দিবস
মামুন রশীদ
প্রকাশ : ০২ ডিসেম্বর ২০২৩ ১০:০৩ এএম
অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত
প্রায় পুরো বিশ্বেই প্রচলিত ছিল দাসপ্রথা। দাসদের ওপর যে নিষ্ঠুর অত্যাচারের কাহিনী
শোনা যায়, তার কোনোটিই কষ্টকল্পনা নয়। বরং দাসপ্রথা ও দাস নির্যাতনের বিষয়ে পৃথিবীজুড়েই
যথেষ্ট তথ্য এবং দলিলদস্তাবেজ রয়েছে। দাসত্বের শৃঙ্খল পরা প্রতিটি মানুষের গায়েই ছিল
নির্যাতনের চিহ্ন। জোর করে মানুষকে ধরে এক দেশ থেকে অন্য দেশেই শুধু নয়, মহাদেশ পেরিয়ে
নিয়ে যাওয়া হতো ভিন্ন মহাদেশে। অজানা দেশ, পরিবেশ ও ভাষার সঙ্গে খাপ খাইয়ে টিকে থাকা
মানুষগুলোর ওপর নেমে আসত শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন। এই মানুষগুলোর কেউই জীবিকার সন্ধানে
ঘর ছাড়ত না, বরং তাদের অন্যায়ভাবে ধরে নেওয়া হতো। জোর করে নিয়ে যাওয়া হতো। তারপর গড়ে
আঠারো-কুড়ি ঘণ্টা কাজ করানো হতো। দেওয়া হতো না সামান্যতম মানবিক অধিকার। নারী ও শিশুদের
নিত্য যৌননির্যাতনও সইতে হয়েছে। খাদ্য স্বল্পতা, বিনা চিকিৎসা ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ
কেড়ে নিত দাসদের জীবনীশক্তি। কেড়ে নিত তাদের জীবনও। দাসদের কেউই শত অত্যাচার-নির্যাতনেও
মুখ খুলতে পারেনি, প্রতিবাদ করতে পারেনি। কেউ পালানোর চেষ্টা করলে অথবা কারও বিরুদ্ধে
কাজে গাফিলতির অভিযোগ উঠলে জুটত চরম নিষ্ঠুর শাস্তি। নির্যাতনের পাশাপাশি তাদের খাবারও
বন্ধ করে দেওয়া হতো। জাহাজের নাবিকরাও তখন জড়িয়ে ছিল দাসব্যবসার সঙ্গে।
দাসপ্রথা ও দাসব্যবসার
বিরুদ্ধে ধীরে ধীরে বিশ্বজুড়ে জনমত গড়ে উঠতে থাকে। মানবতাবাদী মানুষ সোচ্চার হয় দাসপ্রথার
বিরুদ্ধে। ইতিহাসের তথ্য বলছে, বর্তমান হাইতি ও ডোমিনিকান রিপাবলিকান অঞ্চলে ১৭৯১ সালে
প্রথমবারের মতো দাসপ্রথার বিরুদ্ধে শুরু হয় আনুষ্ঠানিক বিক্ষোভ। সে বিক্ষোভ পরবর্তীকালে
সঞ্চারিত হয় বিশ্বের অন্যান্য দেশেও। এই আন্দোলন এবং মানুষের সচেতনতায় ব্রিটেন ১৮০৭
সালে ও যুক্তরাষ্ট্র ১৮০৮ সালে মুক্তি দেয় তাদের আফ্রিকান দাসদের। ব্রিটিশ পার্লামেন্ট
সমগ্র ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে ১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দে দাসপ্রথা নিষিদ্ধ করে। এরপর পর্যায়ক্রমে
১৮৪৮ সালে ফ্রান্স এবং ১৮৬৫ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আইন করে দাসপ্রথা নিষিদ্ধ করে।
দাস প্রথার বিলোপ ঘটাতে ১৯৪৯ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে অনুষ্ঠিত কনভেনশন গৃহীত হয়।
কনভেনশনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রতিবছর ২ ডিসেম্বর বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক দাসত্ব বিলুপ্তি
দিবস হিসেবে পালিত হয়। এই দিবসের মূল উদ্দেশ্য মানব পাচার, যৌন দাস, জবরদস্তিমূলক শিশুশ্রম,
বলপ্রয়োগে বিয়ে, যুদ্ধে শিশুদের ব্যবহার বন্ধে সচেতনতা বাড়ানো। তবে আজকের দিনটি
সব ধরনের দাসত্ব বিলুপ্তির দিন হিসেবে পালিত হলেও, আজ যে দাসপ্রথার বিলুপ্তি ঘটেছেÑ
সর্বার্থে এমন দাবির সুযোগ নেই।
আজকের যুগেও দাসপ্রথার
প্রচলন রয়েছে নানাভাবে। আজকের বিশ্বে দাসপ্রথা ভিন্নরূপ নিয়ে দেখা দিয়েছে মানব পাচার।
প্রাচীন যুগের মতো আজকে খোলাবাজারে প্রকাশ্যে দাস কেনাবেচা না হলেও মানব পাচারের মাধ্যমে
দাসপ্রথার ঘৃণ্য রূপটি পুরোপুরি বন্ধ করা যায়নি। গ্লোবাল স্লেভারি ইনডেক্সের হিসাব
অনুযায়ী বিশ্বে এখনও অন্তত চার কোটি লোক দাস-শ্রমিক হিসেবে নিয়োজিত। আজ যখন দাসপ্রথার
ঘৃণ্য রূপটি পুরো বাতিল মনে করা হচ্ছে, সেখানে দাস-শ্রমিকের এই তথ্যও আঁৎকে ওঠার মতো।
এই তথ্যই পরিষ্কার করছে, আধুনিক বিশ্বে আগের মতো সরাসরি না হলেও মানব পাচারের মাধ্যমে
দাসব্যবসা তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে। বাংলাদেশের স্থানও মানব পাচারের সূচকে এগিয়ে।
নানা কারণে পাচার হয়ে যাওয়া মানুষগুলোই বিশ্বের নানা দেশে আধুনিক দাসের জীবন অতিবাহিত
করতে বাধ্য হচ্ছে। আন্তর্জাতিক দাসত্ব বিলোপ দিবসে কোনো মানুষকেই যেন ফাঁদে পড়ে মানব
পাচার চক্রের হয়ে দাসত্ব বরণ করতে না হয়Ñ সেই প্রত্যাশা।