× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

নির্বাচন ও জননিরাপত্তা

যে সব তিক্ত অভিজ্ঞতা চোখ রাঙায়

ড. নাসির উদ্দিন আহাম্মেদ

প্রকাশ : ০২ জানুয়ারি ২০২৪ ০৯:৫৮ এএম

ড. নাসির উদ্দিন আহাম্মেদ

ড. নাসির উদ্দিন আহাম্মেদ

ছোটবেলা থেকে শুনছি এবং দেখে আসছি নির্বাচন হলো একরকম উৎসব। শহর-বন্দর, গ্রাম-গঞ্জ, হাওর-পাহাড় সর্বত্র নির্বাচন এলে ভিন্ন এক দৃশ্য ধরা পড়ত। বরাদ্দের পর বিশাল তালা, মস্তবড় আম, লম্বা বাঁশের কলম ইত্যাদি প্রতীক ঝোলানো হতো মোড়ে মোড়ে। আর আমরা ছোটরা দলবেঁধে দেখতে যেতাম কোনটা সবচেয়ে বড়। অবাক হয়ে দেখতাম সেই বড় বড় নির্বাচনী প্রতীক। পাড়ায় মাইক নিয়ে কেউ প্রচার করতে এলে তার রিকশার পেছনে কয়েক ডজন ছেলেমেয়ের ছোটাছুটি শুরু হতো। কেউ কেউ মাইকে ফুঁ দিয়ে বা দুয়েকটি কথা বলার সুযোগ পেয়ে নিজেকে ধন্য মনে করত। কারও বাবা, চাচা, মামা যদি ভোটপ্রার্থী হতো তবে তার সন্তান, ভাতিজা, ভাগনে তাদের বন্ধুরাও স্লোগান তুলতÑআমার ভাই তোমার ভাই, অমুক ভাই তমুক ভাই আবার চাচা বনাম ভাতিজা, শ্বশুর বনাম জামাই, মামা বনাম ভাগনের ভোটলড়াই ছিল নির্মল আনন্দের খোরাক। অক্ষরজ্ঞানবিহীন কিংবা স্বল্পশিক্ষিত মুরুব্বিরাও কোন প্রার্থীর ফিল্ড কেমন নিয়ে তর্কবিতর্ক আড্ডায় মধুর সময় পার করতেন। চা-পান, বিড়ি-সিগারেট এসবের বিক্রিবাট্টা বেড়ে যেত; আরও কত কী! এসব আজ কতটুকু স্মৃতি আর কতটুকু বাস্তব বলে বোঝানোর প্রয়োজন নেই।

এরপর যুগের পরিবর্তন হলোস্বাধীনতা এলো, লাল সন্ত্রাস হলো, জঙ্গি পোশাক আর বুটের রাজনীতি হলো, সবুজ ঝান্ডা আর চাঁদতারার উদয় হলো। এভাবে চলতে চলতে একপর্যায়ে নির্বাচন হয়ে গেল নিতান্ত এক পাতানো খেলা।একদা রিকশায় শাড়ি বেঁধে পর্দানশিন নারীদের ভোটে নেওয়ার আকুতি ছিল প্রার্থী এজেন্টদের। এরপর দেখা গেল রিকশায় বাঁধা পর্দা আর ভোটকেন্দ্রের গোপন কক্ষের পর্দা সবই সরে গেল। ভোটারদের কেন্দ্রে যাওয়ার প্রয়োজনও শিথিল হলো। কারণ কেউ কেন্দ্রে না গেলেও ভোট থেমে থাকেনি। ভোট হয়েছে। অনায়াসে ৭০ থেকে ১০০ ভাগ, ক্ষেত্রবিশেষ ১০০ ভাগের বেশি ভোট প্রদানের নজির এ দেশেই তো আছে। ২১৩টি কেন্দ্রে ১০০ ভাগ ভোট প্রদানের মুখরোচক অথচ নির্মম সত্য তথ্য ভাসছে গ্রহণযোগ্য নেট দুনিয়ায়। এসব কেন্দ্রের ভোটার তালিকা হওয়ার পর থেকে নির্বাচন পর্যন্ত সময়ে কারও মৃত্যু ঘটেনি, প্রবাস বা অন্য কোথাও যাওয়া হয়নি, কেউ অসুস্থ হয়নি, চাকরির কারণে দূরের কর্মস্থল ছেড়ে নিজ ভোট এলাকায় আসতে ছুটিজনিত বা আর্থিক সংকট হয়নি কিংবা ভোট প্রদানে কারও কোনো অনীহা জন্মেনি। ওই ২১৩ কেন্দ্রের প্রিসাইডিং অফিসার বা ভোট পরিচালনায় জড়িত অন্য কোনো ব্যক্তি, সংস্থা বা নির্বাচন কমিশনের কারও কোনো বক্তব্য বিষয়ে কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। এক জেনারেল পরে স্বৈরশাসকের বিষয়ে একটি ঘটনা শুনেছিলাম বেশ কিছুদিন আগে। তিনি ভোটের সময় শতভাগ ভোট নিয়ে বিদেশি সাংবাদিকদের কাছ থেকে বিব্রতকর প্রশ্ন শোনার পরিপ্রেক্ষিতে আদেশ দিয়েছিলেনÑ পরের ভোটের সময় কোনো কেন্দ্রে যেন ৭০-৭৫ শতাংশের বেশি ব্যালট পেপারই প্রেরণ না করা হয়। বিশ্বের দরবারে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন প্রমাণ করতে জেনারেল সাহেবের ওই টোটকা বেশ কাজে লেগেছিল।

