে মন্ত্রিপরিষদে ঠাঁই পাননি। এমন প্রেক্ষাপটে অতীতের নিরাশার পাশাপাশি বর্তমানে কিঞ্চিৎ হলেও আশার আলো মিটমিট করছে। নবনিযুক্ত মন্ত্রীদের অঙ্গীকার-প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন তারা কতটা করতে পারেন, এর জবাব দেবে ভবিষ্যৎ। সমাজে আয়বৈষম্য ও অনিয়ম যে হারে বাড়ছে এমন প্রেক্ষাপটে সরকারকে চ্যালেঞ্জজয়ী হতে হলে মন্ত্রীদের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে। একজন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মানেই সরকার নয়, পূর্ণাঙ্গ মন্ত্রী কমিটি নিয়েই তার সরকার। আমরা আশা করব, নবনিযুক্ত মন্ত্রীরা তাদের গাণ্ডীব দৃশ্যমান করতে সক্ষম হবেন। সর্বাগ্রে চাই সুশাসন। যদি সুশাসন নিশ্চিত হয় তাহলে জনপ্রত্যাশা অনেকাংশেই পূরণ হবে। সুশাসন ব্যতিরেকে সুফলের আশা দুরাশারই নামান্তর।