সম্পাদকীয়
সম্পাদক
প্রকাশ : ৩০ নভেম্বর ২০২৩ ১২:৩৭ পিএম
যুক্তরাষ্ট্রের খ্যাতিমান আইনজীবী ও রাজনীতিক মারিও কওমো যথার্থ বলেছিলেন, ‘দুটি পন্থায় সফল হওয়া যায়। একটি হলোÑ সঠিক লক্ষ্য নির্ধারণ করা আর দ্বিতীয়টি হলোÑ সেই লক্ষ্যে কাজ করে যাওয়া।’ যেকোনো সমাজ বা রাষ্ট্রের বিকাশে এই মন্তব্য গুরুত্বপূর্ণ। সমাজ কিংবা রাষ্ট্রে মানুষকে প্রকৃতপক্ষে মানুষ হিসেবে পরিগণিত করতে পারলে এর ইতিবাচক ফল যে বহুমাত্রিক হতে পারে এর নজির আমাদের সামনে কম নেই। আমাদের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার প্রেক্ষাপটে এর পরিপ্রেক্ষিত অনুসারে দূরদর্শী কর্মপরিকল্পনা সময়ের গুরুত্বপূর্ণ দাবি।
পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) জনশুমারি ও গৃহগণনার চূড়ান্ত প্রতিবেদন
প্রকাশ করেছে ২৮ নভেম্বর। তাতে দেখা যায়, দেশের মোট জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৯৮ লাখ। এর মাঝে
নারী ৮ কোটি ৫৬ লাখ ৮৬ হাজার এবং পুরুষ ৮ কোটি ৪১ লাখ ৩৪ হাজার। জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার
১ দশমিক ২২ ভাগ, যা এক দশক আগে ছিল ১ দশমিক ৩৭ ভাগ। কিন্তু প্রবাসীর প্রকৃত সংখ্যা
কতÑ এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে ২৯ নভেম্বর প্রতিদিনের বাংলাদেশে প্রকাশিত প্রতিবেদনে। ওই
প্রতিবেদনেই বলা হয়েছে ইতঃপূর্বে বিএমইটি বলেছিল, প্রবাসীর সংখ্যা প্রায় দেড় কোটি।
কিন্তু এবার বিবিএসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ৫০ লাখ। তথ্যের এই অমসামঞ্জস্যতা উন্নয়ন
পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং এর বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করাই স্বাভাবিক।
জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার গ্রামের চেয়ে শহরাঞ্চলে বেশি। এর পাশাপাশি তুলনামূলক বিশ্লেষণে
দেখা যাচ্ছে, পুরুষের চেয়ে নারীর সংখ্যা আনুপাতিক হারে কিছুটা বেড়েছে। পুরুষ কিংবা
নারীÑ এ ক্ষেত্রে পর্যালোচনার মুখ্য বিষয় নয়। আমরা মনে করি, সামগ্রিকভাবে মোট জনগোষ্ঠীর
অংশীজন হিসেবেই সবাই বিবেচিত।
স্বাধীনতার পর ১৯৭৪ সালে অনুষ্ঠিত দেশের প্রথম জনশুমারিতে মোট জনসংখ্যা
ছিল ৭ কোটি ১৫ লাখ। সেই অনুপাতে বিগত ৫২ বছরে এ সংখ্যা দাঁড়িয়েছে দ্বিগুণেরও বেশি।
তবে অনস্বীকার্য, আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় দেশের মোট জনগোষ্ঠীর উন্নয়ন-অগ্রগতির ক্ষেত্রে
ইতিবাচক ধারা দৃশ্যমান। আমরা জানি, দেশের সব ব্যক্তির জনমিতি, অর্থনৈতিক ও সামাজিক
তথ্য সংগ্রহ, সংকলন ও প্রকাশের সার্বিক প্রক্রিয়াই হলো জনশুমারি। কাজেই এর তথ্য-উপাত্ত
নির্ভুল হওয়া অত্যন্ত জরুরি। কারণ শুমারির সঠিক উপাত্তের ভিত্তিতে পরিকল্পনা প্রণয়ন,
বাস্তবায়ন ও সম্পদের সুষম বণ্টন করতে হয়। এই প্রেক্ষাপটে ষষ্ঠ জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২
প্রথম ডিজিটাল পদ্ধতিতে তথ্য সংগ্রহের কার্যক্রম গত বছরের ১৫ থেকে ২১ জুন পর্যন্ত পরিচালিত
হয়। প্রবাসী বাংলাদেশিদের ‘রেমিট্যান্স যোদ্ধা’ বলা হয়। দেশের উন্নয়ন-অগ্রগতিসহ বৈদেশিক
মুদ্রা উপার্জনে তাদের অবদান নিঃসন্দেহে উল্লেখযোগ্য। এই প্রেক্ষাপটে তাদের সঠিক পরিসংখ্যান
কতটা গুরুত্বপূর্ণ এর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ নতুন করে বলা নিষ্প্রয়োজন। আমরা এ-ও জানি,
সমাজ-রাষ্ট্রের বিকাশে জনশক্তিকে জনসম্পদে রূপান্তর করার গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ শিক্ষা।
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা এবং প্রায়োগিক ক্ষেত্রে অর্জিত শিক্ষার যদি যথাযথ প্রতিফলন ঘটে,
তাহলে জনশক্তি ক্রমাগত জনসম্পদে পরিণত হওয়ার পথ সুগম করা দুরূহ নয়।
আমাদের দেশ ভৌগোলিক আয়তনের তুলনায় ঘনবসতিপূর্ণ এবং এ প্রেক্ষাপটে
করণীয় সম্পর্কে গবেষকদের তরফে ইতোমধ্যে সুপারিশও কম উপস্থাপিত হয়নি। জনসংখ্যা দেশের
জন্য বোঝা নয়, যদি সেই জনসংখ্যা জনসম্পদ হিসেবে রূপান্তরিত হয়। প্রযুক্তির উৎকর্ষতায়
আমাদের অর্থনীতির অন্যতম জোগানদার কৃষি খাতের বিকাশসহ নানা ক্ষেত্রেই আলো ছড়িয়েছে।
আমরা মনে করি, সময়ের প্রেক্ষাপট এবং দাবি অনুযায়ী যদি পরিকল্পিতভাবে কর্মসংস্থানের
বহুমুখী পরিকল্পনা নেওয়ার পাশাপাশি এর বাস্তবায়নে সাফল্য অর্জন করা যায়, তাহলে জনসংখ্যা
জনশক্তিতে এবং এই জনশক্তি জনসম্পদ হিসেবে রূপান্তরিত হয়ে অগ্রগতি সুনিশ্চিত করতে পারে।
তবে এ কথাও মনে রাখা জরুরি, এসব কিছুর বাস্তবায়নে সর্বাগ্রে জরুরি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা।
অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ সমাজকে কীভাবে বিষিয়ে তোলে এর নজির আমাদের সামনে কম নেই।
আমরা মনে করি, দেশ-জাতির সামগ্রিক স্বার্থে বিষয়টিকে প্রাধান্য দিয়ে
রাজনীতির নীতিনির্ধারকরা জনকল্যাণ তথা, দেশপ্রেমের যথাযথ প্রমাণ রাখতে সক্ষম হবেন।
আমরা এ-ও মনে করি, এর সঙ্গে দ্বিমত প্রকাশের অবকাশ খুব ক্ষীণ। আমরা বলতে চাই, সর্বশেষ
জনশুমারিতে যদি কোনো ভুলভ্রান্তি থেকে থাকে তা নির্ণয় করে সংশোধিত আকারে জনসংখ্যার
তথ্য তুলে ধরাসহ ঘাটতিগুলো চিহ্নিত করে এর নিরসনে উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। জনশুমারির বিষয়টি
অবশ্যই কোনো আনুষ্ঠানিকতা নয়, দেশ-জাতির সামগ্রিক উন্নয়ন-অগ্রগতির পরিকল্পনায় তা যে
অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই বিষয়টি আমলে রেখেরই ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নির্ধারণ করা জরুরি।
জনসংখ্যার উন্নয়নই দেশের উন্নয়ন।