এমন ভোটের যারা পরিকল্পনাকারী, পৃষ্ঠপোষক, আয়োজক, সহায়ক ও সুবিধাভোগী তাদের প্রথম এবং প্রধান লক্ষ্য থাকে ভোটের আগে ও ভোটের দিন সন্ত্রাস সৃষ্টি। আর বিরোধী পক্ষের লক্ষ্য থাকে সন্ত্রাসের মাধ্যমেই তা প্রতিরোধ। আর ভোট-পূর্ববর্তী ও ভোটের দিনের সন্ত্রাসের চূড়ান্ত রূপ হলো ভোট-পরবর্তী সহিংসতা। বিরোধী দলবিহীন নির্বাচনকে ভোটারবিহীন নির্বাচনের কলঙ্ক থেকে বাঁচাতে একই দল থেকে একাধিক প্রার্থী দাঁড় করানোর ধারণা রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে অভিনব ও কৃতিত্বের দাবিদার। আশঙ্কা একটাই ছিল, বিরোধী দল মাঠে না থাকায় অতীতের মতো বাসে ট্রেনে আগুনসন্ত্রাস হতে পারে। তবে ট্রেনের লাইন গ্যাস কাটার দিয়ে কেটে যাত্রীবাহী ট্রেন লাইনচ্যুত করা তথা একসঙ্গে বহু মানুষ হত্যা করে প্রতিপক্ষের ওপর দায় চাপানোর চিন্তাভাবনা কোনো গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্টে এমনকি মানুষের ধানধারণায়ও আসেনি, তবে বাস্তবে তা-ই ঘটেছে। সবচেয়ে নির্মম সত্য হলো, কমবেশি নির্বাচনী সন্ত্রাসের সঙ্গে পরিচিত হলেও এ জাতি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের দল-উপদল, শাখা-প্রশাখা কিংবা মনোনীত ও স্বতন্ত্র প্রার্থী এবং তাদের সমর্থকদের মধ্যে খুন-জখম, মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে অপহরণচেষ্টা, দলীয় প্রতীক ও দলীয় প্রধানের ছবিবিশিষ্ট পোস্টারে ঢাকা অফিস ও নির্বাচনী ক্যাম্প ভাঙচুর কিংবা দখল ও অগ্নিসংযোগ, অশ্লীল ভাষায় খিস্তিখেউর দেখার জন্য প্রস্তুত ছিল না। ট্রেনের আগুনে পোড়া এক মৃত মায়ের কোলে তার পোড়া ও মৃত শিশুর লেপ্টে থাকা দৃশ্য কল্পনাকেও হার মানায় এবং জাতি হিসেবে আমাদের কি প্রমাণ করে, এর আর ব্যাখ্যার কি কোনো প্রয়োজন রাখে?

প্রশ্ন হলো, কেন এ সন্ত্রাস? এ ছোট্ট প্রশ্নের উত্তর অনেক লম্বা। কারণ এমন সন্ত্রাসের নেপথ্যে কেবল অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিষয়ই নয়, থাকে অর্থনৈতিক, সামাজিক, ব্যক্তিকেন্দ্রিক, মনস্তাত্ত্বিক ও কোনো কোনো ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক বিষয়াদিও। রাজনীতি এখন রাজনীতিবিদদের হাতে নেই। সংসদে সাবেক রাষ্ট্রপতির সাহসী কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছে এবং শত শত এমনকি কয়েক হাজার গুণ সম্পদবৃদ্ধির উপায় বলে দালিলিকভাবে প্রমাণিতও হয়েছে। পৃথিবীর কোনো দেশে কোনো পেশা বা ব্যবসায় এমন সমৃদ্ধির নজির আছে কি না সন্দেহ। তাই এমন সমৃদ্ধির জন্য হোন্ডা, গুন্ডা ও ডান্ডা ব্যবহার করে প্রতিপক্ষকে ঠান্ডা করা কোনো বিষয়ই নয়। আবার যেকোনো উপায়ে অর্থের সংস্থান এবং এ অর্থের উত্তাপ এ দেশের একদল মানুষকে সামাজিক প্রতিপত্তি বৃদ্ধিতে উৎসাহ জোগায়। লোভী চাটুকাররাও জুটে যায় অর্থশালীকে ক্ষমতার সিঁড়িতে পা দিতে উদ্বুদ্ধ করতে। আরও জোটে একদল পথভ্রান্ত সন্ত্রাসী, যারা টাকা পেলে সন্ত্রাস ঘটায়। নেশাগ্রস্ত দরিদ্র শ্রেণির কিছু মানুষ নেশার টাকা জোগাতে গডফাদারদের হাতের পুতুল হয়ে যায়, যাদের দিয়ে সহজে সন্ত্রাস করানো যায়। ব্যক্তিবিশেষের ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব অনেক ক্ষেত্রে মানুষের বিবেক অন্ধ করে দেয়।‌ তখন নিজে ক্ষমতায় যাওয়ার চেয়েও বড় হয়ে দেখা দেয় প্রতিপক্ষের ক্ষমতায় যাওয়ার পথ যেকোনো মূল্যে রোধ করা। সন্ত্রাস তার সোজা মাধ্যম।

দুঃখজনক হলেও সত্য, এ দেশের তরুণ ও যুবকের একটা অংশ নানা কারণে নিজের বীরত্ব দেখাতে মরিয়া হয়ে ওঠে। এমনকি কিশোররাও ‘কিশোর গ্যাং’ তৈরি করে এলাকায় এলাকায় আধিপত্যের বলয় সৃষ্টি করে। নির্বাচনের আগে ক্ষমতালিপ্সু রাজনীতিবিদদের টাকার কাছে বিক্রি হয়ে যায় এ কিশোর গ্যাং, বেকার তরুণ, যুবক ও ভবঘুরের দল। আবার উপযুক্ত পারিবারিক ও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার অভাব এবং শিক্ষালাভের পরও কর্মসংস্থানের অভাব একসময় হতাশায় নিমজ্জিত করে তরুণ-যুব সমাজকে। ভোটের মাঠে নোটের (টাকার) ছড়াছড়ি তাদের ন্যায়-অন্যায়ের বিচার না করে সন্ত্রাসে জড়িয়ে পড়তে উদ্বুদ্ধ করে। এসবই সৃষ্ট রাজনীতির নামে অপরাজনীতির বৈরী পরিস্থিতি থেকে। এর ফলে দেশ-জাতির সামগ্রিক সর্বনাশা ঘটলেও রাজনীতিকদের অনেকেরই এ ব্যাপারে সেই যেন কোনো শিরঃপীড়া!

সন্ত্রাস দমনে তাই প্রয়োজন সুদূরপ্রসারী সার্বিক পরিকল্পনা। পাঁচটি বছর জাতিকে একটি শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত না করে এবং অবৈধ অস্ত্র, মাদক ও কালো টাকার প্রবাহ কার্যকরভাবে রোধ না করে কেবল ভোটের আগে বাগাড়ম্বর, হুমকিধমকি, শোকজ, তলব আর অর্থদণ্ড সন্ত্রাস দমন দূরে থাক, সন্ত্রাসীদের গায়ে একটা টোকাও দিতে পারবে না। সন্ত্রাসীদের দ্রুত ও অনুকরণীয় বিচার সন্ত্রাস রোধের একটি উপায়, যা সমভাবে সবার ওপর প্রয়োগ করা প্রয়োজন। নেতৃত্বের দৃঢ়তায় শুধু নির্বাচন নয়, আমাদের জনজীবনও সন্ত্রাসমুক্ত হোক, এটাই প্রত্যাশা। কোনোভাবেই যেন হোঁচট না খায় খুব স্বাভাবিক এই জনপ্রত্যাশা।

  • অবসরপ্রাপ্ত মেজরনিরাপত্তা-বিশ্লেষক  গবেষক

[email protected]

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা