সম্পাদকীয়
সম্পাদক
প্রকাশ : ০৭ ডিসেম্বর ২০২৩ ১০:০৫ এএম
বিজয়ের মাস ডিসেম্বরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি
আমরা বিনম্র শ্রদ্ধা জানিয়ে ফিরে তাকাই মুক্তিযুদ্ধপর্বে। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের
সুনির্দিষ্ট কিছু অঙ্গীকার-প্রত্যয় ছিল। এর মধ্যে অন্যতম বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা।
বঙ্গবন্ধু সাম্যের আলো ছড়ানো সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেছিলেন এবং সেই প্রত্যয়েই
তিনি জাতির মুক্তির সনদও ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু স্বাধীনতা অর্জনের প্রায় বায়ান্ন বছর
অতিক্রান্তেও আমরা কি বঙ্গবন্ধুর কাঙ্ক্ষিত সোনার বাংলা গড়তে পেরেছি? অনস্বীকার্য যে
বিগত এক যুগেরও বেশি সময় দেশে উন্নয়ন-অগ্রগতির ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটেছে। তবে
একই সঙ্গে এ-ও অনস্বীকার্য, উন্নয়নের সমান্তরালে বেড়েছে বৈষম্যও। ৫ ডিসেম্বর আইসিডিডিআর’বির
তেষট্টি বছর পূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত এক সেমিনারে বলা হয়েছে, বর্তমান সামাজিক নিরাপত্তাব্যবস্থায়
দেশে আয়বৈষম্য বিস্তৃত হয়েছে। ৬ ডিসেম্বর প্রতিদিনের বাংলাদেশে প্রকাশিত প্রতিবেদনে
প্রকাশ, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইবিএস) মহাপরিচালক ড. বিনায়ক
সেন বলেছেন, সাধারণভাবে বলতে গেলে ধনীরা আরও ধনী হচ্ছে এবং দরিদ্ররা আরও দরিদ্র হচ্ছে।
কিন্তু বাংলাদেশে বৈষম্যের প্রকৃতি কিছুটা ভিন্ন। দেশের দরিদ্র ও ধনী উভয়ের অবস্থার
উন্নতি হলেও ধনীদের উন্নতির হার বেশি।
এই বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণের সুযোগ নেই। গত বছর জাতিসংঘের খাদ্য,
কৃষি সংস্থাসহ কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিবেদনে আমাদের খাদ্যনিরাপত্তা ও পুষ্টি
পরিস্থিতি সম্পর্কে যে চিত্র উঠে এসেছিল, তা স্বস্তির নয়। প্রতিবেদনগুলোতে বলা হয়,
পুষ্টিকর বা স্বাস্থ্যকর খাবার কেনার ক্ষমতা নেই মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় ৭৩ শতাংশের। তাদের
প্রতিবেদনের বক্তব্য তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়ার অবকাশ নেই। আমরা দেখছি, খাদ্যমূল্যস্ফীতি
জনগোষ্ঠীর বৃহদাংশের জীবনযাপনে বৈরী ছায়া ফেলেছে। নিকট অতীতে প্রতিদিনের বাংলাদেশে
প্রকাশিত প্রতিবেদনেই জানা যায়, নিম্ন আয়ের মানুষ তো বটেই; এর ওপরের ধাপের মানুষেরও
ক্রয়সাধ্য ক্রমেই কমছে। জিডিপি অর্থাৎ জাতীয় প্রবৃদ্ধির সংখ্যানুপাতিক হার বিশ্লেষণে
আয়বৈষম্যের ব্যবধান ঘোচানো সম্ভব কি না, এ-ও প্রশ্ন। একদিকে মূল্যস্ফীতি অন্যদিকে কর্মক্ষম
মানুষের কর্মসংস্থানের অভাব এবং একই সঙ্গে সম্পদের সুষম বণ্টনের ক্ষেত্রে অসামঞ্জস্যতা
বৈষম্য বাড়ছে।
অনিয়ম-দুর্নীতি রোধে সরকারের ‘শূন্য সহিষ্ণুতার’ অঙ্গীকার এবং এর বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ সত্ত্বেও সংবাদমাধ্যমে অনিয়ম-দুর্নীতির যে চিত্র প্রায়ই উঠে আসছে তাতেও আমরা বিস্মিত না হয়ে পারি না। বিদ্যমান পরিস্থিতি সাক্ষ্য দেয়, প্রাতিষ্ঠানিক-অপ্রাতিষ্ঠানিক ক্ষেত্রে দুর্নীতিবাজরা সরকারের শ্যেন দৃষ্টি সত্ত্বেও বেপরোয়া! এই শ্রেণি দুর্নীতি করে একদিকে সম্পদের পাহাড় গড়ছে অন্যদিকে তারাই আবার নানাভাবে জনগোষ্ঠীর উল্লেখযোগ্য অংশের জীবন-জীবিকা, আয় ইত্যাদি ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। বিদ্যমান বাজার পরিস্থিতিতে নিত্যপণ্যের চাহিদার তালিকায় যেখানে মানুষ কাটছাঁট করতে বাধ্য হয়েছে, সেখানে পুষ্টিকর খাদ্যপণ্য কেনা তাদের কাছে অলীক স্বপ্ন মাত্র। আমরা দেখছি, সরকার বিভিন্ন স্তরে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি শুধু অব্যাহতই রাখেনি, একই সঙ্গে এর পরিসরও ক্রমাগত বাড়াচ্ছে। কিন্তু তারপরও সমাজের বড় একটি অংশের মানুষের পক্ষে জীবনযাত্রার ব্যয়ভার বহন করা দুরূহ হয়ে পড়ছে। আমরা এ-ও দেখছি, আর্থিক খাতের বিশৃঙ্খলার কারণে সরকারও নানা রকম সমস্যায় আছে এবং কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য পূরণ করতে গিয়ে কোনো কোনো ক্ষেত্রে থমকে দাঁড়াচ্ছে। আয়বৈষম্য থেকে শুরু করে বহুমাত্রিক নেতিবাচকতার বিস্তৃত ছায়া আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার বাস্তবায়নের পাশাপাশি সুশাসন নিশ্চিত করার তাগিদই দেয়।
আমরা মনে করি, খাদ্যসহায়তা কোনো স্থায়ী সমাধান নয়। বৈষম্যের ছায়া
সরিয়ে সাম্যের আলো ছড়াতে হলে সুশাসন-ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার পাশাপাশি প্রত্যেক নাগরিকের
জন্য অধিকারের মাঠ সমতল করতে হবে। মানুষের সামর্থ্য তৈরি করাই মুখ্য বিষয়, সাহায্য-সহযোগিতা
সাময়িক বিষয়মাত্র। খাদ্যসহায়তা কিংবা সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি বেষ্টনীর পরিসর বাড়িয়ে
মানুষকে সাময়িক স্বস্তি দেওয়া গেলেও জীবন-জীবিকার মান উন্নয়নে বৈষম্যের নিরসন ঘটিয়ে
সাম্য প্রতিষ্ঠার কোনো বিকল্প নেই। আমরা যদি সত্যিকার অর্থেই মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার-প্রত্যয়ের
সড়ক ধরে কাঙ্ক্ষিত বাংলাদেশ গড়তে চাই, তাহলে সামাজিক ও আয়বৈষম্যের নিরসন ঘটাতেই হবে।
নগর থেকে শহর, শহর থেকে গ্রামÑ সর্বত্র সমান দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে নাগরিকের অধিকার
নিশ্চিত করতে হবে। এজন্য চাই দূরদর্শী টেকসই পরিকল্পনা এবং এর যথাযথ বাস্তবায়ন। আয়বৈষম্যের
নিরসন সম্ভব হলেই কেবল জাতীয় প্রবৃদ্ধির সুফল প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছে দেওয়া
এবং এর মধ্য দিয়েই অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের ভিত মজবুত করা সম্ভব।