× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

রাশিয়া-যুক্তরাষ্ট্র বিতর্ক

‘আরব বসন্ত’ ও বাংলাদেশের নির্বাচন রাজনীতি

ড. ফরিদুল আলম

প্রকাশ : ২৪ ডিসেম্বর ২০২৩ ১০:৩৪ এএম

ড. ফরিদুল আলম

ড. ফরিদুল আলম

১৫ ডিসেম্বর রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভা এক প্রেস ব্রিফিংয়ে জানিয়েছেন, ৭ জানুয়ারি বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনের ফলাফল যুক্তরাষ্ট্রের জন্য আশানুরূপ না হলে আরব বসন্তের মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হতে পারে। বিষয়টি নিয়ে ১৯ ডিসেম্বর মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের নিয়মিত প্রেস ব্রিফিংয়ের সময় প্রশ্ন করা হয় মুখপাত্র ম্যাথু মিলারকে। সুষ্পষ্টভাবে কোনো কথা না বললেও তিনি তার দেশের সরকারের তরফ থেকে বাংলাদেশে অবাধ, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের বিষয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করেন। রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রেস ব্রিফিংয়ে নির্দিষ্ট করে আরও বলা হয়, সামনের সপ্তাহগুলোয় বাংলাদেশ সরকারের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে আরও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হতে পারে এবং নির্বাচনের পর এটি ব্যাপক মাত্রায় বৃদ্ধি পেতে পারে। আরও জানানো হয়, বাংলাদেশের শিল্প খাতের গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলোর ওপর আঘাত এবং নির্বাচনে সরকারের পক্ষ থেকে বাধাদান বা শক্তিপ্রয়োগের মতো তথ্যপ্রমাণহীন অভিযোগ আসতে পারে। এর কোনোটির বিষয়েই যুক্তরাষ্ট্রের তরফে সুস্পষ্টভাবে কোনো নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া জানানো হয়নি। আমরা সাম্প্রতিক সময়ে দেখতে পাচ্ছি যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে এ ধরনের প্রেস ব্রিফিংয়ে এক ধরনের কোটারিভুক্ত সাংবাদিকের উপস্থিতিতে বাংলাদেশ নিয়ে উদ্বেগ এবং এর প্রতিক্রিয়ায় পাল্টা উদ্বেগজনক প্রশ্ন করা হচ্ছে। বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমের বা বাংলাদেশ নিয়ে সত্যিকার অর্থে ধারণা রাখেন এমন সাংবাদিককে সেখানে উপস্থিত থাকতে দেখা যায় না, বরং বিষয়টিকে সে দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে এক ধরনের সাজানো নাটক হিসেবেই মনে হয়। তবে সর্বশেষ সংবাদ ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ম্যাথু মিলার খুব একটা প্রস্তুত ছিলেন বলে মনে হয়নি।

রাশিয়ার মুখপাত্রের সংবাদ ব্রিফিংটি যে অনেকটা তথ্যপ্রমাণের ওপর ভিত্তি করে দেওয়া হয়েছে, এর প্রমাণ পাওয়া যায় এর কদিনের মধ্যেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আটজন কংগ্রেসম্যানের পক্ষ থেকে দেশটির অ্যাপারেলস অ্যান্ড ফুটওয়্যার অ্যাসোসিয়েশনকে (এএফএ) দেওয়া এক চিঠিতে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতের সর্বনিম্ন মজুরির বিষয়ে তাদের দৃষ্টি আকর্ষণে চিঠিতে জানানো হয়, বাংলাদেশের শ্রমিকদের দাবি করা সর্বনিম্ন মজুরি ২৩ হাজার টাকা না মানা কেবল দুঃখজনক নয়, লজ্জাজনকও বটে। বলা প্রাসঙ্গিক, সাম্প্রতিক বছরগুলোয় মাঠের প্রধান বিরোধী দলের পক্ষ থেকে যেভাবে যুক্তরাষ্ট্রে লবিস্ট নিয়োগের মধ্য দিয়ে একের পর এক কংগ্রেসম্যানের মাধ্যমে চাপ প্রয়োগের কৌশল অবলম্বন করা হয়ে আসছিল; এর সঙ্গে এ দেশের সুশীলসমাজের কিছু ব্যক্তির প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদে এবং যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের ব্যক্তিগত হস্তক্ষেপে বিষয়টি এমন পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, যার ফলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে এক ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এর সঙ্গে এও যুক্ত করা প্রাসঙ্গিক যে, সম্প্রতি পোশাক শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির আন্দোলন যে নিছক নিজেদের তাগিদ থেকে করা হয়েছে সেভাবে না দেখে বিষয়টি যে এক ধরনের আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের আলোকে করা হয়েছে এটা আজ অনেকটা পরিষ্কার। দাবির মুখে সরকার যখন ন্যূনতম মজুরি ১২ হাজার ৮০০ থেকে শুরু করে খাতভেদে ১৪ হাজার ২৫ টাকা নির্ধারণ করে ৭ ডিসেম্বর গেজেট প্রকাশ করল, এ ধরনের শান্তিপূর্ণ সমঝোতার বিপরীতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আট কংগ্রেসম্যানের পক্ষ থেকে এএফএকে চিঠি দিয়ে পরিস্থিতি ভিন্ন খাতে প্রবাহের প্রয়াস মনে করা প্রাসঙ্গিক।

বিষয়টি নিয়ে মার্কিন কংগ্রেসম্যানদের পক্ষ থেকে যে ধরনের তৎপরতা দেখানো হয়েছে, এর বিপরীতে সে দেশের এএফএ একে সঙ্গত ভেবে তাদের এ চিঠি আমলে নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করবে তা ভাবার সুযোগ নেই। এখানে তাদের মনে রাখা দরকার ছিল যে, বাংলাদেশের পোশাক শ্রমিকদের মজুরির ওপর এ দেশ থেকে উৎপাদিত পণ্যের বাজারদর সে দেশে অনেকটাই নির্ভর করে, আর এর মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসায়ীরা লাভবান হয়ে তাদের লাভের একাংশ কর হিসেবে কেন্দ্রীয় সরকারকে দিয়ে থাকে। তবে একটা বিষয়। অনেকেরই পর্যবেক্ষণ, বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচন এবং আওয়ামী লীগ সরকারকে পুনরায় ক্ষমতাসীন হতে না দিতে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের বিভিন্ন পর্যায় উঠেপড়ে লেগেছে। আর এর অংশ হিসেবেই সাম্প্রতিক সময়গুলোয় তাদের পক্ষ থেকে দফায় দফায় প্রতিনিধিদল প্রেরণ করে বিএনপিকে নির্বাচনে আনতে সরকারকে চাপ দেওয়া, রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের তৎপরতা, ঘন ঘন দেশে বিদেশে বসে কূটনৈতিক প্রচেষ্টাএ সবকিছুই করা হচ্ছে একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের স্বার্থ সামনে রেখে। নির্বাচন সামনে রেখে মূলত গত মে মাসে তাদের তরফে ভিসানীতি ঘোষণা করা হলেও এ নীতি সরকারের ওপর প্রয়োগের জন্য নানাভাবে তাদের দিক থেকে সুযোগ খোঁজা হচ্ছে। যেহেতু বিএনপি এবারের নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে না, তাদের পক্ষ থেকে নির্বাচনে প্রভাব সৃষ্টি করার মতো সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ করার সুযোগ সীমিত, যার মধ্য দিয়ে ভিসানীতির প্রয়োগ ঘটতে পারে। এ ক্ষেত্রে রাশিয়ার পুররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে সুস্পষ্টভাবে উদ্বেগ জানিয়ে বলা হয়েছে, নির্বাচনে সরকার প্রভাব সৃষ্টি করেছে বলে ভিত্তিহীন অভিযোগ আনা হতে পারে। আর এ অভিযোগের ওপর ভিত্তি করে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতির প্রয়োগ এবং এর মধ্য দিয়ে দেশের অভ্যন্তরে এক ধরনের কৃত্রিম বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে জনগণকে সরকারের বিরুদ্ধে খেপিয়ে তোলার চেষ্টা করা হতে পারে, এমন সন্দেহ মোটেও অমূলক নয়

বাংলাদেশে মার্কিন ভিসানীতি প্রয়োগের ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট নির্দেশনাগুলোকে যদি আমরা একটু স্মরণ করি তাহলে দেখতে পাবো, তাদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া এবং নির্বাচনকে যারা প্রভাবিত করার চেষ্টা করবে এবং এ নিয়ে যারা জনজীবনে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করবে তাদের এবং তাদের পরিবারের ওপর এ নীতি প্রয়োগযোগ্য হবে। বিএনপির এ নির্বাচনটি বর্জন করার মধ্য দিয়ে নির্বাচন অবাধ, নিরপেক্ষ এবং গ্রহণযোগ্য হয়নি এটা প্রমাণ করার সুযোগ থেকে তারা বঞ্চিত হয়েছে। সেই সঙ্গে এ বর্জনের সপক্ষে তারা ২৮ অক্টোবর থেকে শুরু করে তফসিল ঘোষণার পর থেকে একের পর এক যে ধরনের নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড সংঘটিত করে যাচ্ছে, এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে তাদের ঘোষিত ভিসানীতি এ ঘটনাগুলোর সঙ্গে জড়িতদের ওপর আরোপ করা নীতিগত দায়িত্ব হয়ে পড়েছে। গত ১০ দিনের মধ্যে রেলে কমপক্ষে সাতটি নাশকতা ঘটানো হয়েছে, যার মধ্যে তিন বছরের এক শিশুসহ কমপক্ষে পাঁচজন দগ্ধ হয়ে মারা গেছে এবং অনেকে আগুনে দগ্ধ হয়েছে। এ নিয়ে সর্বশেষ মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের প্রেস ব্রিফিংয়ে ম্যাথু মিলারের কাছে প্রশ্ন করা হলে এ ধরনের নির্দিষ্ট ঘটনা নিয়ে তার কিছু জানা নেই বলে মন্তব্য করেন। কিছুদিন ধরে নিয়মিতভাবে সাংবাদিকদের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের অন্দরমহলের অনেক কিছু নিয়ে কথা বলা এবং বিরোধীদের নির্বাচনে এনে তাদের প্রকারান্তরে বিজয়ী করার ইঙ্গিত দিলেও এ ধরনের নাশকতার ঘটনা নিয়ে তাদের কিছু জানা নেই, বিষয়টি খুবই হাস্যকর।

যুক্তরাষ্ট্র যে ধরনের গণতন্ত্রের কথা বলতে চায় এবং দেখতে চায়, তা যদি আমরা সঠিকভাবে বুঝে থাকি তাহলে জানব যে, একটি দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সমুন্নত রাখতে হলে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠান অনিবার্য। কোনো নির্দিষ্ট দল যদি এটিকে বর্জন করে, তাহলে তাদের রাষ্ট্র পরিচালনায় যাওয়ার আর কোনো সুযোগ থাকে না। আর এর বাইরে গিয়ে যদি জনজীবনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে থাকে তাহলে তা জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক কোনো মানদণ্ডের মধ্যেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। আমরা দেখছি, এ ধরনের গণবিরোধী কাজকর্মগুলোই সংঘটিত হচ্ছে একের পর এক। গত আড়াই মাসের বেশি সময় ধরে হরতাল-অবরোধের মতো কর্মকাণ্ডের পরও যখন জনজীবনে এর বিন্দুমাত্র প্রভাব পড়েনি, এর পরপরই আবার ২০১৪ সালের কায়দায় শুরু হয়ে গেছে অগ্নিসন্ত্রাস। সর্বশেশ তাদের পক্ষ থেকে অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করে সর্বাত্মকভাবে জনগণের প্রতি কর, খাজনা, গ্যাস, পানি ও বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ না করার আহ্বান জানানো হয়েছে। এখানে বলতে হয়, তাদের অনেকেরই ধারণা নেই যে তাদের শীর্ষ নেতৃবৃন্দের অনেকের বসবাস ঢাকা, চট্টগ্রামের মতো বড় নগরগুলোয়। বর্তমান সরকার আমলে অনেক দিন হয়েছে গ্যাস ও বিদ্যুৎ ব্যবস্থা প্রিপেইডের আওতায় চলে এসেছে, অর্থাৎ রিচার্জ করলেই কেবল এ সেবা পাওয়া যায়।

জানতে খুব ইচ্ছে করে, যে নেতারা এ আহ্বান জানালেন তারা কীভাবে এখনও এ ধরনের সেবা নিচ্ছেন? তারা যে বাংলাদেশকে কার্যত আজকের চেয়ে ২০ বছর আগের আয়না দিয়ে দেখছেন এবং তারও পেছনে নিয়ে যেতে চান, নিজেদের হঠকারী কর্মকাণ্ড দিয়ে এটাই পরিষ্কার করে দিচ্ছেন। বাংলাদেশের জনগণ এখন এ অবস্থায় এসে আর আওয়ামী লীগ বা বিএনপি নয়, উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে, সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নিজেদের অবস্থান আরও উচ্চতর পর্যায়ে নিয়ে যেতে চায়। এর বিপরীতে কিছু হলে এর দায় সরকার বা বিরোধী দল কেউ এড়াতে পারে না।

  • কূটনীতি-বিশ্লেষক, অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা