× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

নির্বাচন ও জননিরাপত্তা

সহিংসতা যেন আমাদের রাজনৈতিক অভিশাপ

ড. নাসির উদ্দিন আহাম্মেদ

প্রকাশ : ১৮ ডিসেম্বর ২০২৩ ১৩:২৫ পিএম

সহিংসতা যেন আমাদের রাজনৈতিক অভিশাপ

ইতিহাসমতে দশম শতকে চীনে বাঁশের চোঙায় বারুদ ও ধারালো লোহার টুকরা ভরা হতো। এরপর এক ধরনের তির বা বল্লমের মাথায় বেঁধে তা বিশেষ কায়দায় ছোড়া হতো শত্রু বা হিংস্র বন্য পশুর ওপর। কিন্তু নিজস্বার্থে বিবেক বিসর্জন দিলে মানুষও যে কত হিংস্র হতে পারে, তার উৎকৃষ্ট প্রমাণ নানা ধরনের ক্ষুদ্র অস্ত্রের অপব্যবহার। পৃথিবীর প্রায় শতভাগ দেশে যুগের পর যুগ ধরে নানা মাত্রায় চলছে অবৈধ অস্ত্রের লেনদেন। রাষ্ট্রব্যবস্থায় একটি দেশের ক্ষমতাসীন সরকার নিজস্ব সামরিক বাহিনী, আধাসামরিক বাহিনী ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কার্যক্রমের জন্য নানা ধরনের ক্ষুদ্র অস্ত্র উৎপাদন, ক্রয় ও আমদানি করে থাকে। শিকার, বিনোদন, খেলাধুলা ও ব্যক্তিগত সুরক্ষার জন্যও সরকার বৈধভাবে অনুমতি সাপেক্ষে ক্ষুদ্রাস্ত্র ক্রয়, সংরক্ষণ ও বহনের অনুমতি প্রদান করে। তবে এর বাইরে বিশ্বজুড়ে মূলত জাতিগত দাঙ্গা, সন্ত্রাস, জঙ্গি তৎপরতা, নাশকতা, অপরাজনীতি, অবৈধ পথে বা বিপ্লবের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল, ছিনতাই, রাহাজানি, ক্ষমতাসীনদের উৎখাত, সর্বোপরি নির্বাচনের আগে, নির্বাচনের দিন ও নির্বাচনের পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে অবৈধ অস্ত্রের ব্যাপক ব্যবহার যেকোনো বিচারে একটি জটিল সমস্যা।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের ওয়েবসাইটে উল্লিখিত তথ্য মোতাবেক, ২০১৩ সালে বিশ্বে ১২৫ থেকে ২৩৬ মিলিয়ন ইউরো মূল্যের অবৈধ লেনদেন হয়েছে, যা বৈধ অস্ত্র বাবদ লেনদেনের ১০ থেকে ২০ শতাংশ। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা ‘বিজনেস রিসার্চ কোম্পানি’র তথ্য মোতাবেক, ২০১৭ সাল থেকে ক্ষুদ্র অস্ত্রের বাজার বার্ষিক ৪ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পেয়ে ২০২২ সালে প্রায় ১ হাজার ২৭৬ মিলিয়ন ডলারে পৌঁছে। ২০২৭ সালে এ বাজার ১৫ হাজার এবং ২০৩২ সালে ১৮ হাজার মিলিয়ন ডলার অতিক্রম করবে। এ বিশাল বাজারের একটা অংশ জুড়ে আছে সন্ত্রাসী চক্র যাদের হাত ধরে ভারত উপমহাদেশে এমনকি বাংলাদেশেও অবৈধ অস্ত্রের অনুপ্রবেশ ঘটে।

বাংলাদেশে বৈধ ও অবৈধ অস্ত্রের প্রকৃত সংখ্যা নিয়ে বিভিন্ন সূত্র থেকে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত পাওয়া যায়। পুলিশের বিশেষ শাখা (এসবি) নিয়ন্ত্রিত ফায়ার আর্মস ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমের বরাতে এ বছর ১৫ নভেম্বরে প্রকাশিত একটি ইংরেজি দৈনিকের তথ্য মোতাবেক, দেশে বর্তমানে লাইসেন্সকৃত বৈধ অস্ত্রের সংখ্যা ৫০ হাজার ৩১০। এর মধ্যে ব্যক্তির পর্যায়ে ৪৫ হাজার ২২৬ ও প্রতিষ্ঠান পর্যায়ে ৫ হাজার ৮৪টি অস্ত্র রয়েছে। ব্যক্তি পর্যায়ে থাকা অস্ত্রের মধ্যে ১০ হাজার ২১৫টি রয়েছে রাজনীতিবিদদের হাতে। এসব অস্ত্রের মধ্যে ৭৪ শতাংশের অর্থাৎ ৭ হাজার ৫৪৯টির মালিক ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা। যেকোনো বৈধ অস্ত্রের প্রকাশ্য প্রদর্শনীপূর্বক বিপক্ষ দল এমনকি আন্দোলনরত পোশাকশিল্পের কর্মীদের ভয়ভীতি দেখানো ও তাদের ছত্রভঙ্গ করার বহু ঘটনা ঘটেছে। অতি সম্প্রতি আওয়ামী লীগে যোগ দেওয়া ও এক রাতে নৌকার মাঝি বনে যাওয়া বীর মুক্তিযোদ্ধা শাহজাহান ওমরের একটি সভা চলাকালে তার পাশে অস্ত্রসহ এক ব্যক্তির অবস্থান বিতর্ক সৃষ্টি করেছে। অথচ ২০১৬ সালে প্রবর্তিত লাইসেন্স প্রদান, নবায়ন ও ব্যবহার বিষয়ক নীতিমালা অনুসারে এমন প্রদর্শনী ব্যবহার বেআইনি। এসবির দাবি অনুসারে, ২০২১ সালে দেশে অবৈধ অস্ত্র ছিল ৪৪ হাজার ১০৪টি, যে সংখ্যা দুই বছরে বৃদ্ধি পেয়ে ৬ হাজার অতিক্রম করেছে বলে বলা চলে। এই তথ্য ৬ ডিসেম্বর ২০২৩, উঠে এসেছিল বাংলা দৈনিকের প্রতিবেদনে।

দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন ও নিরাপত্তার স্বার্থে অবৈধ অস্ত্রের বিরুদ্ধে শূন্যসহনশীলতা বা জিরো টলারেন্স একান্ত কাম্য। বিশেষত নির্বাচনের আগে, নির্বাচন চলাকালে ও নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার রোধে প্রকাশ্যে ও গোপনে ক্রমাগত ও কার্যকর অভিযান পরিচালনা করতে হবে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক প্রচার শুরু হচ্ছে আজ থেকে। এই প্রেক্ষাপটে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার অভিযান জরুরি। তবে ঘোষণা দিয়ে অভিযান এ ক্ষেত্রে তেমন ফলপ্রসূ হয় না। মনে রাখতে হবে, ‘১০টি হোন্ডা+২০টি গুন্ডা=নির্বাচন ঠান্ডা’ আজ আর কেবল সেকেলে প্রবাদমাত্র নয়, বাস্তবতা। আরও বাস্তবতা হলো, স্বার্থান্বেষী মহলের কাছে নির্বাচন ও নির্বাচনে জয়লাভ পাঁচ বছর মেয়াদি মুনাফা বন্ডের মতো। নির্বাচনে যা খরচ হবে, পাঁচ বছর মেয়াদে সুদে-আসলে তা বৃদ্ধি পেয়ে ফিরে পাওয়ার প্রত্যাশা নিয়েই নির্বাচনে বিনিয়োগ করে এসব স্বার্থান্বেষী মহল। হলফনামায় তাদের প্রদর্শিত আয় ও ধনসম্পদের পাঁচ বছর পরপর অস্বাভাবিক বৃদ্ধি প্রমাণ করে রাজনীতি ও ক্ষমতায় থাকা কতটা লাভজনক। আর প্রদর্শিত আয়ের বাইরে বেনামে, আত্মীয়স্বজনের নামে এবং দেশের বাইরে থাকা ধনসম্পদ ধরা হলে এ আয় কোথায় দাঁড়াবে, তা বলাই বাহুল্য। মজার ব্যাপার হলো, ক্ষমতার বাইরে থাকা প্রান্তিক মানুষ মাছ চাষ কিংবা কৃষি কাজে লাভ করতে না পারলেও এই একই মাছ ও কৃষি চাষ করে শত শত কোটি টাকা বৈধভাবে আয় করেছেন বলে দাবি পাঁচ বছর মেয়াদের বহু জনপ্রতিনিধির। সুতরাং লাভের আশায় বৈধ অস্ত্রের প্রদর্শনী কিংবা অবৈধ অস্ত্রের জন্য অর্থ ব্যয়ে তারা কার্পণ্য করবেন না এটাই স্বাভাবিক। তবে তাদের কাছে যেটা স্বাভাবিক জননিরাপত্তা, গণতন্ত্রের জন্য তা মরণকামড়।

বাংলাদেশের বাস্তবতায় নির্বাচনের আগে সম্ভাব্য প্রার্থী বা মনোনয়ন পাওয়া প্রার্থী খুন, প্রার্থীর একান্ত আপনজন বা নির্ভরযোগ্য কাউকে খুন কিংবা গুলিবিদ্ধ করা কোনো ব্যতিক্রমী ঘটনা নয়। বিপক্ষ দলের সভা-সমাবেশে কম উপস্থিতি তথা কম জনপ্রিয়তা প্রমাণের জন্যও অস্ত্রের গোলাগুলি বা বিস্ফোরকের ব্যবহার লক্ষ করা যায়। প্রত্যেক প্রার্থীর নিজ এলাকা, নিকটাত্মীয়ের এলাকা বা কর্মস্থলে কিছু সুনির্দিষ্ট ভোটব্যাংক থাকে। এসব এলাকায় ভোটার উপস্থিতি কম ঘটানোই প্রতিপক্ষের লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়। কারও কারও লক্ষ্য থাকে সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এলাকা। এ কারণে ওই এলাকায় ভোটকেন্দ্রে গোলাগুলি ও বিকট শব্দে বিস্ফোরকের বিস্ফোরণ ঘটানোই ভোটার উপস্থিতি কমানোর মোক্ষম মাধ্যম। অস্ত্রের গোলাগুলি ও বিস্ফোরকের উচ্চশব্দে সারিবদ্ধ ভোটাররাও যদি একবার ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়, তবে নির্দিষ্ট সময়ে পুনরায় তাদের ভোটকেন্দ্রমুখী করা কঠিন হয়ে পড়ে। এভাবেই বৈধ বা অবৈধ অস্ত্রের কিংবা বিস্ফোরকের এমনকি কিছু পটকা বা ককটেলের ব্যবহারও ভোটব্যাংক নামক এলাকায় ভোটের কার্যক্রম ভণ্ডুল করে দিতে পারে। এর ফলে লাভবান হয় একই আসনের অন্য এলাকার প্রার্থী। ভোটের দিন অস্ত্রের মুখে পোলিং এজেন্টদের বের করে দেওয়া কিংবা প্রিসাইডিং অফিসারকে জিম্মি করে ক্রমাগত সিল মেরে ভোটের বাক্স ভর্তি করাও পুরোনো অপসংস্কৃতি। অতীতে কোনো কোনো ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট এলাকায় ব্যালট বই, ভোট সরঞ্জাম এমনকি ব্যালট বাক্স লুটপাটের ঘটনাও ঘটেছে। নির্বাচন প্রতিহতের নামে ভোটকেন্দ্র তথা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অগ্নিসংযোগ ও প্রিসাইডিং অফিসারকে হতাহত করার ঘটনাও ঘটেছে অবৈধ অস্ত্রের প্রদর্শনী কিংবা অপপ্রয়োগের মাধ্যমে।

নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতা এ দেশের এক রাজনৈতিক অভিশাপ। পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকা কোনো দল বা একজন নেতা যদি জনপ্রিয়তায় বা অন্য কোনো কারণে হেরে যান, তবে কেবল সেই দলের নেতা বা তার ঘনিষ্ঠজনই নয়, তার নিকটাত্মীয় বা তার প্রতি আনুগত ও তার আনুকূল্য পাওয়াদের ওপরও অস্ত্রসহ চড়াও হয় বিগত মেয়াদের সুবিধাবঞ্চিতরা বা প্রতিশোধপরায়ণ বিপক্ষ দল। এ ক্ষেত্রে লুটপাট, অগ্নিসংযোগ এমনকি ধর্ষণের মতো বর্বরোচিত ঘটনাও ঘটেছে বহুবার। সংখ্যালঘু সম্প্রদায় এ ক্ষেত্রেও প্রায়ই লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়, যা কোনো অবস্থায় মেনে নেওয়া যায় না।

দেশে অবৈধ অস্ত্রের অনুপ্রবেশ ঘটে মূলত সমুদ্রোপকূলবর্তী অঞ্চল ও সীমান্ত এলাকা দিয়ে। মূলত এসব এলাকার হাতেগোনা কয়েকজন অবৈধ অস্ত্রের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। অস্ত্র ও বিস্ফোরক প্রবেশের এ রুটে অতন্ত্র প্রহরী নিয়োগ ও নিবিড় গোয়েন্দা তৎপরতার মাধ্যমে গডফাদারদের চিহ্নিত করে আটক করার বদলে নামে মাত্র অস্ত্র উদ্ধারের ফটোসেশন ও বাহক-জাতীয় কিছু হতদরিদ্র মানুষকে আটক করে কাঙ্ক্ষিত সুফল পাওয়া যাবে না। পাহাড়ি এলাকার জঙ্গিরাও নির্বাচনের আগে অবৈধ অস্ত্রের জোগান দিয়ে থাকে। তাই সেদিকেও নজর দিতে হবে। অবৈধ অস্ত্রকেন্দ্রিক বহু মামলাও দীর্ঘদিন বিচারাধীন রয়েছে। এসব মামলার যৌক্তিক নিষ্পত্তি ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিও দিতে পারে স্বস্তির নিঃশ্বাস। সবার আন্তরিকতায় অবৈধ অস্ত্রের অভিশাপ থেকে দেশ, জনগণ ও নির্বাচনব্যবস্থা মুক্তি পাক এটাই প্রত্যাশা।


  • অবসরপ্রাপ্ত মেজর, গবেষক, নিরাপত্তা  বিশ্লেষক

 

 

[email protected]

 

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা