নতুন শিক্ষাক্রম
দেবাশীষ দেবনাথ
প্রকাশ : ০৩ জানুয়ারি ২০২৪ ১০:১৮ এএম
দেবাশীষ দেবনাথ
মানবসভ্যতার উষালগ্ন
থেকে মানবসন্তানকে মানবসম্পদে পরিণত করার জন্য যেসব উপাদান ব্যবহৃত হয়েছে তার মধ্যে
সবচেয়ে শক্তিশালী উপাদানটি হচ্ছে শিক্ষা। শিক্ষার বিকল্প এখনও আবিষ্কার হয়নি তবে শিক্ষাপদ্ধতির
বিকল্পের অভাব নেই। যুগে যুগে নতুন নতুন কারিকুলাম প্রবর্তিত হয়েছে, যুগের চাহিদায়
সেসব কারিকুলামে আবার পরিবর্তনও হয়েছে। হবেই, কারণ এ বিশ্বে কোনো কিছুই চিরস্থায়ী নয়।
দার্শনিক হেরাক্লিটাস তাইতো বলেছিলেন, ‘পরিবর্তনই সব’।
সরকার যেসব মহাপরিকল্পনা
বাস্তবায়নের লক্ষ্য নিয়ে এগোচ্ছে তার অন্যতম নতুন শিক্ষাক্রম। ২০২৩ সাল থেকে বাস্তবায়নকৃত
নতুন প্রবর্তিত এ শিক্ষাক্রম নিয়ে ধোঁয়াশা তৈরির চেষ্টা হচ্ছে, এমনকি বিরোধিতাও হচ্ছে।
কিন্তু একেবারেই সহজভাবে যদি বলি, সরকারের কী এমন দায় পড়েছে বা কী এমন স্বার্থ রয়েছে
যে একটি প্রতিষ্ঠিত শিক্ষাক্রমে পরিবর্তন এনে ঝামেলায় জড়াতে যাবে? সরকার কি ক্ষমতায়
টিকে থাকার জন্য তা করছে? নাকি তাতে সরকারদলীয় কর্মীরাই কেবল লাভবান হবেন, নাকি এ শিক্ষাক্রম
বাস্তবায়ন হলে এ সরকারকে আর কখনও ক্ষমতা থেকে সরানো যাবে না? তাহলে কেন সরকার এ মহাপরিকল্পনা
গ্রহণ করল? নিশ্চয়ই জাতির বৃহত্তর স্বার্থে এ কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। কেবল আবেগতাড়িত
হয়ে নয়, কিংবা কেবলই বিরোধিতার স্বার্থেও নয় বরং যুক্তি খাটিয়ে কথা বলতে হবে। যদি প্রমাণ
করা যায়, বর্তমান প্রণীত শিক্ষাক্রম ভবিষ্যৎ প্রজন্মের পথচলা বাধাগ্রস্ত করবে কিংবা
আমাদের আর্থসামাজিক অগ্রগতিকে পশ্চাদপসরণ করবে, চলতে থাকা উন্নয়নের রোল মডেল থেকে বাংলাদেশ
ছিটকে পড়বে তাহলে সরকার নিশ্চয় এ কারিকুলাম নিয়ে নতুন করে ভাববে।
১৭ কোটি জনঅধ্যুষিত
দেশ বাংলাদেশ, অর্থনৈতিক অবস্থাও ছোট পরিসরের। এমন একটি দেশ তার শিক্ষাব্যবস্থা রাতারাতি
ফিনল্যান্ড কিংবা সুইজারল্যান্ডের পর্যায়ে নিয়ে আসবে তা কল্পনা করা যায়, বাস্তবে নয়!
দেশের সব নাগরিককে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করার চিন্তা যারা করেন আমি তাদের সঙ্গে একমত
নই। বরং উচ্চ শিক্ষা হতে হবে সীমিত, নির্বাচিত এবং অবশ্যই মেধাবীদের জন্য। অন্যদের
বিভিন্ন ধরনের কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে হব এবং সে অনুযায়ী কর্মক্ষেত্রে নিয়োগ
করা যাবে। শিক্ষা ক্ষেত্রে কেবল শিক্ষার্থীদের নিয়ে ভাবলেই চলবে না বরং শিক্ষার সঙ্গে
সংশ্লিষ্ট শিক্ষকদের নিয়েও ভাবতে হবে। পরিতাপের বিষয়, বিশ্বের অন্যান্য দেশে যেখানে
শিক্ষক হওয়ার স্বপ্নে শিক্ষার্থীরা বিভোর, সেখানে আমাদের দেশে শিক্ষকতা ছেড়ে অন্য পেশায়
যাওয়ার জন্যই অনেকে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। কেন? এর কারণ কেউ কি অনুসন্ধান করেন? সত্যিকার
অর্থে যত দিন পর্যন্ত শিক্ষায় মেধাবীদের আনা না যাবে তত দিন পর্যন্ত কোনো পরিবর্তনই
কাজে আসবে না, টেকসই হবে না। এজন্য শিক্ষায় বিনিয়োগ বাড়াতে হবে, শিক্ষকদের মর্যাদা
বাড়াতে হবে, তাদের আর্থিক সক্ষমতা বাড়াতে হবে। তবেই আজকের শিক্ষার্থী আগামী দিনে শিক্ষক
হওয়ার জন্য মনপ্রাণ দিয়ে নিজেকে গড়ে তুলবে। শিক্ষকতা নামক পেশাটিকে ব্রতে পরিণত করতে
না পারলে কোনো পরিবর্তনই কাজে আসবে না।
বর্তমান বিশ্ব
আর আগের মতো জনবিচ্ছিন্ন কোনো গ্রহ নয়; বরং বর্তমান বিশ্বকে গ্লোবাল ভিলেজ বলে আখ্যায়িত
করা হয়। শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য ব্যক্তির অন্তর্নিহিত শক্তি প্রস্ফুটিত করা, ব্যক্তিকে
তার পারিপার্শ্বিক অবস্থার সঙ্গে খাপ খাইয়ে তোলার জন্য প্রস্তুত করা। সবকিছুই পরিবর্তনশীল,
কোনো কিছুই স্থায়ী নয়। এমন পরিবর্তনশীল পরিস্থিতিতে নিজেকে মানিয়ে নেওয়া অন্যভাবে বললে
নিজেকে উপযুক্ত করে তোলার ক্ষেত্রে যুগোপযোগী শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে
কোনো কিছুই যেমন স্থায়ী নয়, তেমন কোনো শিক্ষাক্রমই স্থায়ী নয়। মানবসভ্যতা প্রতিনিয়ত
যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে, মানবসন্তানকেও সেভাবেই গড়ে তুলতে হবে। আর এজন্যই চাই পরিবর্তিত
পরিস্থিতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ শিক্ষাব্যবস্থা, যা করতে চাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ
হাসিনা।
হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ
বাঙালি, বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা, আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
যে সোনার বাংলা গড়তে চেয়েছিলেন সেই সোনার বাংলা গড়ার লক্ষ্য নিয়েই স্মার্ট বাংলাদেশ
বিনির্মাণে এগিয়ে যাচ্ছেন তাঁরই সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০৪১ সালের
মধ্যে বাংলাদেশকে স্মার্ট বাংলাদেশে পরিণত করার লক্ষ্যেই বর্তমান কারিকুলাম। সারা বিশ্ব
এগিয়ে যাচ্ছে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের দিকে, আমাদেরও এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগোতে হবে। না
হলে জাতি হিসেবে আমরা পিছিয়ে পড়ব। এজন্যই প্রয়োজন যুগোপযোগী শিক্ষাক্রম। এ শিক্ষাক্রম
শিক্ষাব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আনবে তাতে সন্দেহ নেই, সন্দেহ হচ্ছে সেসব সন্দেহবাদীকে
নিয়ে, স্বার্থান্বেষীকে নিয়ে যারা নিজের স্বার্থের জন্য দেশের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিতে
কসুর করে না।
অনেকেরই হয়তো
মনে আছে প্রথম যখন এসএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট গ্রেড পয়েন্টের (জিপিএ) ভিত্তিতে নির্ধারণের
সিদ্ধান্ত হলো, দেশজুড়ে কী পরিমাণ সমালোচনাই না হয়েছিল! একবার ভাবুন তো, বর্তমান সময়ে
আপনার কোনো সন্তান কিংবা কোনো আত্মীয়স্বজন যদি উন্নত কোনো দেশে পড়তে চায় তাহলে পুরোনো
পদ্ধতির রেজাল্ট কি বাধা হয়ে দাঁড়াবে না! সরকার যখন নতুন কারিকুলামে হাত দিয়েছে নিশ্চয়
অনেক চিন্তাভাবনা করে, বিচার-বিশ্লেষণ করে, বহির্বিশ্বের কারিকুলাম থেকে অভিজ্ঞতা নিয়েই
এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
সামাজিক পশ্চাৎপদতা, ধর্মীয় কুসংস্কার, কূপমণ্ডূকতা থেকে বেরিয়ে এসে যুগোপযোগী বাংলাদেশ তথা স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে প্রণীত শিক্ষাক্রম নিশ্চিতভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। মান্ধাতা আমলের গৎবাঁধা শিক্ষাক্রম থেকে বেরিয়ে এসে যুগোপযোগী শিক্ষাক্রম প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের যে দূরদর্শী, বাস্তবানুগ, সাহসী সিদ্ধান্ত সরকার গ্রহণ করেছেÑ এর জন্য আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী ও শিক্ষা উপমন্ত্রী মহোদয়ের প্রতি কৃতজ্ঞতা। তাই আসুন বিরোধিতার খাতিরে বিরোধিতা না করে, জুজুর ভয় না দেখিয়ে একটি আনন্দময় শিক্ষাক্রমের মাধ্যমে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পথ চলতে, নিজেকে উপযুক্ত নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে সাহস জোগাই, সহযোগিতা করি। আনন্দময় জীবনমুখী শিক্ষাব্যবস্থায় আমাদের শিক্ষার্থীদের উজ্জীবিত করি।