স্মরণ
শুভঙ্কর মেঘ
প্রকাশ : ০৪ ডিসেম্বর ২০২৩ ০৯:৫১ এএম
রণেশ দাশগুপ্তের
জন্ম ১৯১২ সালের ১৫ জানুয়ারি আসামের ডিব্রুগড়ে। তার বাবা অপূর্বরত্ন দাশগুপ্ত খ্যাতনামা
খেলোয়াড় ছিলেন। মা ইন্দুপ্রভা দাশগুপ্ত ছিলেন সাহিত্য অনুরাগী। তার পিতৃপুরুষের বাস্তুভিটা
ছিল মুন্সীগঞ্জের লৌহজং থানার গাউড়দিয়া গ্রামে। নদী ভাঙনে সেই গ্রাম পদ্মাগর্ভে বিলীন
হয়ে যাওয়ায় বাবা ১৯৩৪ সালে চাকরি থেকে অবসর নেন এবং রাঁচি থেকে পরিবার নিয়ে ঢাকায় চলে
আসেন। রণেশ দাশগুপ্তের জ্যাঠা নিবারণ দাশগুপ্ত ছিলেন সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মী ও পেশায়
শিক্ষক। তিনি বিহার কংগ্রেসের সভাপতি হয়েছিলেন। আরেক জ্যাঠা ছিলেন গান্ধীর স্বদেশী
আন্দোলনের কর্মী। পারিবারিকভাবে রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে বেড়ে ওঠার ফলে ছোটবেলা থেকেই স্বদেশী
রাজনীতির সঙ্গে রণেশ দাশগুপ্তের ঘনিষ্ঠ পরিচয় হয় এবং পরবর্তী জীবনে এই রাজনৈতিক সচেতনতা
তার জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণে সহায়ক হয়েছিল।
১৯২৯-এ রণেশ দাশগুপ্ত
তৎকালীন অখণ্ড বিহারের রাঁচি স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করে বাঁকুড়ার কলেজে ভর্তি হন।
এ সময় অনুশীলন দলের সঙ্গে তার যোগাযোগ ঘটে এবং তিনি ব্রিটিশবিরোধী রাজনীতিতে সরাসরি
জড়িয়ে পড়েন। বাঁকুড়া কলেজ কর্তৃপক্ষ এ তথ্য জানার পর তাকে কলেজ থেকে বহিষ্কার করে।
এরপর তিনি কলকাতার সিটি কলেজে ভর্তি হন এবং সেখান থেকে আইএ পাস করেন। কিন্তু পুলিশের
উৎপাতে লেখাপড়া বিঘ্ন হওয়ায় বরিশালের ব্রজমোহন কলেজে ইংরেজি বিষয়ে অনার্সে ভর্তি হন।
ছোটবেলা থেকেই তার জীবনের সংগ্রাম শুরু। দারিদ্র্যের কারণে শেষ পর্যন্ত লেখাপড়া ছেড়ে
দিতে বাধ্য হন। শুরু হয় সাংবাদিকতা ও লেখালেখির জীবন।
বামপন্থি রাজনীতি
তাকে এতটাই আকৃষ্ট করেছিল যে, তিনি সেখানেই সারা জীবন মনোনিবেশ করেন। কারাগারের জীবন
ছিল রণেশ দাশগুপ্তের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। দেশভাগের আগে তো বটেই পরেও প্রগতিশীল
রাজনীতির জন্য জেলে যেতে হয়েছিল রণেশ দাশগুপ্তকে। একবার জেলে যান তো মুক্তি পান, ফের
কদিন বাদে জেলে। অপরাধ একটাই; বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা ও কমিউনিস্ট পার্টির রাজনীতি।
গোটা পাকিস্তান শাসনামলই এমন কেটেছে তার। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে মুনীর
চৌধুরীকে কারাগারের নিভৃতে ‘কবর’ নাটক লিখতে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন তিনিই। আবার ‘কবর’ নাটক
তার প্রচেষ্টাতেই কারাগারে মঞ্চস্থ হয়েছিল। মুক্তির ১৯৫৫ সালে তিনি যোগ দেন ‘সংবাদ’
পত্রিকায়। সংবাদ পত্রিকাকে ব্যাপক অর্থে প্রগতির মুখপত্র করে তুলতে তার অবদান ছিল
অবিস্মরণীয়। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্রজন্মশতবর্ষ পালনের সময়ে ফের গ্রেপ্তার হন রণেশ দাশগুপ্ত।
জেল থেকে সর্বশেষ রণেশ দাশগুপ্ত ছাড়া পান ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের সুবাদে। ১৯৬৮ সালের
২৯ অক্টোবর রণেশ দাশগুপ্ত শহীদুল্লা কায়সার, সত্যেন সেনসহ একঝাঁক তরুণকে নিয়ে প্রতিষ্ঠা
করেন ‘উদীচী’।
মুক্তিযুদ্ধের বছর রণেশ দাশগুপ্ত ভারতে চলে গিয়েছিলেন। যোগ দিয়েছিলেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে। এখন কলকাতায় বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গঠনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। সভা-সমিতিতে বক্তব্য থেকে পত্রিকায় লেখা, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের জন্য নিবন্ধ প্রায় সবই তিনি লিখতেন। স্বাধীনতার পর দেশে ফিরে এসেছিলেন অনেকটাই নীরবে-নিভৃতে। সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ১৯৭৫ সালের ১ নভেম্বর কলকাতায় একটি সভায় যোগ দিতে যান। আর দেশে ফিরে এলেন না। একপ্রকার অভিমানও ছিল তার। শেষমেশ কলকাতাতেই স্বেচ্ছা নির্বাসিতের জীবন বেছে নিলেন মৃত্যুপূর্ব পর্যন্ত। ১৯৯৭ সালের ৪ নভেম্বর তিনি কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন। তার লাশ ঢাকায় এনে পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় পোস্তগোলা শ্মশানে দাহ করা হয়। ১৯৯৮ সালে তাকে মরণোত্তর একুশে পদক দেওয়া হয়।