× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

ফিরে দেখা

মুক্তিযুদ্ধে ফুটবলারদের ভূমিকা

ইকরামউজ্জমান

প্রকাশ : ১৫ ডিসেম্বর ২০২৩ ১৩:৫১ পিএম

মুক্তিযুদ্ধে ফুটবলারদের ভূমিকা

জাতির জীবনে গৌরবোজ্জ্বল দিন বিজয় দিবস। ৫২ বছর পেরিয়ে ৫৩-তে পদার্পণ। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ১৯৭১ সালের এই দিনে চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করে বাঙালি। সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফসল আমাদের  বিজয় দিবস। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে প্রবন্ধ, কবিতা, গল্প, উপন্যাসের কমতি নেই, নির্মিত হয়েছে চলচ্চিত্রও। অবাক হওয়ার বিষয় হলো, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে খেলার মাঠের খেলোয়াড়, ক্রীড়াবিদ ও সংগঠকদের স্মরণীয় ভূমিকা কিন্তু উপেক্ষিত থেকে গেছে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ইংল্যান্ডে পাকিস্তান জাতীয় দলের সফরের বিরুদ্ধে প্রতিদিন বিভিন্ন স্থানে প্রতিবাদ, অবরোধ, সমাবেশ, বিক্ষোভ হয়। বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে গিয়ে অনেকেই গ্রেপ্তার হয়ে জেল খেটেছেন। সমস্ত দুনিয়াকে জানানো হয় পাকিস্তান সামরিক জান্তার বর্বরতা নিরীহ মানুষের ওপর। এ খবর তো বর্তমান প্রজন্মের কাছে অজানাই থেকে গেছে। এটি কিন্তু ক্রীড়া ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় ও দলিল। বিষয়টি গুরুত্ব না পাওয়ায় এ ক্ষেত্রে বছরের পর বছর ধরে বিতর্ক চলছে।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে শুধু ফুটবলারই নন, সাঁতারু ও সাইক্লিস্টরাও স্মরণীয় অবদান রেখেছেন। এ নিবন্ধে শুধু মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ফুটবল খেলোয়াড় ও সংগঠকদের ভূমিকা অতিসংক্ষেপে আলোচনা করছি। ভারতে অবস্থানরত পূর্ব পাকিস্তানের যেসব খেলোয়াড় আন্তর্জাতিক এবং প্রথম বিভাগে ফুটবল খেলেছেন, যারা বিভিন্ন শরণার্থী ক্যাম্পে আছেন তাদের একত্র করে যদি একটি ফুটবল দল গঠন সম্ভব হয় আর এ দলটি যদি ভারতের বিভিন্ন স্থানে প্রদর্শনী ফুটবল ম্যাচ খেলে। খেলায় অংশগ্রহণ করে যে অর্থ সংগৃহীত হয় তা প্রবাসী সরকারে হস্তান্তর করা হয়। ফুটবলার আলী ইমামের এই চিন্তার সঙ্গে একমত হলেন শিক্ষা ও সামাজিক কার্যক্রমের সংগঠক (পরে অবশ্য তিনি ক্রীড়া সংগঠক হিসেবে পরিচিত হয়েছেন) লুৎফর রহমান। কলকাতার একটি বাংলা ও ইংরেজি দৈনিকে আলী ইমাম ও লুৎফর রহমানের ঠিকানা উল্লেখ করে ফুটবলারদের যোগাযোগ করার জন্য অনুরোধ করা হয়। আশাব্যঞ্জক সাড়া মেলে। এগিয়ে আসেন ফুটবলার সাইদুর রহমান প্যাটেল ও রাজনৈতিক কর্মী মোহাম্মদ মহসীন।

ফুটবল দল গঠন করতে হলে তো মুজিবনগর সরকারের অনুমতি লাগবে। অনুমতি লাগবে ভারত সরকার ও ফুটবল সংস্থারও। তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে দেখা করলেন আওয়ামী লীগ নেতা শামসুল হকের নেতৃত্বে লুৎফর রহমান, সাইদুর রহমান প্যাটেল, মোহাম্মদ মহসীন প্রমুখ। প্রধানমন্ত্রী ফুটবল দল গঠনকে স্বাগত জানালেন। প্রয়োজনীয় কিছু বিষয় নিয়ে কথাও বললেন। আশ্বাস দিলেন ভারত সরকারের অনুমতি এবং ফুটবল সংস্থার সবুজ সংকেতের বিষয়টা তিনি দেখবেন। শুধু তাই নয়, তাৎক্ষণিকভাবে কিছু রুপিও বরাদ্দ করলেন। ১৯৭১ সালের ১৩ জুন মো. শামসুল হককে সভাপতি এবং লুৎফর রহমান ও মোহাম্মদ মহসিনকে যথাক্রমে সাধারণ সম্পাদক ও কোষাধ্যক্ষ মনোনীত করে ‘বাংলাদেশ ক্রীড়া সমিতি’ গঠন করা হয়। রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী তার ‘৭১ এর দশ মাস’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘খেলোয়াড়গণ হাতের রাইফেল, বুকের হেভার শেকের ব্যাগ নামিয়ে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের পরিচিতি নিয়ে মাঠে নামার পরিকল্পনা গ্রহণ করলেন।’

স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের অধিনায়ক এবং সহ-অধিনায়ক মনোনীত করা হয় যথাক্রমে মো. জাকারিয়া পিন্টু ও প্রতাপ শঙ্কর হাজরাকে। তারা দুজনই কৃতী আন্তর্জাতিক ফুটবলার। ফুটবল কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বালুরঘাট থেকে জাকারিয়া পিন্টুকে কলকাতায় আনা হয়। ফুটবলারদের একত্রে থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল ‘কারনারি এস্টেট বিল্ডিং’-এর একটি ফ্ল্যাটে। ওই ক্যাম্পে জড়ো হয়েছিলেন ৩০ জনের বেশি খেলোয়াড়। কয়েক দিন ট্রায়ালের পর তাদের মধ্য থেকে ২৫ জনকে চূড়ান্ত বাছাই করে অন্যদের মুক্তিযুদ্ধ ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে ফুটবল খেলোয়াড় ও সংগঠকদের কার্যকর ভূমিকা ক্রীড়াঙ্গনের ইতিহাসে সব সময় স্মরণীয়। আর কোনো দেশের স্বাধীনতার জন্য রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের সময় ফুটবলাররা তাদের হাতিয়ার ক্যাম্পে জমা রেখে নতুন আরেকটি ‘ফ্রন্ট’ খুলে স্বাধীনতার পক্ষে বিশ্বজনমত গড়ে তুলেছেন এবং সমর্থন লাভের জন্য এ ধরনের ভূমিকা পালন করেছেন এর নজির নেই। খেলার মাঠে মুক্তিযুদ্ধ ছিল স্বাধীনতার জন্য মুখিয়ে থাকা জাতির জন্য অনেক বড় সাহস, আত্মবিশ্বাস ও অনুপ্রেরণা।

মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোয় ফুটবলাররাই প্রথম বিদেশের মাটিতে লাল-সবুজের পতাকা উত্তোলন করেন হাজার হাজার মানুষের সামনে। এটি বাঙালির ইতিহাসে তা ঐতিহাসিক ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। বাংলাদেশ ফুটবল দলের প্রথম ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭১ সালের ২৫ জুলাই রবিবার নদীয়ার কৃষ্ণনগরে। ম্যাচ শুরুর আগে অধিনায়ক জাকারিয়া পিন্টু এবং খেলোয়াড়রা ভারতের জাতীয় পতাকা ও জাতীয় সংগীতের পাশাপাশি বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন ও জাতীয় সংগীত বাজানোর অনুরোধ জানান। কিন্তু বাংলাদেশ যেহেতু তখনও স্বীকৃত দেশ নয়, এ কারণে ভারতের ক্রীড়া কর্তৃপক্ষ এ দাবি প্রথমে মানতে রাজি হননি। উপস্থিত দর্শক আর বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের পীড়াপীড়িতে নদীয়ার জেলাশাসক ডি কে ঘোষ শেষ পর্যন্ত রাজি হন এবং অনুমতি দেন। এ দিনটি ছিল বাংলাদেশের জন্য ঐতিহাসিক। মাঠে জাতীয় সংগীত বাজে। বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে মাঠ প্রদক্ষিণ করেন খেলোয়াড়রা। এ ঘটনা যুদ্ধরত বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের দারুণভাবে অনুপ্রাণিত করে। প্রথম খেলাটি ড্র হয়েছিল ২-২ গোলে।

বাংলাদেশ দলের দ্বিতীয় ম্যাচটি অনুষ্ঠিত হয় কলকাতায়। মোহনবাগান অ্যাথলেটিকস ক্লাব আইনের বিভিন্ন ধরনের জটিলতার জন্য নিজ নামে না খেলে খেলেছে ‘গোষ্ঠ পাল একাদশ’ নামে। ৮ আগস্ট, ১৯৭১ অনুষ্ঠিত এ খেলাটি ব্যাপক সাড়া জাগাতে সক্ষম হয়। গোষ্ঠ পাল নিজে এ খেলার উদ্বোধন করেন। চুনী গোস্বামী অধিনায়ক হিসেবে খেলেন। গোষ্ঠ পাল ও চুনী গোস্বামী উভয়েই পূর্ব বাংলার সন্তান। খেলায় বাংলাদেশ ২-৪ গোলে পরাজিত হয়। বাংলাদেশ তৃতীয় প্রদর্শনী ম্যাচ খেলে দক্ষিণ কলকাতা স্পোর্টস ফেডারেশনের বিপক্ষে। খেলায় বাংলাদেশ ৪-২ গোলে জেতে। ভারতের ফুটবলের স্বর্ণযুগের কিংবদন্তি ফুটবলার উমাপতি কুমার মাঠে উপস্থিত ছিলেন। এভাবে ভারতের বিভিন্ন স্থানে বাংলাদেশ দল ১৪টি প্রদর্শনী ম্যাচ খেলে। বীর মুক্তিযোদ্ধা-খেলোয়াড় অনেকেই এ আলোছায়ার পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। বীর মুক্তিযোদ্ধা-খেলোয়াড়রা আমাদের গর্ব। আমাদের অহংকার। ক্রীড়াঙ্গনের শ্রেষ্ঠ সন্তান। আর তো কেউ কখনও এ ধরনের গৌরবে গৌরান্বিত হওয়ার সুযোগ পাবেন না। বাঙালির জীবনে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ চির-অম্লান। এ চেতনা তুলনাহীন। ইতিহাসে অক্ষয় অধ্যায় হয়ে আসছে সেই দিনগুলো।


  • ক্রীড়া-বিশ্লেষক। সাবেক সিনিয়র সহসভাপতি এআইপিএস, এশিয়া
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা