স্মরণ
১৯৯২ সালের কথা। দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় অসহায় এক পরিবারে বাল্যবিবাহের মর্মস্পর্শী বাস্তব চিত্র উঠে আসে। প্রতিবেদনটিতে লেখা হয়, ‘কথাবার্তায় বোঝা গেল : এই বাল্যবিবাহের বিষয়টি তাদের কাছে অস্বাভাবিক কোনো কিছু নয়। অল্প বয়সে ছেলেমেয়ে বিয়ে দেওয়া যে আইনসিদ্ধ নয়, এই খবরটুকুও জানেন না তারা, কেউ বলেনি। আছিরন জানান, তার দুটি মেয়ে। এরপর ছেলে নেওয়ার আশা ছিল। কিন্তু হলো না। এক দিন পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের এক লোক এসে ফুসলিয়ে নিয়ে গেল তাকে, নগদ টাকা আর শাড়ির লোভ দেখিয়ে ‘অপারেশন’ করল। এখন আর কী করা যাবে! ছেলের আশা বাদ দিতে হয়েছে। জামাই ঘরে এনে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাতে হচ্ছে।’ প্রান্তিক মানুষের জীবনের মর্মস্পর্শী এই খবরটিকেই সাংবাদিক মোনাজাতউদ্দিন জাতীয় সংবাদে রূপ দিয়েছিলেন। শহরকেন্দ্রিক সাংবাদিকতার সময়ে ভিন্নমাত্রিকতা যুক্ত করেন। শুধু প্রান্তিক জীবনের সুখ-দুঃখ-অপ্রাপ্তির গাথাই নয়, দুর্যোগ কিংবা অস্থিতিশীল পরিস্থিতিÑ খবরের পেছনে ছোটা তার পেশাগত জীবনে কোনো দিন থামেনি। দূরে কোথাও বাঁধ ভেঙেছে অমনি ছুটলেন খবরের খোঁজে। ক্ষেতে ফসল নেই, অভাত সর্বত্র, কোথাও নদীর বাঁধ ভেঙেছেÑ এসব খবরের সন্ধানে ঘুরে বেড়িয়েছেন গ্রামের পর গ্রাম। নিজের চোখে দেখে যাচাই-বাছাই করেছেন নির্ভুল তথ্য।
মোনাজাতউদ্দিনের
জন্ম ১৯৪৫ সালের ১৮ জানুয়ারি রংপুর শহরের কোতোয়ালিপাড়ায়। ছোটবেলা থেকেই সাংবাদিকতায়
যুক্ত হওয়ার ইচ্ছে পোষণ করতেন। সেজন্য নিজেকে লেখালেখির চর্চায়ও নিযুক্ত করেন। ষাটের
দশকে বগুড়া থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘বগুড়া বুলেটিন’-এর মাধ্যমে সাংবাদিকতা
জগতে প্রবেশ করেন। পরে ১৯৬২ সালে যোগ দেন দৈনিক আজাদ পত্রিকায়। স্বাধীনতার পর নিজ উদ্যোগে
‘দৈনিক রংপুর’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন। ১৯৭৬ সালে দৈনিক সংবাদের উত্তরাঞ্চলীয়
প্রতিনিধি হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন। পরে তিনি দৈনিক জনকণ্ঠে সিনিয়র স্টাফ রিপোর্টারের
দায়িত্ব পান এবং আমৃত্যু ওখানেই তিনি যুক্ত ছিলেন। বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার জন্য তিনি
ফিলিপস পুরস্কার, জহুর হোসেন স্বর্ণপদকসহ অনেক পদক ও পুরস্কার পেয়েছেন। তার বইয়ের মধ্যে
উল্লেখযোগ্য পথ থেকে পথে, কান সোনার মুখ, পায়রাবন্দের শেকড় সংবাদ, অনুসন্ধানী প্রতিবেদন,
ছোট ছোট গল্প, শাহ আলম ও মুজিবের জীবনী, চিলমারীর একযুগ অন্যতম।
মোনাজাতউদ্দিন
একজন ব্যতিক্রমী সাংবাদিক। ভালো সাংবাদিক হতে হলে শহরকেন্দ্রিক হতে হবে এই ধারণায় তিনি
বিশ্বাসী ছিলেন না। রংপুরের প্রত্যন্ত জনপদে ঘুরেফিরে লিখেছেন অসংখ্য অনুসন্ধানী প্রতিবেদন।
সংকট-সমস্যার আড়ালে লুকিয়ে থাকা নাড়িনক্ষত্রের খোঁজ দিয়েছেন তার সৃজনশীল লেখনীর মাধ্যমে।
মোনাজাতউদ্দিনের প্রতিবেদন মানেই পাঠকের জন্য বিশেষ আকর্ষণ। আজীবন নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব
পালন করেছেন। সত্য প্রকাশে কোনো দ্বিধাবোধ তাকে টলাতে পারেনি। ১৯৯৫ সালের ২৯ ডিসেম্বর
সংবাদের নেশায় পথ থেকে পথে ছুটতে ছুটতে মোনাজাতউদ্দিন গিয়েছিলেন গাইবান্ধার ফুলছড়ির
যমুনা নদীর ধারে কালাসোনার ড্রেজিং পয়েন্টে। ফেরিতে নদী পারাপারের সময় প্রতিবেদনের
জন্য ছবি তুলতে গিয়ে পা পিছলে পড়ে যান যমুনায়। আদ্যন্ত সংবাদের খোঁজে ছুটে বেড়ানো মানুষটি
নিজেই হয়ে গেলেন সংবাদমাধ্যমের সংবাদ। চারণ সাংবাদিক মোনাজাতউদ্দিনকে জানাই বিনম্র
শ্রদ্ধা।