শ্রদ্ধাঞ্জলি
পাভেল পার্থ
প্রকাশ : ১৪ জানুয়ারি ২০২৪ ১২:০৯ পিএম
রবীন্দ্রনাথ সরেন
চলতি আলাপখানি এই অসময়ে, এভাবে লিখতে হবে ভাবিনি। এই যে শীতের দমকা বাতাস, ঝিমধরা উত্তরাঞ্চল, এই সময়ে তিনি গ্রামে গ্রামে কম্বল আর শীতের কাপড় নিয়ে দাঁড়িয়েছেন। এই যে করোনা মহামারিতে কাজ না পাওয়া মানুষ দিগ্বিদিক হয়েছিল, তিনি ছুটে গেলেন সেই নিরন্ন মানুষের মিছিলে। কলেজ বা হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে, টাকা নেই, বিস্ময়করভাবে তিনি জোগাড় করে ফেলতেন। মাঝরাতে কারও ঘরে আগুন দিয়েছে দুর্বৃত্ত, খুন-ধর্ষণ ঘটেছে, দখল হয়েছে আদিবাসী ভূমি, নির্যাতন ঘটেছে কোনো প্রান্তেÑ দারুণ সাহস নিয়ে তিনি দাঁড়িয়েছেন। ভীমপুর থেকে নাচোল, কাঁকনহাট থেকে গোবিন্দগঞ্জ, চা-বাগান থেকে রাঙামাটি, ফুলবাড়ী থেকে রংপুর, বরেন্দ্র থেকে রাজধানী কিংবা জাতিসংঘে আদিবাসী বিষয়ক সম্মেলনÑ সর্বত্র তিনি ছিলেন সোচ্চার। সক্রিয় এবং তুখোড়। কর্মী এবং নেতা। তিনি রবীন্দ্রনাথ সরেন। মেহনতি প্রান্তিক মানুষের নেতা এই বিরল মানুষটি জনপরিসরে ‘আদিবাসী নেতা’ হিসেবে বেশি পরিচিত। আমরা তাকে ‘রবীনদা’ ডাকি। ১৯৯৮ সালে তার সঙ্গে আমার পরিচয়। তারপর আমরা বন্ধু হয়ে উঠেছি মাঠ থেকে ময়দান, মন থেকে মিছিল। পরীক্ষা ও প্রমাণের দীর্ঘযাত্রায় তিনি আমার প্রণম্য শিক্ষক ও নেতা। এরপর একটা লম্বা সময় ধরে আমরা একে অন্যের পরিবারের মানুষ হয়ে গিয়েছিলাম। এমনকি রবীনদার নিজের গড়া সংগঠন ‘জাতীয় আদিবাসী পরিষদ’-এর সঙ্গেও গড়ে ওঠে আমার রাজনৈতিক ও সামাজিক সম্পর্ক। দুঃসহ নিদারুণ আহাজারি ছড়িয়ে ১২ জানুয়ারি গভীর রাতে তিনি অনন্তলোকে যাত্রা করেছেন। রবীন্দ্রনাথ সরেনই সম্ভবত বাংলাদেশে দলমত-বয়স-জাতি-জেন্ডার ও অঞ্চল নির্বিশেষে সর্বাধিক পরিচিত ও জনপ্রিয় আদিবাসী নেতা।
রবীন্দ্রনাথ সরেনের জন্ম ১৯৫৭ সালের ১৩ ডিসেম্বর। দিনাজপুরের পার্বতীপুর উপজেলার বারকোনা গ্রামে। মায়ের নাম সুমি টুডু ও বাবা দারকাল সরেন। দারকাল সরেনের পরিবারে পড়াশোনার চল ছিল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামে তাই নাম রাখা হয় তার । শৈশবেই তিনি জড়িয়ে পড়েন অধিকার আন্দোলনে। তরুণ বয়সে দীর্ঘদিন চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোলে ছিলেন। একটা বেসরকারি সংস্থায় কাজ নিয়েছিলেন। কাজ সেরে নিজামপুর থেকে ফতেপুর ঘুরেছেন এবং তেভাগা আন্দোলনের বিপ্লবী ও প্রাক্তন নেতাদের খুঁজে বের করেন। রবীন সরেনের সম্পাদনায় আদিবাসী পরিষদের সাময়িকী ‘উলগুলান’ প্রকাশের পর কলকাতা থেকে ইলা মিত্র সেই সংখ্যাগুলো পুনঃপ্রকাশ করেন। ইলা মিত্র যখন তেভাগার পঞ্চাশ বছর পূর্তিতে নাচোল এসেছিলেন, সেই বিশাল জনসভা আয়োজনে ভূমিকা রাখেন রবীন সরেন। আদিবাসী মানুষের অধিকার সুরক্ষায় বহু আন্দোলন-সংগ্রামের নেতৃত্ব দিয়েছেন। ফুলবাড়ী উন্মুক্ত কয়লা-খনি-বিরোধী আন্দোলন, ভূমি আন্দোলন, সাহেবগঞ্জ-বাগদাফার্ম আন্দোলন, আদিবাসী মাতৃভাষায় শিক্ষা আন্দোলন থেকে শুরু করে আত্মপরিচয় ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা ছিলেন রবীন সরেন।
রবীন্দ্রনাথ সরেন সর্বদা সময়ের চেয়ে এগিয়ে ছিলেন। আদিবাসী পরিষদের ৯ দফা দাবি একত্র করতে তিনি সমতলের আদিবাসী মানুষের কাছে গেছেন। সংগঠনের কাজে সব জাতিসত্তার সম্মানজনক অংশগ্রহণ এবং নারী ও যুব নেতৃত্ব বিকাশে কাজ করেছেন। তারই অনুপ্রেরণায় গঠিত হয় আদিবাসী যুব ফোরাম, আদিবাসী নারী সংগঠন, সাংস্কৃতিক পরিষদ এবং গানের দল মাদল। বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামসহ জাতীয় সংগঠন, নীতিনির্ধারণ, বিদ্যায়তন, গবেষণাসহ বহু গবেষণা ও নাগরিক তৎপরতায় সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে ছিলেন তিনি। দিনাজপুরের বারকোনা বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তার শিক্ষাজীবন শুরু হয়। পার্বতীপুরের হাবড়া উচ্চ বিদ্যালয় এবং পরে দিনাজপুর সংগীত মহাবিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। রাজশাহী শাহ মখদুম কলেজ থেকে ডিগ্রি পাস করেন এবং রাজশাহী আইন কলেজে পড়াশোনা করেন। বহু আদিবাসী ও দলিত শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবন পূর্ণ করতে তার অবদান গুরুত্বপূর্ণ। ওঁরাওদের ঐতিহ্যবাহী কারাম ও সাঁওতালদের বাহা পর্ব জাতীয়ভাবে আয়োজনে তিনি আজীবন কাজ করেছেন। স্থানীয়, জাতীয় ও বৈশ্বিক অধিকার সুরক্ষায় সর্বদা অগ্রণী এই গণবিপ্লবীর শূন্যতা জানি জেগে থাকবে নতুন প্রজন্মের সাহসী উচ্চারণে। রবীন্দ্রনাথ সরেন আমাদের ভেতর সেই সাহস ও শক্তি জাগিয়ে গেছেন, আপনাকে জোহার।