আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি
ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী
প্রকাশ : ১১ ডিসেম্বর ২০২৩ ১১:৩০ এএম
ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী
বিশ্বব্যাপী অনাকাঙ্ক্ষিত
বন্যা-খরা-জলোচ্ছ্বাস-ঘূর্ণিঝড়-অতিবৃষ্টি-অনাবৃষ্টি-দাবানল-দাবদাহসহ জলবায়ু পরিবর্তনের
নানামুখী বৈরী প্রভাবের কঠিন আর্তনাদ অধিকমাত্রায় পরিলক্ষিত। সচেতন মহলের মতে, পরিবেশ
দূষণের ফলে সব নেতিবাচক প্রাকৃতিক কর্মযজ্ঞের জন্য উন্নত বিশ্বই দায়ী। অনুন্নত বা উন্নয়নশীল
দেশের তুলনায় বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে অব্যাহত বিপর্যস্ততা কোন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছাবে কোনো
গবেষণায় তা সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত হচ্ছে না। এটি সুস্পষ্ট যে, অদূর ভবিষ্যতে লণ্ডভণ্ড
বিশ্ব অধিকতর প্রতিকূলতায় সামগ্রিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবে। বহু বছর ধরেই জলবায়ু
পরিবর্তন-তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে মেরু অঞ্চলে বরফ গলা ও সাগরের উচ্চতা বেড়ে যাওয়ার
দুঃসহ সংবাদ প্রচারিত। শীতপ্রধান ইউরোপসহ বৈশ্বিক উষ্ণতায় পুড়ছে পুরো ধরিত্রী। বৈশ্বিক
উষ্ণতায় একদিকে যেমন শীতকাল কমে আসছে অন্যদিকে দীর্ঘ হচ্ছে গ্রীষ্ম ও তীব্র থেকে তীব্রতর
হচ্ছে গরম। গণমাধ্যমে পরিবেশিত এনভায়রনমেন্ট এজেন্সির প্রতিবেদন অনুসারে, ইউরোপে ১৯৮০
থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত বন্যা-ঝড়-তাপ-শৈত্যপ্রবাহের কারণে প্রায় ১ লাখ ৯৫ হাজার মানুষ
মারা যায়। ৮১ শতাংশের মৃত্যু হয়েছে শুধু তাপপ্রবাহের জন্য। সংস্থাটির তথ্যমতে, মানবসৃষ্ট
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ২০২২ সালে মেরুকরণের ঝুঁকি ৫ থেকে ৬ গুণ বেড়েছে এবং একই বছরে
দাবানলে অতীতের তুলনায় দ্বিগুণ বনাঞ্চল ধ্বংস হয়েছে।
দীর্ঘদিন ধরে জলবায়ু পরিবর্তন সমগ্র বিশ্বের সমস্যা হলেও বাংলাদেশের মতো দরিদ্র দেশগুলো এর ভয়াবহ পরিণতি ভোগ করছে সবচেয়ে বেশি। দেশের সমগ্র জনগোষ্ঠীর জীবনপ্রবাহসহ যাবতীয় উন্নয়ন উদ্যোগ তথা দারিদ্র্য দূরীকরণ, দুর্যোগ প্রস্তুতি ও ব্যবস্থাপনা, কৃষি, খাদ্যনিরাপত্তা, পানি সরবরাহ, পয়ঃনিষ্কাষণ ও জনস্বাস্থ্য, পল্লী উন্নয়ন ইত্যাদি কর্মযজ্ঞ ব্যাপকভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। সবচেয়ে বেশি জনদুর্ভোগে নিপতিত হয়েছে গরিব ও প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষ। আন্তঃসরকারি প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ (আইপিসিসি) অ্যাসেসমেন্ট রিপোর্টে ধারণা করা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশে দারিদ্র্য প্রায় ১৫ শতাংশ বৃদ্ধি হবে। মানবসৃষ্ট উষ্ণায়নের কারণে জিডিপি উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পাবে এবং গড় আয় ২১০০ সালে ৯০ শতাংশ কমে যাবে। বর্তমানে বাংলাদেশ বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি ও বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে পৃথিবীর অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ দেশের তালিকায় রয়েছে। ক্লাইমেট ভালনারেবল ইনডেক্স ২০২৩ অনুযায়ী ১৯২টি ঝুঁকিপূর্ণ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম।
প্রধানমন্ত্রী
শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বে অদম্য উন্নয়ন-অগ্রগতিতে বিশ্বস্বীকৃত বাংলাদেশ সরকার
ইতোমধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সৃষ্ট ঝুঁকিগুলো শনাক্ত করে দুর্যোগঝুঁকি কমানোর
ক্ষেত্রে অনেক অগ্রগতি অর্জন করেছে। ঘূর্ণিঝড়ের সময় আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহারের
উদ্দেশ্যে উপকূলীয় এলাকায় বহু ভবন নির্মাণ করায় দুর্যোগে মৃত্যুহার উল্লেখযোগ্যভাবে
হ্রাস পেয়েছে। তবে সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি ও উপার্জন হারানোর হার ক্রমে বৃদ্ধি পাচ্ছে। সরকার
সীমিত সম্পদের মধ্যে জলবায়ু অভিবাসীদের জন্য বিশেষ উদ্যোগে অগ্রাধিকারভিত্তিক আশ্রয়ণ
প্রকল্পের আওতায় কক্সবাজারে ঘূর্ণিঝড়ের কারণে বাস্তুচ্যুত ৪ হাজার ৪০০ পরিবারকে নিরাপদ
বাসস্থান দিতে ১৩৯টি বহুতল ভবন নির্মাণ অব্যাহত রেখেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার
বিশেষ উদ্যোগে ২০০৯-১০ অর্থবছরে সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ড
(সিসিটিএফ) গঠন করা হয়। জলবায়ু পরিবর্তনে দায়ী উন্নত দেশের অর্থ প্রাপ্তির জন্য অপেক্ষা
না করে নিজস্ব অর্থায়নে এ ধরনের তহবিল গঠন বিশ্বে প্রথম; যা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে
বিশেষভাবে প্রসংশিত হয়েছে।
সম্প্রতি ইন্টারন্যাশনাল
অর্গানাইজেশন ফর মাইগ্রেশন (আইওএম) কাউন্সিলের ১১৪তম অধিবেশনে ‘মানব গতিশীলতায় জলবায়ুর
প্রভাব : সমাধানের একটি বৈশ্বিক আহ্বান’ শীর্ষক বৈঠকে ভিডিওবার্তায় প্রধানমন্ত্রী জলবায়ু
পরিবর্তনজনিত বাস্তুচ্যুতি মানবিক সংকটে পরিণত হওয়ার আগেই বিশ্বকে এ ব্যাপারে পদক্ষেপ
নেওয়ার জোরালো আহ্বান জানান। প্রধানমন্ত্রীর বার্তা মারফত জানা যায়, জলবায়ু পরিবর্তনের
কারণে ২০৫০ সালের মধ্যে ২১ কোটি ৬০ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হতে পারে। এর মধ্যে শুধু
দক্ষিণ এশিয়ায়ই থাকবে ৪ কোটি। বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ২০ শতাংশ উপকূলে সমুদ্রপৃষ্ঠের
উচ্চতা বৃদ্ধি, লবণাক্ততার অনুপ্রবেশ, ঘন ঘন বন্যা এবং মারাত্মক সাইক্লোন জোরপূর্বক
বাস্তুচ্যুতির ঝুঁকিতে ফেলে। তিনি মানুষের গতিশীলতার ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব
মোকাবিলায় পাঁচটি পরামর্শও তুলে ধরেন। সেগুলো হচ্ছে : নিরাপদ-সুশৃঙ্খল ও নিয়মিত অভিবাসন
সম্পর্কিত গ্লোবাল কমপ্যাক্টের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে মানবাধিকারভিত্তিক পদ্ধতিতে মানব
গতিশীলতায় জলবায়ু প্রভাব মোকাবিলা; জলবায়ু অভিবাসীদের পরিস্থিতি জলবায়ু ন্যায়বিচারের
দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করা যাতে তারা যে ক্ষতি ও ধ্বংসের সম্মুখীন হয় তার প্রেক্ষাপট-নির্দিষ্ট
সমাধান খুঁজে বের করা যায়; অভিবাসনকে জলবায়ু অভিযোজন কৌশল হিসেবে দেখার জন্য আমাদের
অবশ্যই স্থানীয়-জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রস্তুত থাকতে হবে যাতে এটি সর্বোত্তম
সম্ভাব্য সমাধান হিসেবে প্রমাণিত হয়।
৩০ নভেম্বর, ২০২৩
যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত সাপ্তাহিক নিউজ ম্যাগাজিন নিউজউইকে প্রকাশিত জলবায়ু পরিবর্তনের
ওপর লেখা এক নিবন্ধে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তন হলো একটি বৈশ্বিক বিপর্যয়
যা গরিবদের ওপর ধনীরা চাপিয়ে দেয় এবং ক্রমবর্ধমান হারে এটি তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া
হয়। দুবাই কপ-২৮ জলবায়ু সম্মেলনের জন্য আমন্ত্রিত বিশ্বনেতাদের বুঝতে হবে যে তাদের
টপডাউন (ওপর থেকে নিচে) পদ্ধতি কখনোই কাজ করতে পারে না। বরং জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার
লড়াইয়ের জন্য আমাদের ক্ষতিগ্রস্তদের দায়িত্ব নিতে হবে এবং এ লড়াইয়ে তাদের অর্থায়ন করতে
হবে।’ প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে যৌথভাবে নিবন্ধটি লিখেছেন গ্লোবাল সেন্টার অন অ্যাডাপশনের
সিইও প্যাট্রিক ভারকুইজেন। ওই নিবন্ধে আরও বলা হয়, ‘জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় নেতাদের
মতদ্বৈধে জলবায়ু বিপর্যয় থেমে থাকবে না। এর ফলে ইতোমধ্যে জনপদের ওপর টাইফুন ও বন্যা
হচ্ছে এবং খরার কারণে ফসল উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় ক্ষুধা ছড়িয়ে পড়ছে। জলবায়ু তহবিলের একটি
ক্ষুদ্র অংশ জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে খারাপ প্রভাবের সঙ্গে লড়াই করা লোকদের কাছে পৌঁছায়।
জীবিকা রক্ষায় প্রয়োজনীয় সংস্থান ছাড়া তারা আরও দুর্বল হয়ে পড়ছে। জলবায়ু অনাচার ও বৈষম্য
আরও বাড়ছে। জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্তদের প্রথম সারিতে থাকা মানুষকে রক্ষায় সাহায্য
না করলে বৈশ্বিক পর্যায়ে জলবায়ু কার্যক্রমের কোনো মানে হয় না।’
অতিসম্প্রতি জলবায়ু বিষয়ক কর্মকাণ্ডে নেতৃত্বের বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর হিসেবে এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিযুক্ত মানুষের পক্ষে বিশ্বব্যাপী অবদানের বিশেষ স্বীকৃতিস্বরূপ ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর মাইগ্রেশন (আইওএম) এবং জাতিসংঘ সমর্থিত গ্লোবাল সেন্টার ফর ক্লাইমেট মবিলিটি সংস্থা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘ক্লাইমেট মবিলিটি চ্যাম্পিয়ন লিডার অ্যাওয়ার্ডে’ ভূষিত করেছে। দুবাইয়ে অনুষ্ঠিত বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন কপ-২৮-এর সাইডলাইনে উচ্চ পর্যায়ের এক অধিবেশনে এ পুরস্কার প্রদান করা হয়। সম্ভাষিত নতুন পালক যেন অবিনাশী মুকুটে সুসজ্জিত করেছে বিশ্বনন্দিত ও বরেণ্য সফল এই রাষ্ট্রনায়ককে। আসন্ন সংসদ নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রী আন্তর্জাতিক এ পুরস্কার অর্জনে শুধু নিজেই পুষ্পিত হননি; বাংলাদেশকে বিশ্বের বুকে এক ঈর্ষণীয় পর্যায়ে অধিষ্ঠিত করেছেন। প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দন।