× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

নির্বাচনের তফসিল

তবুও আলোচনার দরজা খুলুক

ড. মোসলেহউদ্দিন আহমেদ

প্রকাশ : ১৭ নভেম্বর ২০২৩ ১১:০৬ এএম

আপডেট : ১৭ নভেম্বর ২০২৩ ১৪:৪০ পিএম

ড. মোসলেহউদ্দিন আহমেদ

ড. মোসলেহউদ্দিন আহমেদ

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষিত হলো ১৫ নভেম্বর জাতির উদ্দেশে সিইসির দেওয়া ভাষণের মধ্য দিয়ে। আমরা জানি, তফসিল ঘোষণার পর সরকার পরিণত হয় নির্বাচনকালীন সরকারে। নির্বাচন কমিশন সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী থাকে। সরকার তার সহযোগী শক্তি হিসেবে কাজ করে। আমাদের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বের অবস্থান সচেতন কারওই অজানা নয়। তফসিল ঘোষণার দুই দিন আগে বিদ্যমান রাজনৈতিক সংকট নিরসনে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির কাছে যুক্তরাষ্ট্রের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু সংলাপের আহ্বান জানিয়ে চিঠি দেন। অর্থাৎ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ফের নতুন করে পুরনো আহ্বানই জানিয়েছে। বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস তিন দলের কাছেই চিঠি পৌঁছে দেন। সংবাদমাধ্যমে দেখছি, এ চিঠি নিয়ে তিন দলের নেতারা ভিন্ন ভিন্ন প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। তাদের প্রতিক্রিয়ায় বরাবরই একে অন্যের প্রতি দোষারোপের বিষয়টি উঠে এসেছে এবং দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের পরিবেশ নিয়ে আস্থাহীনতার প্রসঙ্গও সরকার বিরোধীদের প্রতিক্রিয়ায় উঠে এসেছে। তারা ঘোষিত তফসিল প্রত্যাখ্যান করেছেন।  

আমি মনে করি, গণতন্ত্রে আলোচনার দ্বার সব সময়ই উন্মুক্ত। পরমতসহিষ্ণুতাই গণতন্ত্রের অন্যতম অঙ্গভূষণ। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়েছে বটে কিন্তু আলোচনার দরজা বন্ধ হয়ে যায়নি বলেই মনে করি। বিদ্যমান সংকট নিরসনে এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের প্রয়োজনে একই সঙ্গে গণতন্ত্রের শোভাবর্ধনের লক্ষ্যে আলোচনার টেবিলে সবারই খোলা বসা দরকার। একই সঙ্গে এও গুরুত্ব দিতে হবে, শর্তের বেড়াজালে যেন সংলাপ আটকে না থাকে। অর্থাৎ উদারনৈতিক মনোভাব নিয়ে সবাই এগিয়ে এলে বিদ্যমান সংকট নিরসনের পথ অনেকটাই সুগম হবে এ প্রত্যাশা অমূলক নয়। কিন্তু যেকোনো ক্ষেত্রে শর্ত বিদ্যমান সংকট নিরসনে আলোচনার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে এবং প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে, তা যেন রাজনীতির নীতিনির্ধারকরা বিস্মৃত না হন।

বিএনপির নেতৃত্বাধীন সমমনা দলগুলো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পদত্যাগ ও নিরপেক্ষ সরকারের দাবিতে আন্দোলন করছে। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ, বিএনপি ও সমমনারা তাদের দাবির সমর্থনে আরও কঠোর কর্মসূচি দেবে। ১২ নভেম্বর এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি নেতা রুহুল কবির রিজভী জানান, ২৮ অক্টোবর বিএনপির মহাসমাবেশের চার-পাঁচ দিন আগে থেকে এ পর্যন্ত হাজারেরও অধিক তাদের নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মামলা হয়েছে ২৩৩টি। সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল মহল জানিয়েছে, আটক অনেকেই রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নন কিন্তু তাদের সহিংসতার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আমি এও মনে করি, এভাবে গ্রেপ্তার চলতে থাকলে আস্থার সংকট আরও বাড়বে। তফসিল ঘোষণা হয়েছে। কিন্তু এখনও সময় আছে সংলাপের মাধ্যমে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পথ সুগম করার। এ প্রসঙ্গে বলা যায়, কোন রাজনৈতিক দল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে কতটুকু সম্মান করে তা মুখ্য বিষয় নয়, বরং সংলাপে বসার ক্ষেত্রে তারা একটি বিষয়কে গুরুত্ব দেবে যে, তারা সবাই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বিশ্বাস করে। আওয়ামী লীগ বলে আসছে, তারা জনগণের ওপরই আস্থা রাখছে। অন্যদিকে বিএনপিসহ সমমনা দলগুলোর বক্তব্য নিরপেক্ষ সরকার ছাড়া তারা নির্বাচনে যোগ দেবে।

নব্বইয়ের পর থেকে যতবার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হয়েছে, সব সময় বিরোধী পক্ষ ক্ষমতারোহণ করেছে। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বিএনপি একতরফা নির্বাচন করে রেহাই পায়নি। তখন ১০৭ দিন হরতাল হয়। বাধ্য হয়ে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। ২০০১ সালেও দেখেছি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হতে। তখন আওয়ামী লীগকে সরিয়ে বিএনপি ক্ষমতারোহণ করে। ২০০৮ সালেও একই ঘটনা দেখা যায়। ক্ষমতার পালাবদলের এ উদাহরণ থেকে সাধারণ মানুষ এমনকি কোনো কোনো রাজনৈতিক দলের মধ্যেও এ ধারণা জন্মেছে, তত্ত্বাবধায়ক অর্থাৎ নির্দলীয় বা নিরপেক্ষ সরকার না এলে ক্ষমতার পরিবর্তন সম্ভব নয়। যদিও গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক কোনো সূত্র অনুসারে এমন ধারণা সিদ্ধ নয়।

অতীতের ঘটনা থেকে এমন একটি ধারণা বদ্ধমূল হতে শুরু করেছে। সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক ও অবাধ নির্বাচন আয়োজনের দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী দেশ ভারতের নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে তুলনা করলে বোঝা যায় আমরা এখনও নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করে তুলতে পারিনি। নির্বাচন কমিশন শক্তিশালী না হওয়ার ফলে দেশের গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক অঙ্গনে আস্থা এবং পরমতসহিষ্ণুতার অভাব থেকেই সার্বিক পরিস্থিতি রাজনৈতিক সংকটে রূপ নেয়। সৃষ্ট সংকট নিরসনে সংলাপের গুরুত্ব অপরিসীম। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে ১০ নভেম্বর বিভাগীয় কমিশনার, পুলিশ কমিশনার, আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা, জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার ও জেলা নির্বাচন কর্মকর্তাদের দ্বিতীয় ধাপের প্রশিক্ষণ কর্মশালার উদ্বোধন অনুষ্ঠানে সিইসি বলেন, ‘ভোটের দিন পুরো জাতি, ভোটাররা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকবে, ভেতরে সিল মারার চেষ্টা হলে কেউ না কেউ কিন্তু সেটার ছবি তুলে ফেলবে, ভিডিও করে ফেলবে। সেগুলো যখন প্রচার হয়ে যাবে, তখন আমাদের নিরপেক্ষতাও প্রশ্নবিদ্ধ হবে। আমাদের ব্যর্থতা, অদক্ষতা প্রতিফলিত হবে।’ তিনি এও জানিয়েছেন, ‘আমাদের নির্বাচন গ্লোবাল ডায়নামিক্স পেয়েছে। তাই বিদেশি অনেক সংস্থা ও রাষ্ট্রও আমাদের নির্বাচনব্যবস্থার দিকে মনোযোগ রেখেছে।’

আমাদের নির্বাচনব্যবস্থার নানা ঘাটতি রয়েছে তা অসত্য নয়। নিকট অতীতে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ ও লক্ষ্মীপুর-৩ আসনের নিয়মরক্ষার নির্বাচনেও ভোট জালিয়াতির খবর সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়। সংবাদমাধ্যমেও বিষয়টি ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়েছে। এ ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের দুর্বলতার বিষয়টি স্পষ্টতই ফের দৃশ্যমান হয়। কিছুদিন আগে সিইসি এও বলেছিলেন, ‘নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ এখনও তৈরি হয়নি।’ একটি বিষয় অস্বীকার করার অবকাশ ক্ষীণ যে, আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোগত দুর্বলতা শুধু দেশেই নয়, বিদেশিদেরও নেতিবাচক মনোভাবের প্রকাশ ঘটায়। আমাদের নির্বাচন নিয়ে বিদেশিদের অতি আগ্রহ দৃষ্টিকটু পর্যায়ে পৌঁছেছে তাও অসত্য নয়। দেশে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের অভাব থাকায় রাজনৈতিক অঙ্গনে সংকটাবস্থা যেন জেঁকে থাকে। বিদেশিরা এ কাঠামোগত ঘাটতির সুযোগ নেন। শান্তিপূর্ণ, সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক ও অবাধ নির্বাচন আয়োজনের ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের দুর্বলতার বিষয়টি প্রথমে বিবেচনা করতে হবে। সম্প্রতি নির্বাচন কমিশনের ডাকা সংলাপে ২২টি দলের অংশগ্রহণ করার কথা ছিল। কিন্তু ৪ নভেম্বরের ওই সংলাপে অংশ নিয়েছে মাত্র ১৩টি দল।

নির্বাচন কমিশন এখনও রাজনৈতিক দলের জন্য কোড অব কন্ডাক্ট তৈরি করতে পারেনি। একই সঙ্গে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতাও অর্থবহ সংলাপ অনুষ্ঠানে ব্যর্থতা অস্বস্তি বাড়ছে। সংবাদমাধ্যমে আমরা দেখছি, প্রধান বিরোধী দল বিএনপির প্রধান কার্যালয়ে তালা। দলটির অনেক নেতাই কারাগারে। প্রশ্ন উঠেছে, সংলাপে অংশগ্রহণের আমন্ত্রণপত্র তাহলে নির্বাচন কমিশন কাদের কাছে পৌঁছে দিয়েছিল? দলের প্রধান নেতারাই যদি না থাকেন তাহলে প্রধান বিরোধী দলের অংশগ্রহণ প্রত্যাশা করা কঠিন বটে। আমরা সংবাদমাধ্যমেই দেখেছি, নির্বাচন কমিশনের ডাকা সংলাপের চিঠি তাদের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের ফটকে গেঁথে রেখে আসা হয়। অতীতে কোনো নির্বাচনে জালিয়াতির প্রমাণ পেলে সারা দেশেই ভোটগ্রহণ কার্যক্রম স্থগিত করার ক্ষমতা ছিল কমিশনের। কিন্তু এখন যে কেন্দ্রে জালিয়াতি হবে শুধু সেই কেন্দ্রের ভোট স্থগিত করা যায় আইন অনুসারে। নানাভাবে নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা অনেকাংশে খর্ব হয়েছে।

বিদ্যমান সংকট নিরসনে রাজনৈতিক দলগুলোর নীতিনির্ধারকদের দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে। দলীয় স্বার্থের বিষয়টি উপেক্ষা করে দেশ-জাতির স্বার্থ প্রাধান্য দিতে হবে সর্বাগ্রে। তাই সংলাপের গুরুত্ব সর্বাধিক। রাজনীতি একটি মহান কর্ম অধ্যায়। রাজনীতিকদের বুঝতে হবে, দেশ-জাতির সামনে সংকট জিইয়ে রাখলে তাদেরও কোনো লাভ হবে না। মহামতি আলেকজান্ডার পৃথিবীর অর্ধেক ভূভাগ জয় করেছিলেন। এক মশার কামড়ে তিনি অসুস্থ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর আগে তার সেনাপতিকে বলেছিলেন, ‘কী লাভ এই জয়ের? ফিরতে হচ্ছে খালি হাতে।’ রাজনীতির মতো মহান ব্রতে অংশ নেওয়ার ক্ষেত্রে আলেকজান্ডারের উক্তিটি প্রাসঙ্গিক। ক্ষমতাই সব নয়। দেশ-জাতির স্বার্থ তো আছেই, জাতীয় অর্থনীতিও আছে সংকটে। ‘ভুবনগ্রাম’ বলে পরিচিত বিশ্বে নিজেদের অবস্থান ও ভাবমূর্তি উজ্জ্বল রাখতে হলে উদার মনে এগিয়ে এসে বিদ্যমান সংকট নিরসনে প্রত্যেকেরই ভূমিকা রাখতে হবে।

  • নির্বাচন ও স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ এবং অধ্যাপক, লোকপ্রশাসন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা