সম্পাদকীয়
সম্পাদক
প্রকাশ : ১০ ডিসেম্বর ২০২৩ ১২:৩৬ পিএম
প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষার স্তর পর্যন্ত কদাচারের ছায়া কতটা বিস্তৃত
তা ভাবলে বিস্মিত এবং যুগপৎ ক্ষুব্ধ না হয়ে উপায় থাকে না। অনেক ক্ষেত্রেই পরীক্ষা তো
বটেই এমনকি শিক্ষক নিয়োগেও অনিয়ম-দুর্নীতির ডালপালা কতটা ছড়িয়েছে, তা-ই ফের উঠে এসেছে
৯ ডিসেম্বর প্রতিদিনের বাংলাদেশে প্রকাশিত প্রতিবেদনে। ‘প্রাথমিকের নিয়োগ পরীক্ষায়
ব্যাপক জাল-জালিয়াতি’ শিরোনামে প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে যে তথ্য উঠে এসেছে তাতে সঙ্গতই
প্রশ্ন জাগেÑ অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকরা শিক্ষার্থী কিংবা প্রজন্মের
জন্য কতটা হিতকর। তর্কাতীতভাবে বলা যায়, এই প্রশ্নের উত্তর কোনোভাবেই প্রীতিকর নয়।
৮ ডিসেম্বর প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের যে বিস্তৃত জালের সন্ধান
মিলেছে তাতে এ প্রশ্নও জাগে, এর শেষ কোথায়! কোমলমতি শিক্ষার্থীরা তাদের মতো ব্যক্তির
কাছে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি নীতি-নৈতিকতার কী পাঠ নেবে? জালিয়াত চক্রের সঙ্গে
যোগসাজশে ডিজিটাল ডিভাইসের মাধ্যমে পরীক্ষার্থীদের অনেকেই নকল করে পরীক্ষায় পাসের কসরত
করেছিলেন!
সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ, জনপ্রতি ১০-১৫ লাখ টাকার বিনিময়ে সরকারি প্রাথমিক
বিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার যারা ছক কষেছিলেন, তারা জাতির মেরুদণ্ড শিক্ষার স্তম্ভে আঘাতকারী
তো বটেই একই সঙ্গে নীতি-নৈতিকতার পাট চুকিয়ে অবক্ষয়ের কাদাজলে ডুবে ভবিষ্যৎ কর্ণধারদের
কী শিক্ষা দিতেন? এই প্রশ্নের উত্তরও প্রীতিকর নয়। নিয়োগ পরীক্ষায় অনিয়ম-দুর্নীতি নতুন
কিছু নয়। শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায়ও ইতঃপূর্বে এমন অবক্ষয়ের নজির আছে। প্রাতিষ্ঠানিক কিংবা
নিয়োগ পরীক্ষার ক্ষেত্রে জাল-জালিয়াতির উপাখ্যান অনেক দীর্ঘ হলেও এর কোনো স্থায়ী প্রতিবিধান
কেন নিশ্চিত করা যায়নি, এই প্রশ্ন আমাদের অধিকতর ক্ষুব্ধ না করে পারে না। প্রাথমিক
শিক্ষাস্তর হচ্ছে শিক্ষার মূল ভিত্তি। গোড়াতেই যদি ব্যাধির উপশম করা না যায় তাহলে পরবর্তী
ধাপে এর পরিণাম কতটা ভয়াবহ হতে পারে, এরও ব্যখ্যা-বিশ্লেষণ নিষ্প্রয়োজন। প্রকাশিত সংবাদ
থেকে জানা গেছে, শিক্ষক-কর্মচারী ও কতিপয় পরীক্ষার্থীর মাধ্যমে জালিয়াত চক্রের যোগসাজশে
প্রশ্ন বাইরে আসে এবং তা দ্রুত সমাধান করে ভেতরে পৌঁছে দেয় চক্রটি। চাকরিজীবী শিক্ষক
ও কতিপয় ছাত্রলীগ নেতারও জালিয়াত চক্রের সঙ্গে যোগসাজশের বার্তা সংবাদমাধ্যমেই উঠে
এসেছে। গোয়েন্দা তথ্যে প্রকাশ, ওই নিয়োগ পরীক্ষায় জালিয়াতিতে জড়িত চক্রের পাঁচ সদস্য,
পরীক্ষার্থীসহ এই সম্পাদকীয় লেখা পর্যন্ত ১২২ জনকে আটক করা হয়। প্রতারক চক্রের জাল
একেবারে প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত ছড়ানোর খবরও জানা যায়।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালকের বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, জালিয়াত
চক্র অনৈতিক উপায়ে পরীক্ষার্থীদের পাস করিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে বলে গোয়েন্দা
তথ্য ছিল। আমরা গোয়েন্দাদের সতর্কতা ও তৎপরতার জন্য সাধুবাদ জানাই। জেলা-উপজেলা পর্যায়ে
অসাধু চক্র এতটাই কৌশলী ফাঁদ পেতেছিল এবং এর সঙ্গে অসদুপায় অবলম্বন করে কৃতকার্য হওয়ার
জন্য তথাকথিত পরীক্ষার্থীরা শিক্ষক হওয়ার জন্য যে অরুচিকর কাণ্ড ঘটিয়েছেন এর নিন্দা
জানানোর ভাষা আমাদের জানা নেই। আমরা মনে করি, এই গুরুতর ব্যাধির উপশম কোনোভাবেই টোটকা
দাওয়াইয়ে সম্ভব নয়। শিক্ষাদানের মতো মহৎ কর্মে যারা যুক্ত, তাদের মধ্যে কেউ কেউ যে
এর আগে এমন ঘৃণ্য পথ অবলম্বন করে যুক্ত হননি এরই বা নিশ্চয়তা কী? আমরা মনে করি, অতীতে
যেসব অনিয়মের নিয়োগ হয়েছে, সেজন্য নিয়োগকর্তাদের জবাবদিহহি আদায়ের পাশাপাশি নিয়োগপ্রাপ্তদের
বিরুদ্ধে যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। শিক্ষা খাতে অনিয়ম-দুর্নীতির বিষবৃক্ষের
ডালপালা ছড়ানোর অভিযোগ পুরোনো। এ-ও অভিযোগ আছে, রাজনৈতিক বিবেচনা ও স্বজনপ্রীতির কারণেই
শিক্ষক নামের কতিপয় প্রাণীমাত্র শিক্ষক সমাজের ললাটে কলঙ্কচিহ্ন এঁকে দিচ্ছেন। তারা
কোনোভাবেই দেশ-জাতির মিত্র হতে পারেন না। এই সম্পাদকীয় স্তম্ভে আমরা ইতঃপূর্বে বলেছি,
শিক্ষার মান নিশ্চিত করতে হলে সর্বাগ্রে মানসম্মত শিক্ষক প্রয়োজন। কিন্তু কদাচারের
পথ মাড়িয়ে কেউ যদি এক্ষেত্রে যুক্ত হন তাহলে এর বিরূপ প্রভাব কতটা ভয়াবহ হতে পারে এরও
ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ নতুন করে নিষ্প্রয়োজন।
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা তো বটেই, নিয়োগ পরীক্ষার ক্ষেত্রেও প্রশ্নপত্র
ফাঁস ও অবৈধভাবে নিয়োগের মতো দুরারোগ্য ব্যাধির উপশমে নির্মোহ ও কঠোর অবস্থানের বিকল্প
নেই। এ বিষয়ে ইতোমধ্যে কথা হয়েছে যত, কাজ হয়নি তত এবং এরই ফের প্রমাণ পাওয়া গেল প্রাথমিক
শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষার ক্ষেত্রে। যদি প্রশ্নপত্র ফাঁসের মতো গুরুতর ব্যাধিসম অপরাধের
দৃষ্টান্তযোগ্য প্রতিকারের নজির থাকত তাহলে এর পুনরাবৃত্তি হয়তো ঘটত না। আমরা প্রাথমিক
শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় জাল-জালিয়াতির কঠোর প্রতিকার দেখতে চাই।