সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়
প্রকাশ : ০৮ জানুয়ারি ২০২৪ ১০:১০ এএম
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের
৩২তম প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট সংক্ষেপে পরিচিত ছিলেন এফডিআর নামে। বিংশ
শতাব্দীর মধ্যভাগে বিশ্ব যখন অর্থনৈতিক মন্দা ও যুদ্ধের কবলে পড়ে বিধ্বস্ত, এমন সময়
তিনি বিশ্বের এক কেন্দ্রীয় চরিত্রে পরিণত হন। একজন ব্যক্তি মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে
দুবার দায়িত্ব পালন করতে পারেন। তবে এর ব্যতিক্রম ঘটিয়েছিলেন ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট।
যুক্তরাষ্ট্রের তিনিই একমাত্র প্রেসিডেন্ট, যিনি তিনবার এ দায়িত্ব পালন করেন এবং চতুর্থবারের
জন্য মনোনীতও হয়েছিলেন। তবে শারীরিক অবস্থা তার পক্ষে ছিল না। রুজভেল্ট আজ এ সম্পাদকীয়র
বিষয় নন, তার একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্যের সূত্রে আজ প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এর এ সম্পাদকীয়।
যেকোনো জাতির কাছে তরুণদের নিয়ে স্বপ্ন দেখার প্রবণতা নয়, বরং বলা ভালো অপরিহার্য প্রাসঙ্গিকতা
রয়েছে। রুজভেল্ট সেই কবে বলেছিলেন, ‘আমরা সব সময় তরুণ সমাজের ভবিষ্যৎ তৈরি করে দিতে
পারব না। তবে তাদের তারুণ্যকে ভবিষ্যতের জন্য তৈরি করে দিতে পারি।’ আজকের বাস্তবতায়
বিশেষ করে আমাদের সমাজে যখন আমরা দেখি চারদিকে অবক্ষয় আর কদাচারের প্রলম্বিত ছায়া ও
জাতির ভবিষ্যৎ তরুণদের নিয়ে রাজনীতিকদের একাংশের অপতৎপরতা; তখন রুজভেল্টের মন্তব্যটি
আরও বেশি উপজীব্য হয়ে ওঠে। আর বিশ্বখ্যাত স্প্যানিশ চিত্রশিল্পী পাবলো রুইজ ই পিকাসোর
মন্তব্যও এ ক্ষেত্রে আরও প্রাসঙ্গিক মনে হয়। তিনি বলেছেন, ‘তারুণ্যের কোনো বয়স নেই।’
তারুণ্যের জয়,
এগিয়ে যাওয়া কিংবা রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থার অনুষঙ্গ হয়ে ওঠার প্রেক্ষাপট তৈরির সবচেয়ে
বড় ময়দান রাজনীতি। উদার রাজনৈতিক পরিবেশ তারুণ্যের জয় নিশ্চিত করার পাশাপাশি অধিকতর
বিকশিত হওয়ার পথ বাতলায়, যা রাষ্ট্র ও সমাজের জন্য হয় হিতকর। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে
নতুন ভোটার কিংবা তরুণদের ভোটদানে আগ্রহ-উপস্থিতির যে চিত্র সংবাদমাধ্যমে উঠে এসেছে
তা বিদ্যমান রাজনৈতিক সংকটে আশার আলো ছড়িয়েছে। ইতঃপূর্বে সংবাদমাধ্যমেই উঠে এসেছিল,
প্রথমবার ভোট দেবেন এমন নবীনের সংখ্যা প্রায় দেড় কোটি। তারাই এ নির্বাচনের ফলাফল নির্ধারণে
মুখ্য ভূমিকা রাখবেন। তরুণদের ভোটকেন্দ্রে যেতে ব্যাপক আগ্রহ লক্ষ করা যাচ্ছে, তাও
সংবাদমাধ্যমেই বলা হয়েছিল। বস্তুত তা-ই দেখা গেল গতকাল শনিবার অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয়
সংসদ নির্বাচনে। তরুণরা আগ্রহ নিয়ে এ নির্বাচনে ভোট দিয়েছেন এবং তাদের অনেকেই প্রথমবার
ভোটদানের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে ভবিষ্যতে রাজনৈতিক ও সামাজিক কলুষতামুক্ত বাংলাদেশ
দেখার কথা জানিয়েছেন। তাদের এ প্রত্যাশার প্রতি আমাদের জোরালো সমর্থন তো আছেই, একই
সঙ্গে আমরা তাদের অভিনন্দন জানাই শুভপ্রত্যাশার জন্য। আশা করব, রাজনীতির নীতিনির্ধারকরা
তরুণদের মনের কথা বুঝতে সক্ষমতার পরিচয় দেবেন এবং গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতির বিকাশে
নিজেরা অধিকতর অনুশীলনের মধ্য দিয়ে কদাচারের পথ রুদ্ধ করে পরবর্তী ধাপের অংশীজনের পরিশীলিত
হওয়ার সব প্রতিবন্ধকতা দূরীকরণে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ থাকবেন।
নিকট অতীতে সংবাদমাধ্যমেই
আরও বলা হয়, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট দেওয়ার ইচ্ছার কথা জানিয়েছেন দেশের ৭২
শতাংশ তরুণ-তরুণী। বাংলাদেশ ইয়ুথ লিডারশিপ সেন্টার (বিওয়াইএলসি) এবং ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির
সেন্টার ফর পিস অ্যান্ড জাস্টিস (সিপিজে) পরিচালিত জরিপে অংশ নিয়ে তারা এ ইচ্ছার কথা
ব্যক্ত করেন। জরিপে অংশ নেওয়া ৬২ শতাংশ তরুণ-তরুণীর মতে, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি তাদের
মানসিক-শারীরিক স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। ৪৪ দশমিক ৭ শতাংশ মনে করেন, বাংলাদেশ শান্তিপূর্ণ
দেশ; অন্যদিকে ৬৩ শতাংশের মতে, গত পাঁচ বছরে দেশ শান্তির দিকে এগোয়নি। তাদের এ উপলব্ধি
উপেক্ষার অবকাশ নেই। ‘গত পাঁচ বছরে দেশ শান্তির দিকে এগোয়নি’ তাদের এ উপলব্ধির উৎকট
প্রকাশ আমরা বলতে গেলে বিদায়ি বছর জুড়েই প্রত্যক্ষ করেছি। বিশেষ করে নির্বাচন কেন্দ্র
করে রাজনৈতিক সংকট বছরের অন্তিমে তো বটেই, নতুন বছরের শুরুতেও সহিংসতানির্ভর কর্মসূচি
জনমনে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার পাশাপাশি এ প্রশ্নও দাঁড় করায়Ñ আমাদের রাজনীতির মহত্তম অর্জনগুলো
কি হারিয়ে যেতেই থাকবে? ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের সড়ক ধরে মুক্তিযুদ্ধের
মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশেও বিশেষ করে নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থান, মানবতাবিরোধী ও যুদ্ধাপরাধের
দায়ে অভিযুক্তদের বিচার ও দণ্ড কার্যকরে গণজাগরণে তরুণদের ভূমিকা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
তরুণ প্রজন্মের
প্রতিনিধিদের বৃহদাংশ অভূত সম্ভাবনার দেশ বাংলাদেশকে একটি প্রকৃত গণতান্ত্রিক ও বিশ্বদরবারে
গর্ব করার মতো শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে দেখার প্রত্যাশা করে। এজন্য সর্বপ্রথম জাতীয়
সব কার্যক্রমে স্বচ্ছতা-জবাবদিহি-দায়বদ্ধতা নিশ্চিত হওয়া উচিত। অনস্বীকার্য, আওয়ামী
লীগ নেতৃত্বাধীন ধারাবাহিক তিন মেয়াদের সরকারের শাসনামলে উন্নয়ন-অগ্রগতির অনেক নজিরই
দৃশ্যমান। নির্বাচনের যে ফলাফল পাওয়া যাচ্ছে তাতে প্রতীয়মান হচ্ছে টানা চতুর্থবারের
মতো সরকারের গঠন করতে যাচ্ছে আওয়ামী লীগ। আমরা মনে করি, সাফল্যে তুষ্ট না থেকে নতুন
সরকারকে অনিয়ম-দুর্নীতির মূলোৎপাটনসহ দায়বদ্ধ রাজনীতি নিশ্চিত করা উচিত এবং এ ক্ষেত্রে
দেশ-জাতির ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তরুণদের মনোভাব গুরুত্বের সঙ্গে আমলে রাখা বাঞ্ছনীয়। যুগোপযোগী
শিক্ষার বিকাশ, অধিকারের সাম্য, তরুণদের কর্মসম্পৃক্ত করার নিশ্চয়তাবিধানসহ সৃজনশীলতার
প্রতিফলন ঘটিয়ে পুরোপুরি জনকল্যাণমুখী রাজনীতির আলো ছড়াতে তরুণদের জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা
নিশ্চিত করার দায়ও ভুলে গেলে চলবে না। শিক্ষা, স্বাস্থ্য বা আইনশৃঙ্খলাজনিত সমস্যাগুলোর
বেশিরভাগই স্থানীয় পর্যায়ে। এগুলোসহ সামগ্রিকভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে যে সমস্যা বিদ্যমান
তা নিরসনে রাজনৈতিক অঙ্গীকার ও এর বাস্তবায়নে সরকারের নির্মোহ অবস্থান জরুরি।
অনিয়ম-দুর্নীতিসহ
যা কিছু অকল্যাণকর এসবের নিরসনে অভিযুক্ত কারও প্রতি কোনো অনুকম্পা দেখানো চলবে না।
যে সমাজে তরুণ বেশি থাকে সে সমাজে সম্ভাবনা ও উন্নতির সুযোগও বেশি। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে
এমন নজির আছে অনেক। তবে এজন্য তরুণদের গড়ে তুলতে হবে এবং দুঃখজনক হলেও সত্য, এ ক্ষেত্রে
আমাদের এখনও যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। সর্বনাশা মাদক ও অপরাধের দিকে যদি ঝুঁকে পড়া তরুণের
সংখ্যা বাড়ে তা হবে আত্মঘাতীর শামিল। এ দুইয়ের অপচ্ছায়াই আছে এবং তা জাতির জন্য উদ্বেগের।
তারুণ্য যেন সম্ভাবনার বদলে দুঃস্বপ্ন হয়ে না দাঁড়ায়Ñ এ দায় রাষ্ট্রের। রাষ্ট্র ও রাজনৈতিক
উভয় শক্তিকেই তরুণদের তো বটেই, দেশ-জাতির সার্বিক কল্যাণেও সমভাবে মনোযোগী হতে হবে।