শ্রদ্ধাঞ্জলি
নাছিমা বেগম
প্রকাশ : ০৯ ডিসেম্বর ২০২৩ ১২:২১ পিএম
আমাদের সমাজ ও
সাহিত্যাঙ্গনে নারীজাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন অনন্য আসনে
অধিষ্ঠিত। বেগম রোকেয়ার জন্ম উনিশ শতকের বাংলাদেশে। তখন ভারতবর্ষে নারীদের বিশেষ করে
মুসলিম নারীদের অবস্থা ছিল অত্যন্ত শোচনীয়। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত মুসলিম নারীদের
পর্দার নামে কার্যত কঠোর অবরোধের মধ্যে বন্দি জীবন যাপন করতে হতো। শিক্ষার আলো
তাদের জন্য ছিল নিষিদ্ধ। এমনই একসময়ে একজন বিশিষ্ট সমাজকর্মী ও সমাজসংস্কারক
হিসেবে বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের আবির্ভাব ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
দেশের ও সমাজের সার্বিক উন্নয়নের গতিকে ত্বরান্বিত করার অভিপ্রায়ে নারীর
ব্যক্তিসত্তা বিকাশের লক্ষ্যে তিনি চেয়েছিলেন নারীমুক্তি ও নারী স্বাধীনতা। সেই
সময়টাকে অনেকেই এ দেশের নবজাগরণ বা রেনেসাঁসের কাল বলে গণ্য করেছেন।
‘বোরকা’ প্রবন্ধে সব নিয়মেরই একটা সীমা
আছে উল্লেখ করে বেগম রোকেয়া লিখেছেন, ‘এ দেশে আমাদের অবরোধপ্রথাটা বেশি কঠোর হইয়া
পড়িয়াছে। যেমন অবিবাহিতা বালিকাগণ স্ত্রীলোকের সহিতও পর্দা করিতে বাধ্য থাকেন।’ এ প্রবন্ধে
তিনি অন্যায় পর্দা ছেড়ে আবশ্যকীয় পর্দার পক্ষে থাকলেও তার মূল বক্তব্য ছিল
উন্নতির জন্য অবশ্যই উচ্চশিক্ষা প্রয়োজন। তার মতে শিক্ষার অভাবই নারীর
স্বাধীনতালাভের প্রধান অন্তরায়। এ প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন, ‘একখানা জ্ঞানগর্ভ
পুস্তক পাঠে যে অনির্বচনীয় সুখ লাভ হয়, দশখানা অলঙ্কার পরিলে তাহার শতাংশের
একাংশের একাংশ সুখও পাওয়া যায় না। অতএব শরীর-শোভন অলঙ্কার ছাড়িয়া জ্ঞান-ভূষণ লাভের
জন্য ললনাদের আগ্রহ বৃদ্ধি হওয়া বাঞ্ছনীয়।’ তিনি ‘অলঙ্কারের টাকা দ্বারা জেনানা
স্কুলের’ পক্ষে তার জোরালো অবস্থান তুলে ধরেন।
বেগম রোকেয়ার উল্লেখিত উক্তিগুলো
বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, মুসলিম নারীমুক্তির প্রথম প্রবক্তা হিসেবে তিনি সুনিপুণ
লেখনীর বাস্তব রূপায়ণের জন্য নিজেকে পুরোপুরি সমর্পণ করেছিলেন। নারীকল্যাণের
উদ্দেশ্যে প্রাতিষ্ঠানিক স্তরে নারীর শিক্ষাবিস্তারে তিনি গভীর অন্ধকারে শিক্ষার
মঙ্গল প্রদীপ জ্বালিয়ে সমাজের ভবিষ্যৎ জননীদের গড়ে তোলার ভার নিজের হাতে তুলে
নিয়েছিলেন। ১৯১১ সালে তিনিই প্রথম মুসলিম বালিকাদের জন্য ‘সাখাওয়াত মেমোরিয়াল
স্কুল’ প্রতিষ্ঠা করেন। এর পাশাপাশি মুসলিম নারীদের সংঘবদ্ধ করার প্রয়োজনীয়তাও
তিনি উপলব্ধি করেন। মুসলিম নারীদের একতাবদ্ধ করে তাদের সামাজিক জীবন গঠন ও অধিকার
প্রতিষ্ঠা এবং দেশ ও জাতি সম্পর্কে সচেতনতাবোধ জাগ্রত করার লক্ষ্যে বেগম রোকেয়া
১৯১৬ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে ‘আঞ্জুমানে খাওয়াতীনে ইসলাম’ নামে প্রথম ‘মুসলিম
মহিলা সমিতি’ প্রতিষ্ঠা করেন। বেগম রোকেয়ার সহযাত্রী শামসুন নাহার মাহমুদের রচিত ‘রোকেয়া-
জীবনী’ গ্রন্থ থেকে এ বিষয়ে একটি স্বচ্ছ ধারণা পাওয়া যায়। শামসুন নাহার মাহমুদ
তার গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, মৃত্যুর কিছুদিন আগে একদিন তিনি বেগম রোকেয়াকে
বলেছিলেন, তার বৈচিত্র্যপূর্ণ জীবনের ঘটনাগুলো সংগ্রহ করা প্রয়োজন। উত্তরে তিনি
বলেছেন, ‘আঞ্জুমানের কাগজপত্র পর্যালোচনা করিয়া দেখ, আমার কর্মজীবনের বহু কথা
তাহারই মধ্যে খুঁজিয়া পাইবে।’
দেশ ও সমাজের স্বার্থে আঞ্জুমানে
খাওয়াতীনে ইসলামের কার্যাবলির ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। স্বদেশীয় খেলাফত আন্দোলনের
সময় বেগম রোকেয়ার নেতৃত্বে এই সমিতি দেশ ও সমাজের বহু কাজ করেছে। এ সমিতির
সদস্যরা বাড়ির বাইরে এসে সক্রিয় এবং প্রত্যক্ষভাবে স্বদেশী আন্দোলনের সঙ্গে
যুক্ত হতে না পারলেও মুসলিম মেয়েদের মাঝে স্বদেশী ভাবধারা প্রচারে তারা বলিষ্ঠ
পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। বেগম রোকেয়ার প্রতিষ্ঠিত সমিতির মহিলা সদস্যরা চরকা কেটে
প্রচুর পরিমাণে সুতা তৈরি করে খদ্দর তৈরিতে সাহায্য করে এবং বিলেতি দ্রব্য বয়কটে
সমিতির কর্মিবৃন্দ প্রশংসনীয় ভূমিকা রাখেন। বেগম রোকেয়া ছিলেন একজন নিঃস্বার্থ
সমাজসেবী। অবরোধবাসিনীর নিবেদনে তিনি হজরত রাবেয়া বসরীর উক্তি উদ্ধৃত করেছেন, ‘ইয়া
আল্লাহ! যদি আমি দোজখের ভয়ে এবাদত করি, তবে আমাকে দোজখে নিক্ষেপ কর; আর যদি
বেহেশতের আশায় এবাদত করি, তবে আমার জন্য বেহেশত হারাম হউক।’ রোকেয়া নিজের
সমাজসেবা সম্বন্ধেও ওই রূপ কথা বলতে সাহস করেন বলে উল্লেখ করেছেন।
বেগম রোকেয়া তার বিভিন্ন লেখনীতে
ধর্মের সঠিক ব্যাখ্যা না করে ধর্মের দোহাই দিয়ে নারীদের যেভাবে অবদমিত করার
চেষ্টা করা হয়েছে, তার বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিয়েছেন। ধর্মীয় কুসংস্কার রুখে
দেওয়ার যৌক্তিক চেষ্টা করেছেন। শুধু টিয়া পাখির মতো করে পবিত্র কুরআন শরিফ পাঠ
নয়; আরবি ভাষা শিখে পবিত্র কুরআন শরিফকে এর মূল অর্থসহ পূর্ণাঙ্গভাবে পাঠ করে
অন্তর্নিহিত ভাব উদ্ধার ও জানার জন্য তিনি বলেছেন। তিনি আরও উল্লেখ করেছেনÑ একমাত্র
ইসলাম ধর্মই নারীকে তার প্রাপ্য অধিকার দান করেছে; ইসলাম ধর্মে নারীকে সম্পত্তির
উত্তরাধিকার দেওয়া হয়েছে; স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে। ‘মাতার পদতলে স্বর্গ’ বলা
হয়েছে। আমাদের রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, ‘তালাবুল ইলমি ফরীজাতুন, আলা কুল্লি
মুসলিমীন ওয়া মুসলিমাতিন।’ অর্থাৎ সমভাবে শিক্ষালাভ করা সমস্ত মুসলিম, নর ও নারীর
অবশ্যকর্তব্য।
অতএব এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে সমাজসংস্কারক বেগম রোকেয়া তার লেখনী ও কার্যধারার মাধ্যমে সমাজসংস্কারের যে আলোকবর্তিকা বহন করে গেছেন; অন্ধকারের ঘুণে ধরা সমাজের রীতিনীতি ভেঙে নারীর অধিকার সুপ্রতিষ্ঠায় তার অক্লান্ত শ্রমের ফসল আজকে আমরা ভোগ করছি। আজকে দক্ষিণ এশিয়ায় নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ সেরা। দৃঢ়চেতা রোকেয়া প্রতিকূল সমাজের মধ্যে থেকেও আঞ্জুমানে খাওয়াতীনে ইসলাম সমিতি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে নারীর উন্নয়নের ধারায় কর্মের যে স্রোত বইয়ে দিয়েছিলেন তা-ও দিনে দিনে প্রখর হতে প্রখর হয়ে বয়ে চলছে। রোকেয়ার আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে দেশে নারীর উন্নয়ন, ক্ষমতায়ন ও অধিকার সুরক্ষায় কত শত সরকারি-বেসরকারি দপ্তর সংস্থা, সংগঠন গড়ে উঠেছে। আর এর কৃতিত্ব নারী জাগরণের অগ্রদূত, সমাজসংস্কারক বেগম রোকেয়ার, এ কথা বললে নিশ্চয়ই অত্যুক্তি হবে না।