পরিপ্রেক্ষিত
মীর আব্দুল আলীম
প্রকাশ : ২৪ ডিসেম্বর ২০২৩ ১০:২৩ এএম
দেশি-আন্তর্জাতিক সব গবেষণায় দেশে খাবারের বিষক্রিয়ার
বিষয়টি বারবার উঠে আসছে। ফুটপাত থেকে শুরু করে অভিজাত হোটেল-রেস্টুরেন্ট বা নামিদামি
ব্র্যান্ডের পণ্য এমনকি বাসাবাড়ির খাদ্যও এখন ভেজালমুক্ত নয়। খাবারের আকর্ষণ বাড়ানোর
জন্য মেশানো হচ্ছে ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ। গবেষণা বলছে, শুধু ভেজাল খাদ্য গ্রহণের
ফলে দেশে প্রতি বছর প্রায় সাড়ে ৩ লাখ লোক ক্যানসারে আক্রান্ত হচ্ছে। ডায়াবেটিস আক্রান্তের
সংখ্যা দেড় লাখ, কিডনি রোগে আক্রান্তের সংখ্যা ২ লাখ। এ ছাড়া গর্ভবতী মায়ের শারীরিক
জটিলতাসহ গর্ভজাত বিকলাঙ্গ শিশুর সংখ্যা প্রায় ১৫ লাখ। এ পরিসংখ্যানটি আমাদের না ভাবিয়ে
পারে না। ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে খাদ্যে ভেজাল দেওয়া এবং ভেজাল খাদ্য বিক্রির
সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। সিএজির প্রতিবেদনে আমরা এমনটাই দেখেছি।
ভেজাল প্রতিরোধে দায়িত্বপ্রাপ্ত বিভিন্ন সরকারি সংস্থার মধ্যে সমন্বয়ের বড় অভাব রয়েছে।
রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের কর্মকর্তারা জানান,
ট্যানারির বর্জ্য থেকে উৎপাদিত পোল্ট্রি ফিডে হেভিমেটালে ক্যাডমিয়াম, লেড (সিসা), মার্কারি
(পারদ), ক্রোমিয়ামসহ বেশ কিছু বিষাক্ত পদার্থ মিলেছে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেন,
ক্রোমিয়ামসহ এসব ধাতু ও রাসায়নিক থেকে ক্যানসার, হৃদরোগ, আলসার, লিভারে জটিলতা, কিডনির
অসুখ হতে পারে। মানবদেহে অতিরিক্ত ক্রোমিয়াম প্রবেশ করলে পুরুষের সন্তান উৎপাদনক্ষমতা
হ্রাস, নারীর অকালপ্রসব, বিকলাঙ্গ শিশুর জন্ম, অ্যাজমা, শ্বাসকষ্ট, চর্মরোগ হয়। ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. আবুল হোসেন জানিয়েছেন, ট্যানারি বর্জ্য ছাড়া
অন্য যেসব উপাদান ব্যবহার করে দেশে যে পোল্ট্রি ফিড তৈরি হয়, তাতে ক্রোমিয়ামের উপাদান
থাকার আশঙ্কা নেই। সে ক্ষেত্রে যেন পুরো পোল্ট্রি ফিডশিল্পের ব্যাপারে ভোক্তা ও উৎপাদকদের
মধ্যে আতঙ্ক তৈরি না হয়, সে বিষয়ে সতর্ক থাকা জরুরি।
বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমে খাদ্যে ভেজালের সংবেদনশীল ও ভয়ানক খবরগুলো
বিভিন্ন সময় প্রকাশ হয়ে আসছে। ভেজাল রোধে হাইকোর্টের একটি দ্বৈত বেঞ্চ নিম্নমানের ৫২
খাদ্যপণ্য প্রত্যাহারের নির্দেশ দিয়েছেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভেজালমিশ্রিত খাদ্যের কারণে
কিডনি রোগ, ক্যানসার, হাঁপানি, অন্ত্রে ব্যথা, পেটের পীড়া, গর্ভপাত, বন্ধ্যত্ব, শ্বাসকষ্ট,
স্নায়ুর ক্ষতি, ডায়াবেটিস, প্রজনন অক্ষমতা, মাংসপেশির সংকোচন, বমি ভাব, মুখে অতিরিক্ত
লালা ঝরা, চোখে পানি পড়া, মাথা ব্যথা, চোখের মণি ছোট হয়ে আসা, ঝাপসা দেখা, দুর্বলতা,
তলপেটে ব্যথা, খিঁচুনি হতে পারে। যকৃৎ, প্লিহা, ফুসফুসে সমস্যা দেখা দিতে পারে। খাবারে
কৃত্রিম রঙ এবং জুসে ব্যবহৃত প্রিজারভেটিভ ক্যানসার সৃষ্টিতে সহায়তা করে। এমনকি আমাদের
জীবন রক্ষাকারী ওষুধও ভেজাল থেকে শতভাগ মুক্ত নয়। ক্ষেতে ফলানো চাল-ডালেও ভেজাল।
জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক বলছেন, প্রকৃত সংখ্যা তার চেয়েও বেশি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য বলছে, বাংলাদেশে ৬০ ভাগ ক্যানসার রোগী প্রায় পাঁচ বছরের মধ্যে মারা যায়। দেশে ক্যানসার রোগীর মৃত্যুহার বর্তমানে প্রায় ৮ ভাগ এবং এ সংখ্যা ২০৩০ সালে ১৩ ভাগে উন্নীত হবে। আমরা উদ্বেগের সঙ্গে দেখেছি, হাইকোর্টের হস্তক্ষেপের পরও সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে পরিস্থিতির তেমন হেরফের ঘটেনি। অথচ সরকারি সংস্থা দ্বারা ভেজাল চিহ্নিত হওয়ার পরই দায়ী প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে, সেটাই ছিল দেশের মানুষের স্বাভাবিক প্রত্যাশা। খাদ্য মানুষের অন্যতম প্রধান মৌলিক অধিকার। খাদ্যগ্রহণ ছাড়া কোনো প্রাণীই বেঁচে থাকতে পারে না। তবে সে খাবার অবশ্যই হতে হয় বিশুদ্ধ। আমরা আশা করব, ভেজাল খাদ্যপণ্য কার্যকরভাবে প্রত্যাহার করে এবং দোষীদের বিরুদ্ধে যথাযথ পদক্ষেপ নিয়ে সরকার একটি অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে। সর্বোপরি ভেজাল প্রতিরোধে জনসচেতনতা একান্ত দরকার।