যুদ্ধ
ড. বিভূতিভূষণ মিত্র
প্রকাশ : ২১ ডিসেম্বর ২০২৩ ১০:১৬ এএম
ড. বিভূতিভূষণ মিত্র
যুদ্ধ শুধু মানবসভ্যতা
নয়, প্রকৃতিসভ্যতারও বিপদ ডেকে আনে। এ বিপদ আজকের নয়, যুগ যুগ ধরে যত যুদ্ধ হয়েছে কোনোটাই
প্রকৃতির পক্ষে নয়। এটি বিশাল বন্য প্রাণী প্রজাতিকে বিলুপ্তির দিকে নিয়ে গেছে তো বটেই,
ধ্বংস করে দিয়েছে উদ্ভিদ ও প্রাণীর বাস্তুসংস্থান। ইউক্রেন, ইয়েমেন, দক্ষিণ সুদান,
লিবিয়া এবং পৃথিবীব্যাপী অন্যান্য দেশে যুদ্ধ এবং সামরিক হামলার জন্য মানুষের ধ্বংসের
পাশাপাশি পরিবেশের ওপর হামলার বিষয়টি খুবই ভয়াবহ। যুদ্ধ মারাত্মকভাবে উদ্ভিদ ও প্রাণী
জগতের জন্য হুমকিস্বরূপ। যুদ্ধের মারণাস্ত্র, বুলেট ও বোমার আঘাতে অনেক বন্য প্রাণী
প্রজাতির অস্তিত্বই বিলুপ্তির পথে। ২০১৮ সালে প্রকাশিত ‘নেচার’ পত্রিকায় দেখানো হয়েছে,
এক বছরের যুদ্ধে যেকোনো প্রাণী প্রজাতির সংখ্যা মারাত্মকভাবে নিচে নেমে যেতে পারে।
২০১৩ সালে প্রকাশিত এক জার্নালে দেখানো হয়, ১৯৫৮ সালে ফ্রান্স-আলজেরিয়া যুদ্ধে এক প্রজাতির
সিংহ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। যুদ্ধে ব্যবহৃত বুলেট ও বোমা বিস্ফোরণে নির্গত সিসা পরিবেশের
মারাত্মক ক্ষতি করে। অনেক সময় যুদ্ধে বন পরিষ্কার করার জন্য হার্বিসাইডস ব্যবহার করা
হয়, যা বনের গাছপালার সঙ্গে সঙ্গে অসংখ্য বন্য প্রাণী ধ্বংসের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। মিসাইল,
ক্ষেপণাস্ত্র, যুদ্ধবিমান শুধু শব্দদূষণই করে না, বন্য প্রাণীর স্বাভাবিক বেঁচে থাকা
যেমন বন্য প্রাণীর ঘুম, পরিব্রাজন প্রভৃতিতে ব্যাঘাত ঘটায়। সেনাবাহিনীর অনেক রাইফেলের
শব্দ এতটাই দূষণ করে যে, এ থেকে প্রায় ২৫০ ডেসিবেলের ওপরে শব্দ হয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের
সময় জাপানি সেনাবাহিনী এক ধরনের পাখি ধরে খেত। এ যুদ্ধে হাতি, গরিলাসহ কয়েকশ প্রজাতির
প্রাণী বিলুপ্তির পথে চলে গেছে। ১৯৭৭-১৯৯২-এ মোজাম্বিক সিভিল ওয়ার নিয়ে ২০১৫ সালে জার্নাল
অব ইকোলজিতে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখানো হয়, হাতি ও অন্যান্য তৃণভোজী প্রাণীর বিলুপ্তির
কারণে ৩৪ ভাগ নতুন গাছগাছড়া বেড়ে যায়। গত ৬০ বছরে পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও জীববৈচিত্র্যে
ভরা দুই তৃতীয়াংশ এলাকা যুদ্ধের মুখোমুখি হয়েছে। জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণকারীদের কাছে
যুদ্ধ ও বন্য প্রাণী এখন একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। যুদ্ধ শুধু আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক
পরিস্থিতির জন্য হুমকি নয়, স্থানীয় প্রাণবৈচিত্র্যের জন্যও বিপৎসংকুল। ভিয়েতনাম যুদ্ধে
যুক্তরাষ্ট্র ২ মিলিয়ন হেক্টর এলাকায় হার্বিসাইড ব্যবহার করেছিল, যা ছিল জাতীয় বনের
২০ ভাগ। একটি গবেষণায় জানা যায়, ১৯৯০ সালে তুর্কি সেনাবাহিনী কুর্দিস্তানের বনাঞ্চল
ইচ্ছাকৃতভাবে কায়দা করে পুড়িয়ে দিয়েছিল।
মানুষের সঙ্গে
খুবই স্বল্পমাত্রার সংঘর্ষে বন্য প্রাণী নাটকীয়ভাবে কমে যেতে পারে। নেচার পত্রিকায়
১৯৪৬ সালে ঘটে যাওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখানো হয়েছে, আফ্রিকার বিশালসংখ্যক স্তন্যপায়ী
প্রাণী মানুষের সঙ্গে সংঘর্ষের শিকার। গবেষণায় দেখানো হয়েছে, ক্রমাগত অস্ত্রের আঘাত
বন্য প্রাণীর ওপর একটি বড় বিপর্যয় এনেছে। ল্যান্ডমাইনের আঘাতে বন্য প্রাণী আহত হয় এবং
মারা যায়। খাদ্যের জন্যও বন্য প্রাণী শিকার ও হত্যা করা হয়। সমুদ্রে সামুদ্রিক প্রাণী
নৌবাহিনীর যুদ্ধমহড়ার মাধ্যমে নানা সমস্যার সম্মুখে পড়ছে। অনেক ছত্রাকজনিত রোগ হচ্ছে।
সামুদ্রিক প্রাণী দুর্বল হয়ে পড়ছে। চিড়িয়াখানার প্রাণীরাও যুদ্ধে হামলার শিকার হয়।
যুদ্ধের সময় চিড়িয়াখানায় দর্শনার্থী অনেক কম থাকে। এ সময় অনেক প্রাণী হত্যার শিকার
হতে পারে, আহত হতে পারে, চুরি হতে পারে, বিক্রি হতে পারে। ২০০৩ সালের ইরাক যুদ্ধে বাগদাদ
চিড়িয়াখানা থেকে সিংহ, বাঘ ছেড়ে দেওয়া হয় প্রথমে, পরে হত্যা করা হয়। যুদ্ধে গৃহপালিত
পশুপাখিও আহত হয়। বিশেষ করে হত্যার শিকার হয়। এ ছাড়া এ সময় মানুষ গৃহপালিত পশুপাখির
তেমন দেখাশোনার সুযোগ পায় না, খাদ্য ও ওষুধের অভাবে অনেক গৃহপালিত পশুপাখি মারা যায়।
এ সময় খাদ্য,
পানি, জ্বালানি পরিবহন কাজে ব্যবহৃত পশু যেমন গরু, ঘোড়া মানুষ খাদ্যের অভাবে মেরে খেয়ে
ফেলে। এ ছাড়া পশুদের খাবার জোগান দিতে না পারা, যত্ন নিতে না পারার কারণেও পালিত পশু
জবাই করা হয়। দেখা গেছে ১৯১৪ থেকে ১৯১৮ সাল পর্যন্ত প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ১৬ মিলিয়ন
প্রাণী নানাভাবে হত্যার শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ৯ মিলিয়ন ঘোড়া, গাধাসহ অনেক প্রাণী হত্যা
করা হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটেনে এক সপ্তাহে ৭ লাখ ৫০ হাজার গৃহপালিত
পশুপাখি হত্যা করা হয়েছিল তাদের নিরাপত্তা ও খাদ্য ঘাটতির কারণে। জার্মান সেনাবাহিনীকে
দুই মাসে ১ লাখ ৭৯ হাজার ঘোড়া হারাতে হয়েছিল। ১৯৫৫ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত ভিয়েতনাম
যুদ্ধ চলাকালে ৪০ হাজার প্রাণী হত্যা করা হয়েছিল। এর মধ্যে বাঘ, হাতি উল্লেখযোগ্য।
১৯৭৭ থেকে ১৯৯২ পর্যন্ত মোজাম্বিক গৃহযুদ্ধে একটি জাতীয় উদ্যান থেকে ৯০ ভাগ জিরাফ ও
হাতি বিলুপ্ত হয়ে গেছে। ১৯৮০ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত ইরাক-ইরান যুদ্ধে ভোঁদড়, বন্য ছাগল,
হায়েনা, ডলফিন প্রজাতি বিলুপ্তির দিকে চলে গেছে। ১৯৮৩ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত দক্ষিণ
সুদানের গৃহযুদ্ধে হাতির সংখ্যা ১ লাখ থেকে ৫ হাজারে নেমে এসেছে। আফগান যুদ্ধে মাইন
বিস্ফোরণে ৭৫ হাজার প্রাণী মারা গেছে। যুদ্ধে বন্য প্রাণীর বেঁচে থাকার অধিকারের বিষয়টি
এখনও আন্তর্জাতিক আইনে স্বীকৃত নয়। বন্য প্রাণী রক্ষায় আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলোর এ ইস্যুতে
চাপ প্রয়োগ প্রয়োজন।
সত্যিকার অর্থে যুদ্ধের এ বিভীষিকা মানব প্রজাতিকে প্রত্যক্ষভাবে তো বটেই, পরোক্ষভাবে বিশাল বাস্তুসংস্থান ধ্বংসের মাধ্যমে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখানো হয়েছে, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধে ইউক্রেনের প্রায় ২০ শতাংশ বনভূমি ক্ষতির সম্মুখে পড়েছে। হুমকির মুখে পড়েছে ২.৯ মিলিয়ন হেক্টর পান্না নেটওয়ার্ক এবং ৬ লাখ হেক্টর জলাভূমি। কামিয়ানস্কা সিচ জাতীয় উদ্যানের ৬৩৫ হেক্টর এলাকা পুড়ে গেছে যেখানে ৯০টির বেশি বিরল প্রজাতির বাস। যুদ্ধের এ ক্ষতি শুধু সেই দেশের নয়, গোটা পৃথিবীর জন্য হুমকিস্বরূপ। পৃথিবীর টিকে থাকার প্রয়োজনেই এসব যুদ্ধ থেকে সরে আসতে হবে। তৈরি করতে হবে মানবসভ্যতা নয়, প্রকৃতির সভ্যতা।