সম্পাদকীয়
সম্পাদক
প্রকাশ : ২৬ ডিসেম্বর ২০২৩ ১০:০৯ এএম
জনসংখ্যা বাড়ছে, ফলে নিত্যনতুন বাসস্থান গড়ার প্রয়োজন দেখা দিচ্ছে।
নগরায়ণ হচ্ছে, সম্প্রসারিত হচ্ছে শহর। শিল্পায়নের তাগিদে স্থাপিত হচ্ছে নতুন নতুন শিল্প-কারখানা।
এর প্রতিটির পেছনেই জমি প্রয়োজন। আর সে চাহিদার জোগান দিতে হাত পড়ছে কৃষিজমিতে। ফলে
দিন দিন কমছে কৃষিজমি। এর বাইরেও নানাভাবে খড়গ পড়ছে কৃষিজমিতে। আমাদের কারোরই অজানা
নয়, কৃষিজমি নষ্ট করা অবৈধ। নদীর পাড় কাটা অবৈধ। কৃষিজমি সংরক্ষণে আইনও আছে। তারপরও
অবৈধ এ কাজটি হরহামেশাই হচ্ছে। না জেনে, না বুঝে নয় বরং সচেতনভাবেই হচ্ছে। অবৈধ জেনেও
টাকার জন্য বিক্রি হচ্ছে চাষের জমির মাটি। অবৈধ জেনেও নদীর পাড় কেটে মাটি নেওয়া হচ্ছে।
২৫ ডিসেম্বর প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এ প্রকাশিত ‘মাটি কেটে ফসলি জমির সর্বনাশ’ শীর্ষক
সরেজমিন প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, ফরিদপুরের সদরপুর উপজেলার ঢেউখালী ইউনিয়নের হাওলাদারকান্দি
গ্রামের আড়িয়াল খাঁ নদের তীরে চলছে ফসলি জমির মাটি কাটার ধুম। প্রশাসনের চোখ ফাঁকি
দিয়ে এক্সকাভেটর দিয়ে কৃষিজমি ৩০-৪০ ফুট গভীর করে কেটে মাটি বিক্রি হচ্ছে। অবৈধভাবে
এই মাটি কাটার সঙ্গে জড়িয়ে আছেন স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিরা। স্থানীয় কৃষকদের অভিযোগ,
সন্ধ্যা ৭টা থেকে সকাল ৬টা পর্যন্ত কয়েকশ গাড়ি বালু-মাটি কেটে বিক্রি করছেন তারা। এতে
ঝুঁকির মুখে পড়েছে আশপাশের সাধারণ কৃষকদের জমি, ভেঙে যাচ্ছে তাদের জমির আল। মাটি বহনকারী
যান চলাচলেও ক্ষতি হচ্ছে ফসলের।
প্রতিদিনের বাংলাদেশের প্রতিবেদনে প্রকাশ, মাটি কেটে বিক্রি করায়
মুখ্য ভূমিকা রাখছেন ঢেউখালী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) ৯ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য স্নেহ হাওলাদার।
অভিযোগের বিষয়ে তিনি প্রতিবেদককে বলেছেন, ‘জমির মালিক আমি নিজেই। আমার জমি থেকেই মাটি
কেটে বিক্রি করছি।’ সাধারণেও যেখানে জানেন, ব্যক্তিমালিকানাধীন জমির মাটি কাটারও নিয়ম
আছে। ব্যক্তিগত প্রয়োজনে কৃষি বা ভিটে জমির মাটি কাটাতেও অনুমতি প্রয়োজন আছে। আর মাটি
কেটে কৃষিজমির শ্রেণি পরিবর্তন করা তো আইনত অপরাধ। অথচ এই ইউপি সদস্য তা জানেন না বা
মানেন না। তাই সাধারণ কৃষকদের মৃদু প্রতিবাদে যে জমির এ সর্বনাশ ঠেকানো যাবে না, তা
বলাই বাহুল্য। এ অবস্থাটি শুধু ফরিদপুরের সদরপুর উপজেলার ঢেউখালী ইউনিয়নের হাওলাদারকান্দি
গ্রামের আড়িয়াল খাঁ নদের তীরেরই না, এমনটি ঘটছে দেশের বিভিন্ন স্থানে।
চাষের জমির মাটি এভাবে তোলায় মাটির সঙ্গে জমিতে থাকা গাছের প্রয়োজনীয়
খাবারও চলে যায়। ফলে খাদ্যাভাবে এ ধরনের জমিতে পরবর্তী সময়ে ফসল ভালো হয় না। এ বিষয়ে
কৃষিবিদদের অভিমত উদ্ধৃত করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘জমির উপরিভাগের চার থেকে ছয় ইঞ্চি
গভীরের মাটিতেই থাকে মূল পুষ্টিগুণ। মাটির এই স্তর কেটে নিলে জমির উর্বরতা নষ্ট হয়।
তখন অতিরিক্ত সার প্রয়োগেও পাওয়া যায় না কাঙ্ক্ষিত ফলন। কৃষিজমির এই স্তর স্বাভাবিক
হতেও প্রায় ১০-১২ বছর সময় লাগে। আবার নদীর পাড় কাটায় পাড়ের নরম মাটি ধসে তৈরি হয় নদীভাঙনের
আশঙ্কা। নদীর গতিপথ পরিবর্তনেরও আশঙ্কা থাকে। নদীর পাড় ঘিরে গড়ে ওঠা কীটপতঙ্গ, জীবজন্তু
ও পাখির বাসস্থানও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যা প্রভাব ফেলে বাস্তুতন্ত্রে।
জীবনের প্রধান তিনটি উপাদানÑ অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান। এ তিনেরই উৎপত্তি-সংযোগ মাটিতে। মাটি প্রকৃতির অমূল্য সম্পদ। মাটি তৈরি হতেও সময় লাগে বহু বছর। ভূতত্ত্ববিদদের মতে, পাথর ভেঙে বিভিন্ন ভৌত, রাসায়নিক আর জৈবিক পরিবর্তনের মাধ্যমে তিন সেন্টিমিটার পুরু মাটির স্তর হতে সময় লাগে প্রায় হাজার বছর। অথচ প্রকৃতি ও পরিবেশের ক্ষতি করে সেই মাটি কেটে বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে। অবৈজ্ঞানিকভাবে মাটি কেটে জমির ক্ষতি এবং পরিবেশ ধ্বংসের এই অপপ্রক্রিয়া থামাতে হবে। নদীর পাড় কাটা বন্ধ করতে হবে। অন্যথায় ভূমিক্ষয় রোধ করা যাবে না, নদীভাঙন প্রতিরোধ করা যাবে না। এক্ষেত্রে ভবিষ্যতের সর্বনাশ ঠেকাতে সাধারণ মানুষের সহযোগিতায় সরকারকে কঠোর হতে হবে। শুধু আইন প্রণয়ন করেই নয়, আইনের যথাযথ প্রয়োগ ও বাস্তবায়নের বিষয়েও গুরুত্ব দিতে হবে। আমরা মনে করি, কৃষিজমি রক্ষায় প্রয়োজন দীর্ঘস্থায়ী পরিকল্পনা এবং সে অনুযায়ী কাজ। তবে ফসলি জমির সর্বনাশ ঠেকানো সম্ভব।