× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

এপেক সম্মেলন

বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কোন্নয়নের গুরুত্ব

এম হুমায়ুন কবির

প্রকাশ : ২১ নভেম্বর ২০২৩ ১৭:১৯ পিএম

বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কোন্নয়নের গুরুত্ব

১৫ থেকে ১৭ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের সানফ্রান্সিসকোতে অনুষ্ঠিত হলো এপেক সম্মেলন। গত বছর এই সম্মেলন আয়োজিত হয় ইন্দোনেশিয়ার বালিতে। এপেক বলতে বোঝানো হয়, এশিয়া প্যাসিফিক ইকোনমিক কো-অপারেশন। এপেক আন্তঃমহাদেশীয় অর্থনৈতিক সহযোগিতার ফোরাম হিসেবেই সমধিক পরিচিত। সাম্প্রতিককালে এপেককে বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটি ফোরাম বলেই গণ্য করা হয়। বিশেষত এপেকের ২১টি সদস্য রাষ্ট্র সর্বোচ্চ পর্যায়ে প্রতিনিধিত্ব করে। চলতি বছর এপেক ফোরাম বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ কেন, এই প্রশ্ন উঠতেই পারে। যদিও ফোরামটি এশিয়া প্যাসিফিক কো-অপারেশন ফোরাম, তারপরও আন্তঃমহাদেশীয় সহযোগিতার বিষয়টি রয়েছে। বিশ্বের বৃহত্তর অর্থনীতির দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এই ফোরামের সম্মেলন আয়োজনের মধ্য দিয়ে তা একটি ভিন্ন মাত্রা পেয়েছে। তা ছাড়া এই সম্মেলনের সাইডলাইনে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের চার ঘণ্টাব্যাপী বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে এই বৈঠকটি এবারের বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে আরও বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। গুরুত্ব পাওয়ার পেছনে অবশ্য আরও কিছু কারণ রয়েছে। বিগত কয়েক বছর ধরে দুই দেশের মধ্যকার দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে উত্তাপ কমাতে নানাবিধ পদক্ষেপ নেওয়া হয়। আমরা দেখেছি, গত বছর বালিতে দুই দেশ আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে উত্তেজনা প্রশমন ও শান্তিপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখার ঘোষণা দিয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীন এই অঞ্চলের অর্থনীতির ইতিবাচক বিবর্তনের অংশীদার। এজন্য এই দুই দেশের মধ্যকার অস্থিতিশীল সম্পর্ক সারা বিশ্বের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলার শঙ্কা তৈরি করে। তাইওয়ান প্রসঙ্গ, দক্ষিণ চীন সাগরে দুই দেশের মধ্যকার উত্তেজনাসহ নানা কারণে প্রত্যাশা ছিল দুই দেশের প্রেসিডেন্ট উত্তেজনা প্রশমনে একসঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী হলে তা ইতিবাচক দিকেই এগোবে।

সাম্প্রতিককালে চীনের অর্থনীতির ওপর খানিকটা চাপ দেখা গেছে। উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন প্রযুক্তি রপ্তানির ক্ষেত্রে চীনের ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সরকার প্রযুক্তি পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপ করেছিল এবং তা এখনও অব্যাহত রয়েছে। আবাসন প্রকল্প থেকে শুরু করে একাধিক অর্থনীতির খাতে ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। আমরা জানি, চীনা অর্থনীতির প্রধান নিয়ামক শক্তি বিদেশি বিনিয়োগ। এই বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও তারা কিছুটা প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়েছে। ফলে চীনের অর্থনীতির প্রতি মানুষের আস্থা বা সুনাম সাম্প্রতিককালে কিছুটা আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার চীনা উদ্যোগও ছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগ যদি আবার চীনে ফিরিয়ে আনা যায় তাহলে তাদের অর্থনীতি অনেকটা গতি ফিরে পাবে। দুই দেশের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের অনেকেই একসঙ্গে কাজ করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছিলেন। আলোচনা সাপেক্ষে চীনও স্থিতিশীল জায়গায় যাওয়ার বিষয়ে সচেষ্ট ছিল। এপেক সম্মেলনে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের এই বৈঠকে উল্লেখযোগ্য অর্জন হয়তো মেলেনি। তবে তাদের মধ্যে গঠনমূলক, উপযোগী ও খোলামেলা আলোচনা হয়েছে। দুজনই একমত হয়েছেন সাম্প্রতিক সময়ে দুই দেশের মধ্যকার উত্তেজনা দ্রুত প্রশমন জরুরি। স্থিতিশীল বৈশ্বিক পরিস্থিতির জন্যও তা আবশ্যক। কাজেই সামগ্রিক প্রেক্ষাপটেই বিষয়গুলো আলোচনার কেন্দ্রে আসে।

দুই রাষ্ট্রপ্রধানের চার ঘণ্টাব্যাপী বৈঠকে দুই রাষ্ট্রের উত্তেজনা প্রশমনে তারা ছোট হলেও কিছু উদ্যোগ নিয়েছেন। এক্ষেত্রে তিন বা চারটি উদ্যোগ অধিক গুরুত্বপূর্ণ। এই উদ্যোগ দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রেও যেমন গুরুত্বপূর্ণ বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটেও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। প্রথমত অতীতের ন্যায় দুই দেশের সামরিক বাহিনীর মধ্যে যোগাযোগ পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হলো। সাম্প্রতিক সময়ে এই যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে যাওয়ায় তাইওয়ান ও দক্ষিণ চীন সাগর অঞ্চলে সংঘাতের শঙ্কা দেখা দিতে শুরু করেছিল। কিন্তু অনিচ্ছাকৃত এই সংঘাতের শঙ্কা এই বৈঠকে দূর হয়েছে। দ্বিতীয়ত ফেন্টিনিল নামে একটি চীনা মাদকের কারণে যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিবছর অসংখ্য মানুষ মৃত্যুবরণ করে। এই মাদক চীনে উৎপন্ন হয়ে ম্যাক্সিকো সীমান্ত দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক চ্যানেল বিভিন্ন সময়ে চীনকে ফেন্টানিল নামক মাদক তৈরির উপাদান যেন দেশটিতে তৈরি হতে না পারে, সেজন্য কূটনৈতিক তৎপরতা চালাচ্ছিল। আস্থা বৃদ্ধির জন্য এ বিষয়টি নিয়ে আলোচনা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। তৃতীয়ত অধিকাংশ রাষ্ট্র প্রতিরক্ষা খাতে ব্যাপক উন্নয়ন করে চলেছে। সামরিক শক্তিমত্তা বৃদ্ধির পাশাপাশি তারা প্রযুক্তির উন্নয়নও ঘটিয়ে চলেছে।

আমরা দেখছি, বিদ্যমান বাস্তবতায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বড় ধরনের সংকট হিসেবে দেখা দিয়েছে। কারণ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সক্ষমতা বৃদ্ধি পেতে শুরু করেছে। যদি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের জায়গাও দখল করে বসে তাহলে তা মোটেও রাষ্ট্রের জন্য ইতিবাচক কিছু হবে না। তা ছাড়া নীতিনির্ধারণের জন্য যদি তাদের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ওপর নির্ভর করতে হয় তাহলে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের সমীকরণের হিসেবে ভুলভ্রান্তি হতে পারে। বৈঠকে দুই দেশের রাষ্ট্রপ্রধান এ বিষয়ে একমত হয়েছেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যেন মানুষের সিদ্ধান্তকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করতে না পারে সেজন্য উদ্যোগ নেওয়া হবে। আমরা জানি, প্রযুক্তিকে কেন্দ্র করে চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার প্রতিদ্বন্দ্বিতা কয়েক বছর ধরেই ঘনীভূত হচ্ছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ক্ষেত্রে তারা ইতিবাচক সমাধানে আগ্রহী। আর এমনটি করা গেলে প্রযুক্তির অন্যান্য ক্ষেত্রেও সমাধানের পথ উন্মুক্ত হবে। সবশেষে জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একসঙ্গে কাজ করে যাবে। এটিও এই বৈঠকের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হিসেবে স্পষ্টভাবেই প্রতীয়মান হয়।

চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ককে স্থিতিশীল করা এবং ইতিবাচক দিক দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে এই বৈঠকটির গুরুত্ব অনস্বীকার্য। তা ছাড়া বিদ্যমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে তা আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ তা আগেই বলেছি। চারটি বিষয়েই দুই দেশের রাষ্ট্রপ্রধানের অবস্থান আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়েছে। উল্লেখ্য চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং যে চলতি বছর শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের সঙ্গেই আলোচনা করেছেন এমনটি নয়। চলতি বছর তার উদ্যোগগুলোও পর্যবেক্ষণের দাবি রাখে। চলতি বছর তিনি প্রায় দুইশ মার্কিন ব্যবসায়ীর সঙ্গে বৈঠক করেছেন। শি জিনপিং তাদের আশ্বস্ত করার চেষ্টা করেছেন, চীন অংশীদারিত্বমূলক সম্পর্ক গড়ে তোলার ব্যাপারে আগ্রহী। অভয় দিয়ে বলেছেন, বিদেশি বিনিয়োগকারীদের ব্যবসার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করা হবে এবং তাদের সমর্থন দেওয়া হবে। এ বিষয়টি জরুরি। কারণ চীনের ওপর মার্কিন ও ইউরোপীয় বিনিয়োগকারীদের আস্থার সংকট রয়েছে। এই আস্থার সংকট থেকে উত্তরণের জন্য শি জিনপিং নিজে ব্যবসায়ীদের আশ্বস্ত করেছেন। আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিশ্লেষকরা শি জিনপিংয়ের এই উদ্যোগটিকে ব্যাপকভাবে প্রশংসিত করে চলেছে। সাম্প্রতিক সময়ে চীনের অর্থনীতিতে ব্যাপক চাপ পড়েছে। এই চাপ থেকে উত্তরণের জন্য চীনের মার্কিন সহায়তা ও সমর্থন প্রয়োজন। এই সমর্থন আদায়ের জন্যই জো বাইডেনের সঙ্গে বৈঠকের উদ্যোগ শি জিনপিং নিয়েছেন।

অন্যদিকে লক্ষণীয় যে, গাজা যুদ্ধের বিষয়ে এপেকের নেতৃস্থানীয়দের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে; ফোরামটি গাজার চলমান সংকটের বিষয়ে শুধু ‘মতামত বিনিময়’ করেছে। বিবৃতিতে আরও বলা, 'কিছু নেতা বিশ্বাস করতে চান না যে এটি অর্থনীতির বাইরেও ভূরাজনৈতিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করার একটি ফোরাম'। বিবৃতিতে ইউক্রেনে-রাশিয়া যুদ্ধের বিষয়ে কোনো চুক্তি হয়নি বলে জানানো হয়েছে। তবে বলা হয়েছে, এপেকের অধিকাংশ সদস্য দেশ এই আগ্রাসনের তীব্র নিন্দা করেছে। এই যুদ্ধ 'বিপুল মানবিক দুর্ভোগের কারণ' বলে উল্লেখ করেছেন তারা। বলেছেন, 'যুদ্ধটি বিশ্ব অর্থনীতিতে বিদ্যমান ভঙ্গুরতাকে বাড়িয়ে তুলছে।'

চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার ভ্রান্ত ধারণা নিরসনেও শি জিনপিং একাধিক উদ্যোগ নিয়েছেন। চীন সম্পর্কে মার্কিনিদের কিছু ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে। এই ভ্রান্ত ধারণা দূর করার জন্য তিনি ঘোষণা দিয়েছেন, আগামী পাঁচ বছর এবং প্রতিবছর প্রায় ১০ হাজার তরুণ নেতাদের আমন্ত্রণ জানাবেন। তা ছাড়া নিমন্ত্রিত হবেন রাজনৈতিক দলের নেতারাও। চীনের মতো বড় অর্থনৈতিক শক্তিও যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ককে গুরুত্ব দেয় তা আমরা বুঝতে পারছি। ভূরাজনীতির প্রভাব দেশে দেশে সম্পর্কোন্নয়নের ক্ষেত্রে নতুন মেরুকরণ ঘটাচ্ছে এবং এই মেরুকরণের সমীকরণও দেখা যাচ্ছে স্পষ্টতই বৈশ্বিক কূটনীতির বাতাবরণে। আঞ্চলিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও এই প্রেক্ষাপটেই সংযোজিত নতুন মাত্রা। এর বাইরে নয় কেউই। হয়তো কেউ প্রত্যক্ষভাবে সক্রিয়, কেউবা সক্রিয় পরোক্ষভাবে। কিন্তু মূল লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য খুব একটা ভিন্ন নয়।

  • কূটনীতি-বিশ্লেষক, যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা