× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

আওয়ামী লীগের ইশতেহার

অগ্রগণ্য চ্যালেঞ্জগুলোর প্রতিফলন

ড. রাহমান নাসির উদ্দিন

প্রকাশ : ২৯ ডিসেম্বর ২০২৩ ১৪:৪৯ পিএম

অগ্রগণ্য চ্যালেঞ্জগুলোর প্রতিফলন

নির্বাচনের সঙ্গে নির্বাচনী ইশতেহারও সমান গুরুত্বপূর্ণ এবং জাতীয় নির্বাচনের জন্য অবশ্যই তা গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। বিশেষ করে জনগণের জায়গা থেকে, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জনগণের একটা বোঝাপড়া এবং প্রতিশ্রুতির লিখিত চুক্তি হচ্ছে নির্বাচনের আগে ঘোষিত ইশতেহার। সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দীর সামাজিক চুক্তি মতবাদের তাত্ত্বিক থমাস হব্স, জন লক ও জাঁ জ্যাক রুশোর তত্ত্বানুযায়ী প্রকৃতির রাজ্যে মানুষ যখন অসহায় এবং বিশৃঙ্খল অবস্থায় হাজির হয়, তখন মানুষ সামাজিক চুক্তির মাধ্যমে রাষ্ট্র গঠন করে। এ সামাজিক চুক্তি অনুযায়ী সবাই মিলে একদল মানুষকে এ শর্তে তাদের সার্বভৌম ক্ষমতা হস্তান্তর করে যে, তারা সবার ভালোমন্দের দেখভাল ও জানমালের হেফাজত করবে। এ সামাজিক চুক্তিরই আধুনিক রূপান্তর নির্বাচনী ইশতেহার। তাই বিশ্বের দেশে দেশে নির্বাচনী ইশতেহার নির্বাচনী সংস্কৃতির অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্রে ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান দলের পক্ষ থেকে ক্ষমতায় গেলে তাদের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং বিদেশনীতি কী হবে তা নির্বাচনের আগেই উন্মুক্ত বিতর্কের মাধ্যমে জনগণের সামনে ব্যক্ত করা হয়। যুক্তরাজ্যেও লেবার পার্টি ও কনজারভেটিভ পার্টি নির্বাচনের আগে রাষ্ট্র পরিচালনায় তাদের নীতি কী হবে তার ফিরিস্তি দিয়ে অঙ্গীকার করে। বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তর গণতন্ত্রের দেশ নামে পরিচিত ভারতেও কংগ্রেস, বিজেপি এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দল জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে ইশতেহার ঘোষণা করে। তাই রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনী ইশতেহার যেকোনো জাতীয় নির্বাচনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং নির্বাচিতদের সরকার গঠন করে এর প্রতি লক্ষ রেখে বাস্তবায়ন বাঞ্ছনীয়।

আমাদের দেশেও জাতীয় নির্বাচনের প্রাক্কালে নিয়মিতভাবে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টিসহ অন্য রাজনৈতিক দলগুলো গুরুত্বের সঙ্গে ইশতেহার ঘোষণা করত এবং সেটা জনগণের কাছে একটা বিশেষ আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠত। এখনও করে এবং ইতোমধ্যে নির্বাচনে অংশ নেওয়া আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি করেছে। এবারের নির্বাচনে ৪৪টি নিবন্ধিত দলের মধ্যে ২৭টি অংশ নিচ্ছে। কিন্তু যে কটি দলের কথা বললাম তারা ছাড়া অন্যদের নির্বাচনী ইশতেহার নিয়ে তেমন কারও কোনো আগ্রহ নেই। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ, ইনু) নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করার কথা থাকলেও তারা তা করেছে কি-না জানা নেই। তবে যেহেতু ক্ষমতায় গিয়ে সরকার গঠন করার কোনো সম্ভাবনা এসব দলের নেই, সেহেতু এদের ইশতেহার নিয়ে জনমনে তেমন কোনো আগ্রহও নেই। তা ছাড়া জাতীয় পার্টি, ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ আওয়ামী লীগের ছাতার বাইরে নাকি ভেতরে এ নিয়েও জনমনে আছে নানা প্রশ্ন। আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীক নিয়ে তাদের অনেকে নির্বাচন করছেন সত্য, কিন্তু আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাদের অনেক ক্ষেত্রে স্বতন্ত্র প্রার্থিতার কেন্দ্রীয় বৈধতার ফলে জোটভুক্ত দলগুলোকে ছেড়ে দেওয়া ৩২ আসনও এসব দলের প্রার্থীরা ধরে রাখতে পারবেন কি না এ ব্যাপারে বিস্তর সন্দেহ আছে। এরকম পরিস্থিতিতে এসব দলের স্বতন্ত্র নির্বাচনী ইশতেহার সার্বিক বিবেচনায় সত্যিকার অর্থে তেমন কোনো গুরুত্বও বহন করে না। অন্যদিকে, যেহেতু বিএনপি এবার নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে না, সেহেতু আওয়ামী লীগের ইশতেহার নিয়ে জনমনে এক ধরনের আগ্রহ ছিল। ২৭ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগ তাদের ইশতেহার ঘোষণা করায় তা জনপরিসরে বেশ আগ্রহ এবং আলোচনার জন্ম দিয়েছে। এর আরও একটা অন্যতম কারণ, এবারের নির্বাচনের ফলাফল কী হতে যাচ্ছে তা মোটামুটি সহজেই অনুমেয়। ফলে যেহেতু আওয়ামী লীগেরই নতুন করে সরকার গঠন করার সম্ভাবনা রয়েছে, সেহেতু আওয়ামী লীগ ইশতেহারে কোন কোন বিষয়ে কী কী প্রতিশ্রুতি দেয়, এর প্রতিও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের আগ্রহ খুব স্বাভাবিক কারণেই ছিল। আওয়ামী লীগের ইশতেহার নিয়ে কিছু পর্যবেক্ষণ তুলে ধরছি।

আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে ১১টি বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ‘উন্নত-সমৃদ্ধ স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়ার অঙ্গীকার নিয়ে আওয়ামী লীগ এ ইশতেহার ঘোষণা করে। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের ইশতেহার ছিল ‘দিনবদলের সনদ’। ২০১৪ সালে ছিল ‘এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ’ শিরোনামে নতুন বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার। ২০১৮ সালে শিরোনাম ছিল ‘সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায়’। এবার ‘উন্নত-সমৃদ্ধ স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়ার অঙ্গীকার। ২০২৪ সালের নির্বাচনী ইশতেহারের স্লোগান, ‘স্মার্ট বাংলাদেশ : উন্নয়ন দৃশ্যমান, বাড়বে এবার কর্মসংস্থান’। সার্বিক বিবেচনায় আওয়ামী লীগের ইশতেহারে একটা ধারাবাহিকতা আছে এ কথা বলা যায়। এবারের ইশতেহারে যে ১১টি বিষয় গুরুত্ব দেয়া হয়েছে তা হলো: ১. নিত্যপণ্য সবার ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া ২. কর্মোপযোগী শিক্ষা ও যুবকদের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা ৩. আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলা ৪. লাভজনক কৃষির লক্ষ্যে সমন্বিত কৃষিব্যবস্থা, যান্ত্রিকীকরণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণে বিনিয়োগ বৃদ্ধি ৫. দৃশ্যমান অবকাঠামোর সুবিধা নিয়ে এবং বিনিযোগ বৃদ্ধি করে শিল্পের প্রসার ঘটানো ৬. ব্যাংকসহ আর্থিক খাতে দক্ষতা ও সক্ষমতা বৃদ্ধি করা ৭. নিম্ন আয়ের মানুষের স্বাস্থ্যসেবা সুলভ করা ৮. সর্বজনীন পেনশনব্যবস্থায় সবাইকে যুক্ত করা ৯. আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কার্যকারিতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা ১০. সাম্প্রদায়িকতা এবং সব ধরনের সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ রোধ করা এবং ১১. সর্বস্তরে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সুরক্ষা ও চর্চার প্রসার ঘটানো। সাদা চোখে দেখলে মনে হবে এগুলো মোটামুটি গড়পড়তা এবং মুখস্থ কথাবার্তা; কিন্তু গভীরভাবে দেখলে উপলব্ধি করা যায়, গুরুত্ব আরোপ করা এ ১১টি বিষয়ের মধ্যেই বর্তমান বাংলাদেশে অগ্রগণ্য চ্যালেঞ্জগুলোর একটা চেহারা পাওয়া যায়।

মূল্যস্ফীতির কঠিন কশাঘাতে জনজীবন দীর্ঘদিন ধরে বিপর্যস্ত। এ প্রেক্ষাপটে বিশেষ করে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে না পারার কারণে সাধারণ মানুষের যে ক্রমবর্ধমান ভোগান্তি তা ইশতেহারে স্বীকার করা হয়েছে এবং তা এক নম্বরে গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। সিন্ডিকেটের হোতারা বাজার নিয়ন্ত্রণ করে, তাদের শক্তহাতে দমন করতে হবে। সিন্ডিকেট যেন রাষ্ট্রের চেয়ে শক্তিশালী না হয়ে ওঠে, তা বিবেচনায় রাখা জরুরি। কৃষি, শিল্প, ব্যাংকিং খাত, অবকাঠামো, প্রযুক্তি এবং স্বাস্থ্যসেবায়ও গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে; কিন্তু জরুরি হচ্ছে প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন। জনপরিসরে একটা কথার প্রচলন আছে, ‘রাজনীতিবিদরা প্রতিশ্রুতি দেন, প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করার জন্য’। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে, আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর কন্যা। তাই তার প্রতিশ্রুতি এবং অঙ্গীকার যেন বাজারে প্রচলিত ‘রাজনৈতিক অঙ্গীকার’ না হয়ে ওঠে সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রেখে কাজ করতে হবে। ইশতেহারের ১১ নম্বরে ‘সর্বস্তরে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সুরক্ষা ও চর্চার প্রসার ঘটানো’র কথা বলা হলেও সুশাসন ও দুর্নীতি বিষয়ে আরও স্পষ্ট এবং শক্ত ভাষায় অঙ্গীকার জরুরি ছিল। আমরা স্বীকার করি কিংবা না করি, সমাজে বিদ্যমান এবং ক্রমবর্ধমান দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য অঙ্গীকার আছে বটে কিন্তু দুর্নীতির ছায়া সরেনি। তা ছাড়া ২ নম্বর পয়েন্টে কর্মোপযোগী শিক্ষার কথা বলা হলেও সার্বিক শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে বিস্তারিত কিছু বলা হয়নি। ১১ নম্বর পয়েন্টের মধ্যে প্রাথমিক থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষাদর্শন কী হবে এর ওপর গুরুত্বারোপ জরুরি ছিল। কর্মোপযোগী শিক্ষা হচ্ছে বাজারমুখী। কিন্তু শিক্ষার্থীকে মানবিক, সামাজিক ও দেশপ্রেমী সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার বিষয়টিও শিক্ষার মূল্য উদ্দেশ্য ও দর্শনের অংশ হওয়া জরুরি। এ ছাড়া নারীর ক্ষমতায়ন, শিশু অধিকার, আয়বৈষম্য দূরীকরণ, সামাজিক অসমতা হ্রাস, সম্পদের সুষম বণ্টন, উৎপাদনে উৎপাদকের অংশীদারি নিশ্চিতকরণ, শহর-গ্রাম বৈষম্য দূরীকরণ, সামাজিক-মানবিক সূচক বৃদ্ধিকরণ, মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নতিকরণ প্রভৃতি বিষয়ে আরও স্পষ্ট বক্তব্য ও অঙ্গীকার জরুরি ছিল।

তবে আওয়ামী লীগ সভাপতির সৎ-স্বীকারোক্তিতে আমরা আশাবাদী হতে পারি। তিনি যখন বলেন, ‘সরকার পরিচালনার বিশাল কর্মযজ্ঞে আমাদের কিছু ত্রুটিবিচ্যুতি হওয়া স্বাভাবিক। আর সরকার পরিচালনায় যা কিছু ভুলত্রুটি, তার দায়ভার আমাদের। সাফল্যের কৃতিত্ব আপনাদের। আমাদের ভুলত্রুটিগুলো ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন’, তখন আশার ক্ষেত্র সঙ্গতই বিস্তৃত হয়। ভুল থেকে শিক্ষা নেওয়ার অঙ্গীকার-প্রতিশ্রুতি প্রশংসাযোগ্য। আওয়ামী লীগপ্রধান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘আমরা কথা দিচ্ছি অতীতের ভুলভ্রান্তি থেকে শিক্ষা নিয়ে আপনাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী ভবিষ্যৎ কর্মকাণ্ড পরিচালনা করব। এ ছাড়া আপনাদের রায় নিয়ে ত্রুটিবিচ্যুতি সংশোধন করে জনগণের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালনা করতে চাই।’ অঙ্গীকার-প্রতিশ্রুতি নিশ্চয়ই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যে কোনো কাজের ক্ষেত্রে তো বটেই, রাষ্ট্র পরিচালনায় তা আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তবে নির্বাচনী ইশতেহারে উল্লিখিত অঙ্গীকারের বিষয়গুলো যদি কাগুজে দলিল হয়ে থাকে তবে তা অনভিপ্রেত ও দুঃখজনক, কর্মসূচি বাস্তবায়নের ওপরই নির্ভর করে সফলতা-ব্যর্থতার হিসাবনিকাশ। মোটকথা সুশাসন নিশ্চিত হলে অনেক কিছুর পথই সুগম হবে।


  • নৃবিজ্ঞানী ও অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা