আওয়ামী লীগের ইশতেহার
অজয় দাশগুপ্ত
প্রকাশ : ০১ জানুয়ারি ২০২৪ ১০:২৯ এএম
অজয় দাশগুপ্ত
বাংলাদেশে নির্বাচন হবে কি না, এ নিয়ে এবার যত সংশয়-বিতর্ক বা আলাপ হয়েছে তা এর আগে এতটা হয়নি। এই আগ্রহ ও বিতর্কের কারণ মূলত দুটি। প্রধানত, আওয়ামী লীগ তথা শেখ হাসিনার ধারাবাহিক শাসনে দেশের উন্নয়ন অগ্রগতি যা বিশ্বের দৃষ্টি কেড়েছে। শেষত, প্রধান বিরোধী দল নামে পরিচিত বিএনপির বাধা প্রদান ও নির্বাচন বর্জন। দেশের চাইতে বিদেশে বড় হয়ে ওঠা ঘটনাবলিতে এটা স্পষ্ট বিএনপি-জামায়াতের লবিং শক্ত। কিন্তু তারা কিছুতেই এঁটে উঠতে পারেনি। যার কারণ ওই উন্নয়ন আর আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার দৃঢ়তা। শেষতক নির্বাচন হতে চলেছে। যেভাবে হোক আর যে কৌশলেই হোক নির্বাচন যে অনেকটাই জমজমাট তা অস্বীকার করা যাবে না।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা
যারা মনে করেন নৌকার জয় বা নৌকার ব্যাপারে আশাবাদ ব্যক্ত করা দালালি তাদের বলি, নৌকার বিরুদ্ধে দাঁড়ানো প্রার্থীরাও প্রকারান্তরে বলছেন তারাই নৌকার আসল প্রার্থী। অন্যদিকে খ্যাতিমান বাম নেতাদের মুখে নৌকার নাম আর নৌকা না পেলে যে আহাজারি তাতেই বোঝা যায় কে জিতবেন। সে কারণে আওয়ামী লীগ যখন তার ইশতেহার প্রকাশ করে আমরা দেশে-বিদেশে পরম আগ্রহে তা পাঠ করি। কারণ এটাই ঘটতে যাচ্ছে আগামীতে। যে পার্থক্যে শেখ হাসিনা অন্যদের চাইতে আলাদা, তা হচ্ছে প্রতিশ্রুতি পূরণ করা। বিগত দিনের শাসকরা কথা রাখেননি এমন ঢালাও অভিযোগ করব না। কিন্তু শেখ হাসিনার মতো প্রায় সব কথা তারা কেউই রাখেননি। রাখতে পারেননি। সুতরাং পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, উড়াল সেতু, কক্সবাজারে রেললাইনের দলের ইশতেহার গুরুত্বপূর্ণ। কী বলছে এবারের আওয়ামী লীগের ইশতেহার?
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ : উন্নয়ন দৃশ্যমান, বাড়বে এবার কর্মসংস্থান’ স্লোগানে ইশতেহার ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগ সরকারের টানা তিন মেয়াদের অর্জন এবং আবারও ক্ষমতায় গেলে দেশের উন্নয়নে তাদের যে কর্মপরিকল্পনা তা তুলে ধরা হয়েছে ইশতেহারে। ২০০৮, ২০১৪ এবং ২০১৮-এর নির্বাচনী ইশতেহারে ঘোষিত দীর্ঘমেয়াদি কর্মপরিকল্পনাগুলোর ধারাবাহিকতা দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনী ইশতেহারেও রক্ষিত হয়েছে। এবারের নির্বাচনী ইশতেহারে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে ১১টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বিশেষ অগ্রাধিকার দিয়েছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। যেমনÑ ১. দ্রব্যমূল্য সকলের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া ২. কর্মোপযোগী শিক্ষা ও যুবকদের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা ৩. আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলা ৪. লাভজনক কৃষির লক্ষ্যে সমন্বিত কৃষিব্যবস্থা, যান্ত্রিকীকরণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণে বিনিয়োগ বৃদ্ধি ৫. দৃশ্যমান অবকাঠামোর সুবিধা নিয়ে এবং বিনিয়োগ বৃদ্ধি করে শিল্পের প্রসার ঘটানো ৬. ব্যাংকসহ আর্থিক খাতে দক্ষতা ও সক্ষমতা বৃদ্ধি করা ৭. নিম্ন আয়ের মানুষদের স্বাস্থ্যসেবা সুলভ করা ৮. সর্বজনীন পেনশনব্যবস্থায় সকলকে যুক্ত করা ৯. আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কার্যকারিতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা ১০. সাম্প্রদায়িকতা এবং সকল ধরনের সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ রোধ করা এবং ১১. সর্বস্তরে গণতান্ত্রিকব্যবস্থা সুরক্ষা ও চর্চার প্রসার ঘটানো। ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের লক্ষ্যেই এই ১১টি বিষয়ে আওয়ামী লীগ তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে বিশেষ অগ্রাধিকার প্রদান করেছে। আর স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে এই ১১টি বিশেষ বিষয়ের প্রতিটির গুরুত্ব অপরিসীম।
প্রতিটি নির্বাচনী ইশতেহারেই জাতির সামনে একটা আশাজাগানিয়া ও অনুপ্রেরণামূলক স্লোগান তুলে ধরে আওয়ামী লীগ। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। ২০০৮ সালের নির্বাচনে ইশতেহারের স্লোগান ছিল ‘দিনবদলের সনদ’। ২০১৪ সালের দশম সংসদ নির্বাচনের ইশতেহারে স্লোগান ছিল ‘এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ’। ২০১৮ সালে ‘সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ’ স্লোগান ছিল ইশতেহারে। ২০১৮ সালের সেই ‘সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ’ ইশতেহারে ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ ও ২১০০ সালের মধ্যে নিরাপদ ব-দ্বীপ গড়ে তোলার পরিকল্পনা দেওয়া হয়েছিল। অতীতের ন্যায় এবারও তরুণ সমাজকে কাজে লাগিয়ে তারুণ্যনির্ভর একটি স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের লক্ষ্যে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করেছে দলটি।
আমাদের এই প্রশান্ত মহাসাগর পারেও এক হাল। লিবারেল দলকে হটিয়ে দেশ শাসনে আসা লেবার দলের অবস্থা ক্রমেই নাজুক হয়ে উঠছে। যার কারণ বাজার। আমাদের দেশে এই বাজার বা দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের প্রথম বাধা সিন্ডিকেট। শোনা যায় মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীসহ বহু বড় মাপের আমলাও নাকি এর সঙ্গে জড়িত। শর্ষের ভেতরে থাকা ভূত কীভাবে সামলাবে সরকারি দল—এ ব্যাখ্যা থাকলে ভালো হতো। মনে রাখা উচিত এবার তারা যে ম্যান্ডেট পাবেন বা পেতে চলেছেন বলে মনে করা হচ্ছে তা গত দুবারের তুলনায় কষ্টার্জিত এবং এর অপব্যবহার হলে সময় ছেড়ে কথা বলবে না। বাকি দফা বা পয়েন্টগুলোর ভেতর ৯ নম্বরে থাকা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কার্যকারিতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করার বিষয়টি অবিলম্বে নজরে আনা প্রয়োজন। মানবাধিকার লঙ্ঘন বা এ জাতীয় কাজগুলো বিদেশিদের চোখে ভয়ংকর অপরাধ। গাজায় কত মানুষ মরল বা সন্ত্রাসীরা কত মানুষ মারল কিংবা কোনো দেশে জঙ্গিরা হামলা করল তারচেয়েও তাদের উদ্বেগ এসব বিষয়ে অধিক। বলাবাহুল্য আমরা তার বাইরে থাকতে পারিনি। সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে যে পয়েন্টটি ১০ নম্বরে আছে আসলেই কি সে বিষয়ে আওয়ামী লীগ সতর্ক? বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সহযাত্রী চার জাতীয় নেতাদের মতো কি আজকের নেতারা হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান, আদিবাসীসহ বাকিদের ব্যাপারে আন্তরিক? নানা কারণে যে আন্তরিকতা ও স্বচ্ছতা প্রশ্নবিদ্ধ তার জবাব কি মিলবে এবার? সাম্প্রদায়িকতা মূলত আওয়ামী লীগের একাংশের হাতিয়ার। এর অপব্যবহার রোধ না হলে জঙ্গীবাদ দমন করা যাবে না। এরপরে দলটি সর্বস্তরে গণতন্ত্রচর্চার ওপর জোর দিয়েছে। আমরাও তা চাই।
বাংলাদেশের জন্ম থেকে অর্জনের দায়িত্ব নেওয়া দল আওয়ামী লীগ। পাতিস্তানপ্রীতি ও পাকিস্তান ভাঙার জন্য নাখোশ যেসব অপশক্তি দেশে আছে তাদের মুখের ওপর জবাব দিতে পারে একমাত্র আওয়ামী লীগ। তাই এবারের ইশতেহারকে আমি গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। একটা বিষয়ের উল্লেখ থাকলে আমার মনে হয় চমৎকার হতো। দেশের বরেণ্য বুদ্ধিজীবী ও বহু অসাধারণ মানুষের সঙ্গে আওয়ামী লীগের যে দূরত্ব তা কমানো উচিত। এতে দল ও দেশ উভয়ের লাভ। সব মিলিয়ে ইশতেহারে যে কথাগুলো বলা হয়েছে বা লেখা আছে তার মাধ্যমে সুখী স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে উঠবে- এটাই সবার চাওয়া।