× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

কঠিন সংকটের মধ্যেই এলো নতুন বছর

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

প্রকাশ : ০১ জানুয়ারি ২০২৪ ০০:৩৪ এএম

আপডেট : ০১ জানুয়ারি ২০২৪ ১১:০০ এএম

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

রাজনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে আমরা ইংরেজি  নতুন বছর ২০২৪ বরণ করতে যাচ্ছি। বিদায়ি বছরটি নানা কারণে স্বস্তির ছিল না। রাজনৈতিক সংকটজনিত অস্বস্তি তো বটেই, মূল্যস্ফীতির কঠিন কশাঘাতসহ নেতিবাচক আরও অনেক কিছুর মধ্য দিয়েই পার করতে হয়েছে গত একটা বছর  এবং এখনও এ সবই জনজীবনের অনুষঙ্গ হয়ে আছে। অনেক ক্ষেত্রেই ঘাটতি দৃশ্যমান সুশাসনের। এ লেখাটি পাঠকের কাছে পৌঁছানোর পরে দেশে ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে বলে ধারণা করা যাচ্ছে। কীভাবে তা হবে, কেমন হবে তার ধরন ও গতিপ্রকৃতি কী রূপ নেবে তা অবশ্য ঘটনার পরই বলা যাবে, আগে নয়। ঘটনার পরে আরও কী কী ঘটবে তা তো বলা যাচ্ছেই না। তবে পূর্বাভাস বলছে, বিগত দুটি নির্বাচনের মতোই এটিও নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল থাকবে। সরকারি দল এবং সে দল যাদের ‘ছাড়’ দেবে তারাই নির্বাচনে জয়ী হয়ে আসবে। সংসদীয় গণতন্ত্রে একটি বিরোধী দল থাকা চাই, না থাকলে চলে না, তাই এবারও সেটা থাকবে, তবে সেটি কোন দল তাও সরকারের পক্ষ থেকেই ঠিক করে দেওয়া হবে। ভোট নিয়ে একটা যুদ্ধ হবে। 

এ যুদ্ধে বিজয় কতটা গ্রহণযোগ্য হবে এবং দেশের ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক সংকট নিরসনে ওই বিজয় কতটা কার্যকর হবে তা নিয়ে চিন্তা করলে দুশ্চিন্তা বাড়ারই শঙ্কা। আপাতত তাকে তাই ছুটি দেওয়া যাক। তবে এটা সত্য হয়ে থাকবে যে, সংসদে নির্বাচিত হওয়ার অর্থ মস্ত বড় একটা সরকারি চাকরি পাওয়া, যে চাকরি ক্ষমতা ও অর্থ উভয় প্রাপ্তির মস্ত মস্ত সুযোগ এনে দেয়। সেজন্যই তো এত প্রার্থী, এত অর্থের আদানপ্রদান। ব্যবসায়ীরা তো আছেনই, থাকবেনও, তাদের লোকেরাও থাকবে; নামকরা ক্রিকেট খেলোয়াড়, অভিনেতা, গায়িকা, সাবেক আমলাÑ সবাই মহা উৎসাহী। কোনো কালে রাজনৈতিক কর্মের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না, ভুলেও জনগণের পাশে গিয়ে দাঁড়াননি, তাতে কী? গরমে বিলের পানি কমেছে, মাছেরা সব খলবল করছে, ধরতে ছুটবেন না, এমন বোকা এরা নন। নির্বাচন এক ধরনের খেলা বটে। 

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আমাদের আশ্বাস দিয়েছিলেন এবারের খেলাটা জমবে ভালো। তবে নির্বাচনী খেলায় তো একটি মাত্র দল থাকলে চলে না। এ খেলা তো অনেকটা ফুটবলের মতো; দুই পক্ষ ছোটাছুটি করবে, কে কতটা গোল করতে পারে তা দিয়েই মীমাংসা। তবে এবার অন্য দল অনুপস্থিত দেখে যারা ভেবেছিলেন প্লেয়ার বুঝি হায়ার করে আনতে হবে, তারা ভুল প্রমাণিত হয়েছেন। বহু প্লেয়ার তোষামোদ, তদবির, কান্নাকাটি করছেন খেলার মাঠে ঢোকার আশায়। টাকাও ঢালছেন। দলের ভেতর থেকে ‘স্বতন্ত্র’ প্রার্থীদের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় উৎসাহিত করা হচ্ছে। এদের আগে ‘বিদ্রোহী’ বলা  হতো; এবং শাস্তি দেওয়া হতো দল থেকে বের করে দিয়ে। এখন বলা হচ্ছে এরা বিদ্রোহী নয়, স্বতন্ত্র বটে। স্বতন্ত্রভাবেই নির্ভয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। ফলে যে-ই জিতুক সরকারি দলই জিতবে। ব্যবস্থাটাকে অভিনব বলা কতটা ঠিক হবে কে জানে।

তবে শুধু বাংলাদেশ বলে নয়, বিশ্বজুড়েই বুর্জোয়া গণতন্ত্র এখন বেশ ভালো রকমের মুশকিলের মধ্যে পড়েছে। এ সংকট পুঁজিবাদেরই সংকট। পুঁজিবাদ এখন তার অন্তিম সময়ে এসে পৌঁছেছে। তাই তো দেখা যাচ্ছে ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো ঘরে-বাইরে নিন্দিত একজন লোকও পুনরায় নির্বাচিত হয়ে আসবে এমন আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। এবং সেটা ঘটতে পারে গণতন্ত্রের তীর্থস্থান বলে স্বীকৃত খোদ যুক্তরাষ্ট্রেই। অন্যত্রও দক্ষিণপন্থিরাই নির্বাচিত হয়ে আসছে। যারা সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখে তারা পিছিয়ে যাচ্ছে। এমনটা ঘটাবার ক্ষমতা পুঁজিবাদ রাখে। পুঁজিবাদের যেটা স্বভাবগত সেটাই সে করে চলেছে। করতলগত অর্থ, কূটকৌশল, গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন হাতিয়ার ব্যবহার করে এবং মানবতাবিদ্বেষী বর্ণবাদ, উগ্রজাতীয়তাবাদ, ধর্মীয় মৌলবাদ ইত্যাদি প্রচারে সামান্যতম বিরতি দিচ্ছে না। 

মানুষের সভ্যতার হাজার হাজার বছর ধরে অর্জিত জ্ঞান ও অর্জনের সমস্তটা নিয়ে একটি খাদের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, সভ্যতা কি বিপজ্জনক যে-পথ ধরে এগোচ্ছে সেই পথ ধরেই এগোবে, এবং খাদের মধ্যে পড়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে; নাকি পথ বদলে, ব্যক্তিমালিকানা পরিত্যাগ করে, সামাজিক মালিকানার দিকে এগিয়ে নিজেকে এবং মানব জাতিকেও বাঁচাবে? বাঁচাবে প্রাণী ও প্রকৃতিও। এককালে এ ধরাধামে ডাইনোসর নামে বিরাটাকার এক প্রাণী ছিল; তারা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে; মানবপ্রজাতিও কি সেভাবে ধ্বংস হয়ে যাবে? এবং সেই ধ্বংসের জন্য অন্য কেউ নয়, দায়ী হবে সে নিজেই? সমস্ত কিছুই তো ভেঙেচুরে যাচ্ছে। মানবিক সম্পর্কগুলা আর মানবিক থাকছে না। সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো তো আমাদের আশার আলো দেখায় না। তা ছাড়া এগুলো তো নমুনা মাত্র। এদের তুলনায়ও কত কত ভয়ংকর সব ঘটনা যে প্রতিনিয়ত ঘটছে যার খবর আমরা রাখি না; এবং না-রাখাটাই হয়তো মঙ্গলজনক, মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য।

আমরা আশা করব ভয়ংকর এ ধ্বংসকাণ্ডটি ঘটবে না।

নতুন বছর আসে নতুন আশা নিয়ে। মনে করা হয় দিন বদলাবে। কিন্তু বদলায় না; এবং বদলায় না যে সেই পুরাতন ও একঘেয়ে কাহিনীই নতুন করে বলতে হয়। না বদলাবার কারণ একটি ব্যাধি, যার দ্বারা আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্র আক্রান্ত। ব্যাধিটির নাম পুঁজিবাদ। এ ব্যাধি থেকে মুক্তির জন্য আমাদের চেষ্টার অবধি নেই। রাজনৈতিকভাবে আমরা বারবার চেষ্টা করেছি কিন্তু সফল হইনি।কিন্তু মুক্তি যে আসেনি তা বলবার অপেক্ষা রাখে না। জিনিসপত্রের দাম থেকে শুরু করে জীবনের সব ক্ষেত্রে নিরাপত্তার অভাব পর্যন্ত সর্বত্রই ব্যর্থতার স্মারকচিহ্নগুলো জ্বলজ্বল করছে। সবকিছুই গা-সওয়া হয়ে যায়। তবে মাঝেমধ্যে দুয়েকটি ঘটনা ঘটে যাতে আমরা ধাক্কা খাই, চমকে উঠি, পরস্পরকে বলি যে আমরা তো ভালো নেই, কঠিন বিপদের মধ্যে রয়েছি।

ব্যাধির নিরাময়ে কেবল আইনের পরিধির বিস্তার এবং প্রয়োগের নিশ্চয়তা ও যথার্থতা দিয়ে দূর করা যাবে না, ব্যাধিটি উৎপাটিত করা চাই। পুঁজিবাদের যে গুণ নেই তা নয়, অবশ্যই আছে। সামন্তবাদের তুলনায় সে অবশ্যই উন্নত। ব্যক্তিকে সে স্বীকার করে, মর্যাদাও দিতে চায়, কিন্তু তার যে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা তাতে ব্যক্তিকে যে নিরাপত্তা দেবে সে কাজটি সে করতে পারে না। পুঁজিবাদ ব্যক্তিকে বিচ্ছিন্ন ও আত্মকেন্দ্রিক করে, তাকে ভোগবাদী হতে উৎসাহ দেয়। এর ফলে দুর্বল যাদের অবস্থান সেই ব্যক্তিরা অর্থাৎ দরিদ্র, শিশু ও মেয়েরাÑযাদের হাতে বিত্ত ও ক্ষমতা রয়েছে তাদের দ্বারা প্রতিনিয়ত নিষ্পেষিত হয়। ফিলিস্তিন সঙ্কট নুতন নয় কিন্তু এবার গাজায় যে বর্বরতা ইসরাইল অব্যাহত রেখেছে তাও সাম্রাজ্যবাদীদেরই ছায়ায়।  রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের শেষ কোথায় তাও অজানা ভবিষৎ।  

আমরা স্বাধীনতা ও মুক্তির কথা অহরহ বলি, কিন্তু সব মানুষের মুক্তি তো কিছুতেই আসবে না যদি পুঁজিবাদী ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটিয়ে সেখানে প্রকৃত গণতান্ত্রিক অর্থাৎ সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা না ঘটাই। মুক্তির জন্য আমরা যে সংগ্রাম করিনি তাও নয়, কিন্তু মুক্তির জন্য সমাজব্যবস্থার অত্যাবশ্যক পরিবর্তনের বিষয়টা নিয়ে ভাবতে চাই না।নতুন বছরে নানা জনের নানা প্রত্যাশা থাকে এবং এ নিয়েই শুরু হয় বছরের যাত্রা। আমাদের সামগ্রিক পরিবর্তন নিশ্চয় প্রত্যাশিত কিন্তু স্বীকার করতে হবে, সেটা ব্যবস্থা বদল ভিন্ন হবে না। কেননা ব্যবস্থাটা বদলানো যায়নি, যেজন্য আমরা সুস্থ ও স্বাভাবিক থাকতে পারছি না।

উন্নতি যা ঘটছে তা অল্প কিছু মানুষের, তারাও যে নিরাপদে রয়েছে তা নয়, আর বেশিরভাগ মানুষই কালাতিপাত করছে বিপদের মধ্যে। ব্যক্তিগত চেষ্টায় আমরা এ ব্যবস্থা যে বদলাতে পারব না তাতে তো কোনো সন্দেহই নেই। এমনকি রাজনৈতিক আন্দোলনের মধ্য দিয়েও সেটা অর্জন সম্ভব হচ্ছে না। হবেও না। যা প্রয়োজন তা হলো সমষ্টিগত, ধারাবাহিক এবং সুস্পষ্ট লক্ষ্যাভিসারী রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন। সেটা না করতে পারলে আমরা বাঁচার মতো বাঁচতে পারব না; সবাই আধমরা হয়েই থাকব, এখন যেমনটা রয়েছি।

লেখক : শিক্ষাবিদ, সমাজ বিশ্লেষক। ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়


শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা