সমাজ
অরূপ তালুকদার
প্রকাশ : ১৮ ডিসেম্বর ২০২৩ ১৩:২৩ পিএম
অসাধারণ মানুষের কথা এখন আর বলতে চাই না। বরং বলতে চাই আমাদের দেশের কোটি কোটি
সাধারণ মানুষের কথা। আমাদের মতো সাধারণ মানুষের কাছে তারাই অসাধারণ যারা সাধারণ মানুষের
ভাগ্য নিয়ন্তা হয়ে সুযোগ-সুবিধামতো আপন ভাগ্য তৈরি করতে পারেন। ৫-১০ বছরের মধ্যে
বিপুল পরিমাণ অর্থবিত্তের মালিক হয়ে দেশে-বিদেশে টাকা পয়সা জমিয়ে নিজের এবং পরিবারের
জন্য নিরাপদ ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতেও পারেন। এদের কারোর ছেলেমেয়েরাই তিন বছরে কোটিপতি
হয়ে যায়, সম্প্রতি এমন খবরই প্রকাশিত হয়েছে গণমাধ্যমে। এখন প্রতিদিন প্রতিটি খবরের
কাগজের পাতায় পাতায় এসব অসাধারণ মানুষদের বিপুল অর্থবিত্ত আর সম্পদের হিসাব প্রকাশিত
হচ্ছে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণে ইচ্ছুক ব্যক্তিদের সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং অফিসারের
কাছে জমা দেওয়া হলফনামা অনুযায়ী। এসব প্রতিবেদন পড়ে পরিষ্কার বোঝা যায়, আমাদের
জনদরদি, ফুলের মতো পরিষ্কার চরিত্রের অসাধারণ মানুষ কীভাবে অতি অল্প সময়ের মধ্যে অর্থবিত্ত
এবং ক্ষমতাবলে অসাধারণ হয়ে উঠেছেন। তাদের স্পর্শ করে এমন ক্ষমতা নেই সাধারণ মানুষের।
এখন আমাদের দেশের একজন অতি সাধারণ মানুষও বুঝে গেছে আমাদের চলমান জাতীয় নির্বাচন
প্রক্রিয়া এবং সেই সঙ্গে আমাদের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি কেন এবং কেমন করে ভয়ানক অনিশ্চয়তার
মধ্যে পড়েছে। সেই কবে থেকে দৈনন্দিন জীবনযাপনের ক্ষেত্রে আমরা যে কঠিন বাস্তবতার
মধ্য দিয়ে চলেছি, তার যেন আর শেষ নেই। কারণ অল্প সময়ের ব্যবধানে বলতে গেলে, আমাদের
নিত্যপ্রয়োজনীয় কোনো জিনিসেরই দাম কমেনি, বরং বিগত সময়ের তুলনায় অনেকটা যেন নিয়ন্ত্রণহীনভাবে
ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। বাজার সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের ধারণা, এর পেছনে সরকারি নিয়ন্ত্রণের
যেমন শৈথিল্য রয়েছে, তেমনি রয়েছে বড় বড় কিছু অসৎ ব্যবসায়ীর ব্যবসায়িক সিন্ডিকেটের
কারসাজি। সম্প্রতি যেমন হঠাৎ করে পেঁয়াজ রপ্তানিবিষয়ক ভারতের একটি ঘোষণার কারণে ২৪
ঘণ্টার মধ্যে দেশের পেঁয়াজের বাজার অস্থির হয়ে ওঠে। তুঙ্গে উঠে গেছে পেঁয়াজের ঝাঁজ।
অর্থাৎ এক দিনে পেঁয়াজের মূল্য কেজিতে বাড়ে ১০০ থেকে ১২০ টাকা। এরকম ঘটনা সম্ভবত
আমাদের দেশেই সম্ভব। মাত্র ১০-১২ ঘণ্টার ব্যবধানে কেজিপ্রতি পেঁয়াজের দাম ২০০ টাকা
হয়ে যাওয়ায় গণমাধ্যমের কাছে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র
সচিব তপন কান্তি ঘোষ। ক্যাব সভাপতি গোলাম রহমান বলেছেন, ‘পেঁয়াজ নিয়ে যা ঘটছে এটাকে
পুকুর চুরি বলা যায় না, সাগর চুরি করা হয়েছে।’
সরকারের বাজার নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা কতটা অকার্যকর হলে কিছু অসৎ মুনাফালোভী
ব্যবসায়ী এরকম ঘটনা ঘটাতে পারে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। বাজার সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের
ধারণা, পেঁয়াজ ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট মাত্র দুই-তিন দিনে ভোক্তাসাধারণকে রীতিমতো জিম্মি
করে বাজার থেকে তুলে নিয়েছে কমপক্ষে প্রায় ১০০ কোটি টাকা। এদিকে অন্য আর যেসব নিত্যপ্রয়োজনীয়
দ্রব্য যেমন চাল ডাল তেল নুন ইত্যাদি, কোনো পণ্যেরই দাম তেমনভাবে কমেনি। এসব জিনিসের
দাম মাত্র এক বছর আগে যেমন ছিল বর্তমানে তার মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছে সত্তর থেকে আশি শতাংশ
পর্যন্ত, কোনো কোনো পণ্যের ক্ষেত্রে তারও বেশি। এসব ক্ষেত্রেও কোনো নিয়ন্ত্রণ কার্যকর
করা সম্ভব হয়নি। যদিও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য মানুষের ক্রয়সীমার মধ্যে রাখার
লক্ষ্যে মাঝে মাঝেই যখন তখন মাঠে নামছেন জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা।
কখনও কখনও পরিচালনা করা হচ্ছে মোবাইল কোর্ট। তারা ক্রেতাদের কাছ থেকে বেশি দাম নেওয়ার
জন্য ছোটবড় ব্যবসায়ীকে জরিমানা করে সতর্ক করে দেন। কোথাও কোথাও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে
কর্তব্যরত সরকারি কর্মকর্তাদের বাক-বিতণ্ডার মতো ঘটনাও ঘটেছে।
গত বছর দেড়েকের ব্যবধানের ১০০ টাকা লিটারের ভোজ্য তেল সয়াবিন ধাপে ধাপে দ্বিগুণ
অর্থাৎ ২০০ টাকা হওয়ার পর অতি মুনাফালোভী ব্যবসায়ীরা থেমেছেন। সরকারি চাপে শেষাবধি
প্রতি লিটার ১৭০ টাকায় এসে আপাতত রফা হয়েছে। চাল ডালের দামও ধাপে ধাপে কেজিপ্রতি
পূর্বের চেয়ে ৪০-৫০ টাকা করে বেড়ে আপাতত থেমেছে। তবে বলা যাচ্ছে না কোন অজুহাতে কোন
পণ্যের দাম পুনরায় আবার বাড়িয়ে দেওয়া হবে। চলমান পরিস্থিতিতে মধ্যবিত্ত আর খেটে
খাওয়া মানুষের সমস্যার যেন কোনো শেষ নেই। মধ্যবিত্তরা লজ্জা শরম ছেড়ে নামতে পারছে
না শ্রমিক বা একেবারে নিম্নবিত্তদের কাতারে। আর খেটে খাওয়া মানুষের জন্য কপাল চাপড়িয়ে
দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া তাদের জন্য আর কোনো পথ খোলা আছে বলে মনে হয় না। বড় রাস্তার
পাশে একটা মনিহারি দোকানের সেলসম্যান চল্লিশ ছুঁই ছুঁই বয়সের শফিউল আলম জানালেন, ‘কি
আর করার আছে বলেন, অবস্থার চাপে কলেজের পড়া ছেড়ে দিয়ে ধারকর্য করে করোনার আগে একটা
মুদি দোকান করেছিলাম। ধার বাকিটাকিসহ মোটামুটি চলছিল। কিন্তু করোনার ধাক্কায় তাও বন্ধ
হয়ে গেছে। হাতে যা কিছু টাকা-পয়সা অবশিষ্ট ছিল, তা দিয়ে সাত-আট মাস চলেছে। পরে অবস্থার
চাপে পড়ে শেষ পর্যন্ত খোঁজাখুঁজি করে অনেক কষ্টে মাসে আড়াই হাজার টাকার এই চাকরিটা
জোটানো গেছে। আল্লাহর ইচ্ছায় এই দিয়েই এখনো চলছে।’ জিজ্ঞেস করি, এই দুর্মূলের বাজারে
এই টাকায় সংসার চলে? শফিউল বলেন, আগের মতো চলে না, ‘চারজনের সংসারের একটা একটা করে
খরচ কমানোর পর এখন চলে। খাবার পাতে মাছ মাংসের বদলে চলছে ডিম।’ আর কোনো প্রশ্ন করিনি
তাকে ।
এখন কোথাও যেতে রিকশায় উঠে অনেকের মতো আমিও রিকশাওয়ালাদের সঙ্গে কথাবার্তা
বলি, অহেতুকভাবে তার বাড়িঘর, সংসারের খোঁজখবর নিই। কদিন আগে রাস্তায় চলমান বেশ বড়
একটা নির্বাচনী মিছিল চলে যাওয়ার পর রাস্তার পাশে দাঁড়ানো অপেক্ষাকৃত কম বয়সের কিছুটা
চালাক চেহারার এক রিকশাওয়ালার রিকশায় উঠে তাকে প্রশ্ন করেছিলাম, নাম কী? উত্তরে বলল,
সালাম। তারপর জিজ্ঞাস করি, কেমন চলছে দিনকাল? সে হাসতে হাসতে বলে, ‘ভালোই তো, ওই যে
দেড়শ টাকার খেপ গেল গা।’ বললাম, তুমি গেলে না কেন? দেড়শ টাকা পেয়ে যেতে। রিকশার
প্যাডেলে চাপ দিয়ে সে বলতে থাকে, ‘ওইটা বড় দলের গান স্যার, মোরা দিন আনি, দিন খাই…বড়
দলের গানে নাই।’ আমি অবাক হই ওর কথা শুনে। ভাবি, সামনে নির্বাচন। শফিউল আর সালাম, কাদের
দল ভারী হচ্ছে দিনে দিনে?