শিক্ষা
শহিদুল ইসলাম
প্রকাশ : ২০ ডিসেম্বর ২০২৩ ১০:৪৩ এএম
শহিদুল ইসলাম
আমার মনে হয় নতুন শিক্ষা কার্যক্রম নিয়ে দেশের মানুষ ইতোমধ্যে মোটামুটি
ধারণা পেয়ে গেছে। আমি এই কার্যক্রম চোখে দেখিনি। তাই ভাবছিলাম এ বিষয়ে কিছুই বলব না
বা লিখব না। যদিও আমার দুজন ছাত্র ফোন করে এ ব্যাপারে মতামত জানতে চেয়েছিলেন। ইতোমধ্যে
আমার অতি প্রিয় ও সুস্থ চিন্তার অধিকারী ক’জন ছাত্রছাত্রীর লেখা পড়ে এ ব্যাপারে খানিকটা
অবহিত হলেও আমার মনে হয়েছে, এখনও নতুন শিক্ষা কার্যক্রম সম্পর্কে কিছুই জানি না। তবে
আমাদের শিক্ষামন্ত্রী তার বক্তব্যে বিভিন্ন দেশের নজির তুলে ধরেছেন। তাই ভাবলাম, আমিও
উন্নত একটি দেশের শিক্ষা কার্যক্রম সম্পর্কে কিছু লিখতে পারি। প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার
মাধ্যমেই আমি তা জানি।
পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার রাজধানী পার্থে আমার দুই নাতির স্কুলের শিক্ষার
ধারাবাহিকতা আমি খুব ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করেছি। বড় নাতি সূর্য এখন এএনইউ (অস্ট্রেলিয়ান
ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি) থেকে সংগীতের শেষ ডিগ্রি অর্জনের পথে। সংগীতের সঙ্গে সে কম্পিউটার
সায়েন্স নিয়েছিল। চাপটা বেশি মনে হলো। তখন সে ডেটা এনালিটিক্স নিয়েছে। প্রি-প্রাইমারি
থেকে বার ক্লাস পাস করা ও অস্ট্রেলিয়াব্যাপী প্রতিযোগিতার মাধ্যমে তার ভর্তি হওয়ার
প্রতিটি পর্যায় আমি লক্ষ করেছি। ছোট নাতি নিসর্গ এবার অষ্টম শ্রেণি শেষ করে নবম শ্রেণিতে
উঠল। তাদের গান নাটক রান্না বাগান করা সবকিছুই করতে দেখেছি। এবার নিসর্গের স্কুলের
নাটক দেখে এলাম। একটি ফেইরি টেলস নিউজিস, নিসর্গ প্রধান চরিত্রে অভিনয় করল। ওর ক্লাসে
সে একাই বাঙালি মা-বাবার সন্তান। গ্রেডিংয়ে পরে স্কুল কর্তৃপক্ষ জানাল যে সে প্রথম
হয়েছে। একটি সার্টিফিকেটও দিয়েছে। স্কুল থেকে সপ্তাহে এক দিন রান্না করা খাবার নিয়ে
আসত। আমরা অবাক হতাম। বাড়িতেও সে অনেক কিছুই রান্না করত। আমরা খেতাম। এগুলোর পরীক্ষা
দিতে হয় না। তাদের কাজ দেখে শিক্ষকই তাদের মান নির্ণয় করেন। পরীক্ষায় বসতে হয় সাধারণ
বিজ্ঞান, কলা ও সমাজ বিজ্ঞান, ভৌত বিজ্ঞান (পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, গণিত, উদ্ভিদবিদ্যা),
ইংরেজি, মিউজিক্যাল থিয়েটার আর কম্পিউটার সায়েন্স, কুকিং, হেলথ, গার্ডেনিং অপশন্স বিষয়।
একেকটা সেমিস্টারে একটা করে।
টলস্টয়ও হাতে-কলমে শিক্ষার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। আমাদের রবীন্দ্রনাথও।
প্রথাগত শিক্ষা যখন চালু হয়নি, তখন মানুষ যা শিখেছিল এবং আবিষ্কার করেছিল, সেসব শিক্ষা
তারা কোথা থেকে লাভ করেছিল? এক কথায় বলা যায় দৃষ্টবাদী বা পজিটিভিস্টিক জ্ঞান। শিশুদের
প্রথম শিক্ষাও দৃষ্টবাদী। মা-বাবাসহ তার কাছের মানুষই তাদের প্রথম শিক্ষক। তাই তো একজন
নিরক্ষর মা’র চেয়ে একজন শিক্ষিত মা শিশুদের ভালো শিক্ষক। শিশুদের চরিত্র গঠনে শিক্ষিত
মেয়েদের ভূমিকা অনেক বেশি।
তবে দৃষ্টবাদী বা পজিটিভিস্টিক জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার কথা আমি কর্তৃপক্ষের
নজরে আনতে চাই। আজকের বিজ্ঞান মানুষের জানা বা জ্ঞানের সীমানা দেখা, শোনা ও স্পর্শের
বাইরে হাজার মাইল বিস্তৃত করেছে। সেই জ্ঞান দেখা, শোনা ও স্পর্শের মাধ্যমে পাওয়ার কোনো
উপায় নেই। শিশুদের এমন বেশ কিছু দৃষ্টবাদী জ্ঞান শেখানো হয়। একটা উদাহরণ দিই। আমাদের
শিশুদের প্রশ্ন করলে রাজহাঁসকে সাদাই বলবে। কিন্তু রাজহাঁস যে কালোও হয়, তা হয়তো অনেকেই
বা শিশুরা জানে না। তারা যদি সাদা রাজহাঁসের পাশে কালো রাজহাঁসও দেখত, তাহলে এ ভুল
হতো না। অস্ট্রেলিয়ায় আমি নিজে কালো রাজহাঁস দেখেছি। একই জলাশয়ে সাদা ও কালো রাজহাঁস
সাঁতার কাটছে। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে অন্যতম শ্রেষ্ঠ পদার্থবিজ্ঞানী আর্নেস্ট মাখ
ইতিহাসে একজন শ্রেষ্ঠ দৃষ্টবাদী বিজ্ঞানী হিসেবে খ্যাতি লাভ করেছেন। চোখে যা দেখা যায়
না, তা তিনি বিশ্বাস করতে রাজি নন। আলবার্ট আইনস্টাইন ১৯০৫ সালে যখন এটম আবিষ্কার করেন,
তখনও তিনি এটমের অস্তিত্বে বিশ্বাস করেননি। ১৯১৬ সালে মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত
তিনি আইনস্টাইনের আবিষ্কার মিথ্যা প্রমাণে ব্যস্ত ছিলেন। এটাই হচ্ছে পজিটিভিস্টিক জ্ঞানের
সীমাবদ্ধতা।
তারপরেই আসে প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষকের স্থান। অশিক্ষিত বা সামান্য
জ্ঞানী শিক্ষকের চাইতে ভালোভাবে শিক্ষিত শিক্ষকের ভূমিকা বা প্রয়োজন অনেক বেশি। সভ্যতার
শুরু থেকেই আমাদের জ্ঞান ভাণ্ডারের পরিধি বাড়তেই আছে। জ্ঞান ভাণ্ডারের পরিধি বৃদ্ধির
সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষকদের সামনে এসে হাজির হয় নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা
শিক্ষকদেরই করতে হয়। তার জন্য আধুনিক রাষ্ট্র শিক্ষক প্রশিক্ষণ কলেজ, শিশু মনস্তত্ত্ব,
পেডাগগি ইত্যাদি বিষয়ক কোর্স চালু করেছে। গতিশীল সমাজে শিক্ষাও গতিশীল। কাজেই শিক্ষকদেরও
গতিশীল না হয়ে উপায় নেই। সেজন্যই শিক্ষকদের নিরন্তর প্রশিক্ষণের মধ্য দিয়েই যেতে
হয়। ছাত্রদের ছাত্রত্ব শেষ হলেও শিক্ষকদের ছাত্রত্ব শেষ হয় না। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ
ও অনুসন্ধিৎসুর প্রক্রিয়া যদি রুদ্ধ হয়ে যায়, তাহলে তারা ফসিলে পরিণত হন। আমাদের দেশে
আজ পুরো শিক্ষাব্যবস্থা পঙ্গুত্বপ্রাপ্ত হয়েছে এ কারণেই। তাছাড়া প্রাথমিক শিক্ষাস্তরে
নিকট অতীতে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে অনিয়ম-দুর্নীতি ও প্রশ্নফাঁসের মতো কদাচারের ঘটনা
ঘটেছে। এর আগেও যে এমন ঘটেনি তার নিশ্চয়তা কি?
শিক্ষার ব্যাপারে আমাদের রাষ্ট্রের ব্যর্থতা আছে আরও। জাতীয় বাজেটের
মাত্র দুই-তিন শতাংশ বরাদ্দ দিয়ে শিক্ষার মানোন্নয়ন সম্ভব নয়। স্বাধীনতার পর আমাদের
শিক্ষা খাতে বরাদ্দ ২% আশেপাশেই ঘোরাঘুরি করছে। এ বছর সর্বনিম্ন ১.৭৬%; ইউনেস্কোর সিদ্ধান্ত
অনুযায়ী যেখানে শিক্ষা ও গবেষণা খাতে জিডিপির ৭% বরাদ্দ রাখার কথা। আমাদের সরকার কখনও
শিক্ষানীতি, কখনও বা পাঠ্যক্রম পরিবর্তনের বিষয়টি উপলব্ধি করে বটে, কিন্তু তার জন্য
আগে থেকেই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করে না। শিক্ষানীতি ব্রিটিশ আমলেও পরিবর্তিত হয়েছিল।
শিক্ষানীতি পরিবর্তনের আগে একটি শিক্ষা কমিশন গঠনের প্রয়োজন হয়। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু
বিখ্যাত বিজ্ঞানী প্রফেসর কুদরত-এ-খুদার নেতৃত্বে একটি কমিশন গঠন করেছিলেন। মেজর জিয়াউর
রহমান ওই শিক্ষানীতি ডাস্টবিনে ফেলে দেন। তারপর প্রশাসনিকভাবেই একটি শিক্ষানীতি প্রণয়ন
করা হয় এবং তা জাতির কাঁধে চাপিয়ে দেয়। এরপরও বিভিন্ন সময় শিক্ষানীতি প্রণয়নের উদ্যোগ
নেওয়া হয়েছে, কিন্তু সেগুলোও ছিল সামঞ্জস্যহীনতায় ভরা। এভাবেই আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার
অন্তর্জলি যাত্রা ত্বরান্বিত হয়।
তবে শিক্ষা কার্যক্রম, পাঠক্রম ইত্যাদি পরিবর্তনে ভয় পাওয়ার কিছু
নেই। ভয় সেখানেই যেখানে কোনো পূর্ব প্রস্তুতি ছাড়া এমন আগাপাশতলা পরিবর্তনের সংবাদ
পাই। আমি এখনও জানি না পরিবর্তনটি কেমন! ফেসবুকের প্রতিক্রিয়া দেখে কিছু মন্তব্য করা
উচিত নয়। তবুও আমার দেখা দুই নাতির শিক্ষার কথা লিখলাম। সেখান থেকে আমাদের শিক্ষামন্ত্রীর
নজরে কিছু পড়বে এই আশায়। আরও শুনছি এই নতুন শিক্ষা কার্যক্রম ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষা
ক্ষেত্রে নাকি প্রযোজ্য নয়। কেন? এ প্রশ্নের সঠিক জবাবই সরকারের উদ্দেশ্য পরিষ্কার
করে দেবে। এই পদ্ধতি যদি এতই ভালো হবে, তাহলে ইংরাজি মাধ্যমের ছাত্র-ছাত্রীদের সেটি
থেকে বঞ্চিত করা হবে কেন? এর উত্তর পেতে চাই শিক্ষামন্ত্রীর কাছে।
আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার আরেকটি মারাত্মক ক্যানসার হলো, কোচিং সেন্টারের উপস্থিতি। এই ক্যানসারের মূলোৎপাটন করতে না পারলে শিক্ষাঘরে শিক্ষা আর ফিরে আসবে না। আমাদের শিক্ষামন্ত্রী ক্ষমতা গ্রহণের সময় কোচিং সেন্টার বিলুপ্তির ঘোষণা দিয়েছিলেন। ঘোষণা দিয়ে যে কিছুই হয় না কোচিং সেন্টারের বংশবৃদ্ধি তার বড় প্রমাণ। প্রাথমিকসহ সকল পর্যায়ের শিক্ষকদের বেতন ও সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি কোচিং সেন্টার বিলুপ্তির প্রথম পদক্ষেপ। সেটা করতে হলে বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি করতে হবে। শিক্ষা ক্ষেত্রে অতীতের সরকারগুলোর ব্যর্থতা বিগত পনেরো বছরের শাসনে আওয়ামী লীগ সরকার দূর করতে পারেনি, এটি তার একটি বড় ব্যর্থতা। বরং বছর বছর শিক্ষা কার্যক্রম ও পরীক্ষা পদ্ধতির অদূরদর্শী পরিবর্তনের ফলে আজ তা মহীরুহ আকার ধারণ করেছে। নতুন শিক্ষা কার্যক্রম কি তা পারবে? শিক্ষাঘরে কি শিক্ষার পুনঃপ্রতিষ্ঠা হবে? এসব প্রশ্নের সুরাহার দায় সরকার এড়াতে পারে না।