সম্পাদকীয়
সম্পাদক
প্রকাশ : ১৭ নভেম্বর ২০২৩ ১১:২৩ এএম
আপডেট : ১৭ নভেম্বর ২০২৩ ১১:২৪ এএম
সংবিধান দেশ-জাতির রক্ষাকবচ। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে অপরিহার্য দলিল সংবিধান
অনুসারে দেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষিত হয়েছে। ১৫ নভেম্বর এই তফসিল
ঘোষণা করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল জাতির উদ্দেশে ভাষণের
মাধ্যমে। তফসিল অনুযায়ী ভোটগ্রহণ হওয়ার কথা আগামী ৭ জানুয়ারি। আমরা জানি, নির্বাচনব্যবস্থা
নিয়ে বিএনপিসহ সমমনা দলগুলোর চলমান আন্দোলন-কর্মসূচি নানামুখী বিরূপ প্রভাব ফেলেছে।
১৬ নভেম্বর প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এ তফসিল ঘোষণার প্রেক্ষাপটে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির তরফে
তো বটেই, অন্য রাজনৈতিক দল ও দেশের নানা মহলের প্রতিক্রিয়া উঠে এসেছে। রাজনৈতিক সংকট
নিরসনের জন্য শর্তহীন সংলাপ, অর্থনৈতিক সংকট, জনজীবনের বিড়ম্বনা, সহিংস রাজনীতি অর্থাৎ
জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট এই জরুরি প্রসঙ্গগুলোর অবতারণা ঘটেছে তাদের প্রতিক্রিয়ায়। বিদ্যমান
পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে আমরা মনে করি, অংশগ্রহণমূলক ও অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত
করার লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতার পথ বেছে নেওয়াই শ্রেয়। তফসিল ঘোষিত হলেও
সমঝোতার পথ এখনও রুদ্ধ হয়নি।
আমরা জানি, সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর সরকার কার্যত
নির্বাচনকালীন সময়ে নির্বাচন কমিশনের সহযোগী শক্তি হিসেবে রুটিন কাজ করে। সংবিধান অনুসারে
নির্বাচনের নিয়ামক শক্তি নির্বাচন কমিশন। কমিশন তাদের ওপর অর্পিত সাংবিধানিক দায়িত্ব
পালনে নিষ্ঠার পরিচয় দেবে এই আশ্বাসে আমরা বিশ্বাস রাখতে চাই। সরকারের তরফেও প্রতিশ্রুতি
মিলেছে, প্রশ্নমুক্ত নির্বাচন অনুষ্ঠিত করার ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনকে তারা যথাযথ
সহযোগিতা করবে। কিন্তু সরকারি ও বিরোধী দলগুলোর মধ্যে বিরোধপূর্ণ যে পরিস্থিতি সংকটের
ছায়া গাঢ় করেছে, এর নিরসন শুধু গণতন্ত্রের ঔজ্জ্বল্যের জন্যই নয়, দেশ-জাতির স্বার্থ
এবং একই সঙ্গে জাতীয় ভাবমূর্তির জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। তফসিল ঘোষণাকালে সিইসি সংঘাতপূর্ণ
পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপের তাগিদ দিয়েছেন। আমরা তার এই
বক্তব্যকে স্বাগত জানাই। তিনিও সংলাপের উদ্যোগ নিতে পারেন। রাষ্ট্রপতি সংলাপের উদ্যোগ
নিতে পারেন এরকম একটি গুঞ্জনও আছে। বিদ্যমান প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্রের অভিভাবক হিসেবে
রাষ্ট্রপতিরও বিশেষ উদ্যোগ নেওয়ার অবকাশ রয়েছে, তা আমরাও মনে করি। আমরা আশা করি, সংঘাতপূর্ণ
পরিস্থিতির নিরসনকল্পে একই সঙ্গে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের স্বার্থে দেশের ক্রান্তিকালে
রাষ্ট্রপতির এমন উদ্যোগ সর্বমহলে প্রশংসিত হওয়ার পাশাপাশি সুড়ঙ্গের শেষ প্রান্তে আলোর
সন্ধান দিতে পারে। সব পক্ষেরই মনে রাখা উচিত, রাজনীতি যার যার, কিন্তু দেশটা সবার।
বিদ্যমান জটিল পরিস্থিতির নিরসন দুরূহ নয় যদি সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল
সব পক্ষের আন্তরিকতা-সদিচ্ছার প্রতিফলন ঘটে। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য নিঃসন্দেহে সুষ্ঠু
পরিবেশ দরকার। অনস্বীকার্য, দেশের সাধারণ মানুষ গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপদানের
জন্য ইতোমধ্যে ব্যাপক ভূমিকা রাখলেও অনেক ক্ষেত্রেই রাজনীতির নীতিনির্ধারকদের তরফে
এর যথাযথ মূল্যায়ন হয়নি বা হচ্ছে নাÑ এই অভিযোগ উড়িয়ে দেওয়ার অবকাশ ক্ষীণ। গণতান্ত্রিক
রাজনীতিতে মতের অমিল থাকতেই পারে। কিন্তু গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক অধিকার কিংবা দাবি আদায়ের
নামে জনগণকে জিম্মি অথবা জননিরাপত্তা বিঘ্নিত করার অধিকার কারও নেই। গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক
সংস্কৃতিতে ‘জনগণই সব ক্ষমতার উৎস’Ñ এই গুরুত্বপূর্ণ কথাটি আমাদের সংবিধানেও লিপিবদ্ধ
রয়েছে। নির্বাচন কমিশনের ‘যেকোনো মূল্যে’ নির্বাচন করতেই হবে এমন ভাবনা যেন জনগণের
জন্য অধিকতর অস্বস্তিকর পরিবেশের সৃষ্টি না করে তাও তাদেরই আমলে রাখতে হবে। আমরা দেখছি,
চলমান আন্দোলনে সহিংসতা শুধু হতাহতের মতো অনাকাঙ্ক্ষিত-অনভিপ্রেত-দুঃখজনক ঘটনারই জন্ম
দেয়নি, সম্পদ ধ্বংস করছে, একই সঙ্গে অর্থনীতিকেও কঠিন পরিস্থিতির মুখে ঠেলে দিয়েছে।
আমরা বিদ্যমান সব নেতিবাচকতারই নিরসন চাই এবং এক্ষেত্রে দায়িত্বশীল সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের
দায়বদ্ধতার কথাও স্মরণ করিয়ে দিতে চাই।
শুধু ভূরাজনৈতিক কারণেই নয়, উন্নয়ন-অগ্রগতি একই সঙ্গে বিশ্বদরবারে
অনেক বিষয়ে বাংলাদেশের সুদৃঢ়-সুস্পষ্ট অবস্থান দেশকে অনন্য উচ্চতায় উপস্থাপন করেছে,
এই বাস্তবতাও অস্বীকার করার নয়। কিন্তু রাজনীতি ও নির্বাচনকেন্দ্রিক সংঘাত-সহিংসতা
দেশের অভ্যন্তরে যেমন, তেমনি আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও আমাদের অনেক অর্জন প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
আমরা আশা করব, এর নিরসনে সংশ্লিষ্ট সবাই সজাগ হবেন। হরতাল-অবরোধের মতো জীবনবৈরী কর্মসূচি
বিদ্যমান আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে আরও গভীর রেখাপাত করেছে। নিশ্চয়ই শুভবোধসম্পন্ন কেউ
চান না দেশ-জাতি ভয়াবহ দুর্যোগের মধ্যে পড়ুক। মনে রাখতে হবে, দেশের উন্নতি-অবনতির কোনো
দলীয় পরিচয় নেই বরং তা দেশবাসীর গৌরব-অগৌরবের বিষয়। পারস্পরিক অসহিষ্ণুতা, অবিশ্বাস,
অনাস্থা পরিহার করে উদার মনে সবাই এগিয়ে এলে আমাদের বিশ্বাস অনিশ্চয়তার মেঘ কাটানো
মোটেও কঠিন নয়। আমরা এখন ‘ভুবনগ্রাম’-এর বাসিন্দা, এই বাস্তবতা আমলে রেখেই প্রয়োজনীয়
সবকিছু করতে হবে জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে।