× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

বিজয়ের মাস

বিষয় অনেক কিন্তু লক্ষ্য নির্দিষ্ট

ড. মোহাম্মদ ফায়েক উজ্জামান

প্রকাশ : ০৬ ডিসেম্বর ২০২৩ ১০:২৬ এএম

ড. মোহাম্মদ ফায়েক উজ্জামান

ড. মোহাম্মদ ফায়েক উজ্জামান

সমগ্র বাংলাদেশে নির্বাচনী উত্তাপ শুরু হয়েছে। এই উত্তপ্ত অবস্থা দুটি কারণে। প্রথমত, অনেকগুলো রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে এবং একটি বড় দলসহ কয়েকটি দল অংশ নিচ্ছে না। তারা বরং নির্বাচন প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু কীভাবে প্রতিহত করবে, সে বিষয়টি দেশবাসীর সামনে স্পষ্ট নয়। কারণ ২৮ অক্টোবরের পর থেকে বিএনপিসহ তার মিত্র দলগুলা লাগাতার হরতাল-অবরোধের ডাক দিচ্ছে, কিন্তু তা স্বতঃস্ফূর্তভাবে মানুষ পালন করছে না। চোরাগোপ্তা হামলা চালিয়ে কিছু যানবাহনের ক্ষতি করা গেলেও প্রকৃতপক্ষে মানুষ হরতাল-অবরোধের পক্ষে নেই। এমনকি আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রক্ষমতায় যখন থাকবে না, তখনও এদেশে আর হরতাল পালিত হবে না। কারণ মানুষের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ঘটেছে। ফলে কোনোভাবেই কেউ কর্মঘণ্টা নষ্ট করতে চান না। আন্দোলনের কৌশল না পাল্টালে হরতাল-ধর্মঘট করে কোনো লাভ হবে না।

প্রশ্ন হলো, এই অবস্থার জন্য দায়ী কে? আমরা অবশ্যই একেকজন একেক কথা বলব এবং দেখা যাবে যে, আলোচনায় আমরা দুভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছি। কারও কথা হয়তো আওয়ামী লীগের পক্ষে যাবে আবার কারও কথা যাবে বিএনপির পক্ষে। কিন্তু তাও কথা তো বলতে হবে। বিএনপি ও তাদের মিত্ররা অনেক দিন ধরে এক দফার আন্দোলন করছে। শেখ হাসিনাকে পদত্যাগ করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন দিতে হবেÑ এটাই আন্দোলনের মূল বিষয়। কারণ গত দুটি নির্বাচনে তাদের অভিজ্ঞতা খুবই তিক্ত। তারা আন্দোলনকে বেশ গতিশীল করে তুলেছিল। কিন্তু আন্দোলনের প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে এসে তারা নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। বিশেষ করে বিএনপির নেতারা তাদের কর্মীদের সঠিকভাবে পরিচালনা করতে ব্যর্থ হন। ২৮ অক্টোবর প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলা, নৃশংসভাবে পুলিশ হত্যা এবং একই তারিখে গার্মেন্ট শ্রমিকদের রাস্তায় নামানোয় তারা সাধারণ মানুষের সমর্থন হারিয়েছে। পাশাপাশি সরকারকে শক্ত অবস্থান নিতেও সহায়তা করেছে। আমাদের স্মরণ থাকতে পারে যে, গত ৪-৫ মাস আগে প্রধানমন্ত্রী বিদেশ সফর থেকে এসে সংবাদ সম্মেলনে এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে বলেন যে, সংসদে প্রতিনিধিত্বশীল দলগুলো নিয়ে একটি নির্বাচনকালীন সরকার হতে পারে। এর কিছুদিন আগেই বিএনপি সংসদ থেকে পদত্যাগ করে।

শেখ হাসিনার বক্তব্য অনুযায়ী বিএনপি এই সরকারে অংশ নিতে পারত না। কিন্তু আমাদের মনে একটি সাংবিধানিক প্রস্তাব ছিল। সেই প্রস্তাব বাস্তবায়িত হলে বিএনপিরও সরকারে থাকার সুয়োগ তৈরি হতে পারত। কিন্তু ২৮ অক্টোবর সব হিসাব পাল্টে দেয়। আমাদের মনে থাকবে ২০১৪ সালে শেখ হাসিনা নির্বাচনকালীন সরকারে বিএনপিকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। এবারও সেটি ঘটতে পারত। সংসদে প্রতিনিধিত্বশীল দলগুলো ছাড়াও যদি আনুপাতিক হারে দুজন টেকনোক্র্যাট মন্ত্রী বিএনপি থেকে নেওয়া হতো তাহলে সব কুল রক্ষা পেত। কিন্তু সেই অবস্থা আর বিরাজমান থাকেনি। তা ছাড়া সংলাপ বিষয়ে দেশি-বিদেশি অনেকেই সোচ্চার। কিন্তু আমাদের এটাও মনে রাখা দরকার যে, ওবায়দুল কাদের বলেছিলেনÑ নিঃশর্ত সংলাপ হলে আওয়ামী লীগের বসতে আপত্তি নেই। কিন্তু বিএনপির সাফ জবাব ছিল পদত্যাগ না করা পর্যন্ত কোনো সংলাপ নয়। এমনকি সর্বশেষ পিটার হাস যে সংলাপের প্রস্তাব দিলেন তিনিও বিএনপিকে রাজি করানোর ক্ষেত্রে উদ্যোগ নেননি। সংলাপ করতে হলে বিএনপির কর্মসূচি স্থগিত করে কারান্তরীণ নেতাদের মুক্তি চাইতে হতো। বিএনপির রিমোট কন্ট্রোল নেতা সে পথে হাঁটেননি। তার ভরসা একমাত্র পিটার হাস। অন্যদিকে ওবায়দুল কাদের এখন কোনো কোনো জায়গায় স্বতন্ত্র প্রার্থীও ঠিক করে দিতে চাইছেন। তবে যেভাবেই হোক নির্বাচন জমে উঠেছে। পরে পরিস্থিতি কী হবে, তা ভবিতব্যই জানে। কিন্তু এ মুহূর্তের যে অবস্থা তাতে স্পষ্ট, আওয়ামী লীগ আবার সরকার গঠন করবে। কিন্তু সেই সরকারের কাছে দেশবাসীর প্রত্যাশা কী?

এবার সরকার গঠন করলে আওয়ামী লীগ একাধিক্রমে চারবার সরকারে থাকবে। এ সময়ে দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির ব্যাপকতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। যোগাযোগ ব্যবস্থার ক্ষেত্রেও হয়েছে ব্যাপক উন্নতি। কিন্তু যেটি খুব কম হয়েছে তা হলো অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ গড়ার কাজ। দেশে ধর্মান্ধতা মারাত্মকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ধর্মের উদার ও নৈতিক বিষয়গুলোর পরিবর্তে মানুষ পোশাকি ধর্মচারে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। বাঙালির আবহমান সংস্কৃতি ক্রমে লুপ্ত হচ্ছে এবং বঙ্গবন্ধুর যে ‘গরীব আর গরীব হবে না’ শীর্ষক স্লোগান, তা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অনেক শ্লথগতি বিরাজমান। এতদ্ব্যতীত সমাজের সর্বস্তরে দুর্নীতি বাসা বেঁধেছে। বঙ্গবন্ধুর দুর্নীতিবিরোধী অবস্থানও সুবিদিত। বঙ্গবন্ধুর এই প্রত্যাশাগুলো তিনি বাস্তবায়ন করে যেতে পারেননি। দুর্নীতি নির্মূল করা জরুরি এবং এই কঠিন কাজটি শেখ হাসিনা করতে না পারলে অন্য কেউ পারবেন, তা বিশ্বাস করা কঠিন। তিনি যে স্মার্ট বাংলাদেশের স্লোগান দিচ্ছেন আমরা মনে করি, সাম্প্রদায়িকতামুক্ত, কূপমণ্ডুকতামুক্ত, দুর্নীতিমুক্ত, বৈষম্যহীন ও জ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠাই হলো স্মার্ট সমাজ। আর সমাজ স্মার্ট হলে আপনা-আপনি রাষ্ট্রও স্মার্ট হবে। নিশ্চয়ই শেখ হাসিনা আগামী পাঁচ বছরে দেশকে সেই জায়গায় নিয়ে যেতে চাইবেন। তার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি বা মেনিফেস্টোতে অবশ্যই এই অঙ্গীকারগুলো থাকবে। তবে কি এই প্রতিশ্রুতিগুলো বাস্তবায়নের অন্তরায়গুলো চিহ্নিত করা জরুরি হয়ে পড়েছে। আমরা ৭৫-পূববর্তী অবস্থার কথা মনে করলে শিউরে উঠি। বঙ্গবন্ধুর হাতে কিন্তু একক ক্ষমতা ছিল। কিন্তু ছিদ্রগুলোর দিকে তিনি নজর দেননি। তিনি জাতির পিতা ছিলেন বলে মোশতাকের প্রতিও কঠোর হতে পারেননি। অতএব সাধু সাবধান!

বিজয়ের এই মাসে আওয়ামী লীগ তাদের নির্বাচনী মেনিফেস্টো প্রকাশ করবে। মেনিফেস্টো যারা প্রণয়ন করছেন তাদের এ বিষয়টি মাথায় রাখা প্রয়োজন, বাংলাদেশ কোন আদর্শের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বর্তমান বৈশ্বিক অগ্রগতির সঙ্গে বাংলাদেশ ধারণার যথেষ্ট সাজুয্য রয়েছে। ১৯৭২ সালের সংবিধান ও ১৯৭৩ সালের পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার দিকে দৃষ্টিপাত করলে বোঝা যায়, বঙ্গবন্ধু সুদূরকে দেখেছিলেন। তিনি বিজ্ঞান শিক্ষা ও বিজ্ঞান গবেষণায় বিশেষ নজর দিয়েছিলেন। আজকের বিশ্ব বাস্তবতায় বাংলাদেশকে আরও প্রগতিশীল হওয়া বাঞ্ছনীয়। কিন্তু সমাজের ভেতরটা এখনও পশ্চাদগামী। সব আধুনিক যন্ত্রপাতি ও ডিভাইস ব্যবহার করছি, কিন্তু পরিপূর্ণ পশ্চাৎপন্থি। অর্থাৎ আমরা বিজ্ঞানমনস্ক হইনি। এই অবস্থার পরিবর্তন হওয়া আবশ্যক। সেজন্য রাজনীতিবিদদের অনুশীলন জরুরি। আওয়ামী লীগের অনেক সংসদ সদস্য বঙ্গবন্ধুর তিনটি আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ পড়েননি। অথচ বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনা বলতে বলতে পরিশ্রান্ত। এজন্য মনে হয় তাদের ভালোবাসায় খাদ আছে। বিপদে অনেককে পাওয়া যাবে না। মাঝেমধ্যে এমন মনে হয় যে, বঙ্গবন্ধুর তিনটি বইয়ের ওপর তিনি তাঁর বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করুন। তাহলে তিনি ভালোবাসাটাকে মূল্যায়ন করতে পারবেন। অতঃপর পদপদবি বণ্টন করবেন। এদের অনেকেরই সময় নেই। খুব ব্যস্ত তারা। এই ব্যস্ততার বেশিরভাগ সময় যায় নিজেদের মানুষকে ‘সাইজ’ করায়। সেক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব অনেকে বেমালুম ভুলে যান। জামায়াত-শিবির-হেফাজতিদের পরাস্ত করতে হলে প্রকৃত ধর্মজ্ঞান থাকাটাও প্রয়োজন। সেই অধ্যবসায় আছে কি নেই তাও প্রশ্নসাপেক্ষ। এজন্য স্মার্ট বাংলাদেশ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে নীতিনির্ধারকদের আগেই অগ্রসর মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা দরকার। তাদের চিন্তায়, কাজে ও পথচলায় অন্যরা যেন প্রাণিত হয়, সে বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন।

বাংলাদেশ বায়ান্ন বছর অতিক্রম করছে। এ সময়ে তার অর্জন নেহায়েত কম নয়। কিন্তু আরও যা সহজে হতে পারত তা হয়নি। এর মধ্যে একটা দীর্ঘ সময় সামরিক শাসনের অধীনে কেটেছে। ক্ষমতায় থাকার জন্য তখন ধর্মকে এত উৎকটভাবে ব্যবহার করা হয়েছে যার ফলে এই ব্যবহারের মাত্রা হ্রাস কঠিন হয়ে পড়েছে। অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপরীত অবস্থানে চলে যায় বাংলাদেশ। বাংলাদেশকে সেই কাঙ্ক্ষিত জায়গায় ফিরে আসতে হবে। এজন্য আমার বাঙালিত্বকে ফিরিয়ে আনা দরকার। বাংলার হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানের সঙ্গে বাঙালিত্বের বিরোধ নেই। আমি যদি কায়মনে বাঙালি হই তাহলে আমার ধর্মবোধ সেখানে বাদ সাধবে না।

আমরা যদি কাঙ্ক্ষিত বাঙালি হতে পারি, তাহলে আমাদের সব পশ্চাৎপদতার অবসান ঘটবে। বিজয়ের মাসে আমাদের প্রত্যাশা থাকবে. রাজনৈতিক ঝড়ঝঞ্ঝার মধ্য দিয়েও বাংলাদেশ যেন সামনের দিকে এগিয়ে যায়। মানুষ যেন নিশ্চিন্তে দিনাতিপাত করতে পারে। ব্যক্তি ও গোষ্ঠীগত স্বার্থের বিপরীতে উদার ও মানবিক মানুষের যেন জয় হয়Ñ এটিও বিজয়ের মাসের প্রত্যাশা। আমরা যেন এমন এক সমাজ গঠন করতে পারি, যেখানে হিংসা হ্রাস পাবে এবং সহনশীলতার জয় হবে। বিষয় অনেক কিন্তু লক্ষ্য একটি। সেটা হলো, যে প্রত্যয় নিয়ে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ পর্বের সূচনা এবং এর মধ্য দিয়ে অর্জিত এই দেশ সেই প্রত্যয়ের অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ গড়া। এক্ষেত্রে আপস করা যাবে না কোনো রাজনৈতিক মেরূকরণের সমীকরণেই। মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার বাস্তবায়ন করা সম্ভব হলে গণতান্ত্রিক বিকাশসহ অসাম্প্রদায়িক বৈষম্যহীন বাংলাদেশ আমরা পাব। চাই শুধু একাত্তরের মতো সেই অঙ্গীকার-লক্ষ্য এবং এর বাস্তবায়নে নির্মুহ রাজনৈতিক অবস্থান।

  • শিক্ষাবিদ ও রাজনীতি-বিশ্লেষক
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা