স্মরণ
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
প্রকাশ : ১৭ নভেম্বর ২০২৩ ১০:৫৯ এএম
মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। ছবি : সংগৃহীত
ঊনসত্তরের অভ্যুত্থানের সময় ভাসানী ও মুজিব খুব কাছাকাছি চলে এসেছিলেন,
পরস্পরের। বস্তুত ভাসানীই ছিলেন অভ্যুত্থানের মূল সংগঠক ও নেতা; মুজিবের মুক্তির পেছনেও
ব্যক্তি হিসেবে তাঁর ভূমিকাই ছিল প্রধান। ক্যান্টনমেন্ট থেকে মুক্ত হয়ে মুজিব প্রথমে
যে কাজগুলো করেছিলেন সেগুলোর একটা হলো ভাসানীর সঙ্গে দেখা করা। হায়দার আকবর খান রনোর
‘শতাব্দী পেরিয়ে’ বইতে এ সাক্ষাৎকারের প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা আছে। ওই মুহূর্তে ভাসানী
ছিলেন ন্যাপ নেতা (একাত্তরে শহীদ) সাইদুল হাসানের বাসায়। রনোও তখন ওই বাসায় ছিলেন,
ছিলেন মোহাম্মদ তোয়াহাও। তাঁরা হঠাৎ দেখেন মুজিব এসে উপস্থিত। রনো লিখেছেন, ‘আমরা তো
অবাক। পরিচিতজনদের সঙ্গে সামান্য কুশল বিনিময় করে তিনি সোজা চলে গেলেন ভাসানী যে ঘরে
ছিলেন সে ঘরে। ভাসানীর পায়ে হাত দিয়ে সালাম করলেন। … দেখলাম মোহাম্মদ
তোয়াহাকে কাছে টেনে নিয়ে কী যে বললেন ফিসফিস করে তোয়াহা সাহেবও যেন কী জবাব দিলেন।’
মোহাম্মদ তোয়াহার ধারণা ভাসানীর সঙ্গে মুজিবের আলোচনার মূল বিষয়টি ছিল আইয়ুবের ডাকা
গোলটেবিল বৈঠকে যাওয়া-না যাওয়া নিয়ে।
গোলটেবিলের বিরুদ্ধে ছিলেন ভাসানী ও তাঁর অনুসারীরা। তাঁরা চেয়েছিলেন
বয়কট করতে। ব্যক্তিগত আলাপে মওলানা মুজিবকে যে পরামর্শটা দিয়েছিলেন সে কথা আরও উচ্চ
কণ্ঠে ও প্রকাশ্যে তিনি জনসভায় বলেছেন। গোলটেবিল সম্পর্কে ভাসানীর উপলব্ধি অক্ষরে অক্ষরে
সত্য প্রমাণিত হয়। আন্দোলন স্তিমিত হয়ে যায় আপসের আলোছায়ায়। নির্বাচনে যে স্বাধীনতা
আসবে না ভাসানী কিন্তু তা সঠিকভাবেই বুঝেছিলেন। নির্বাচনের চিন্তা বাদ দিয়ে তিনি ছিলেন
আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পক্ষে। সেটা যখন সম্ভব হলো না, নির্বাচন এলো, এখন তাঁর নেতৃত্বে
ন্যাপ পূর্ববঙ্গে নির্বাচন বয়কট করল। এটি ছিল বড় মাপের একটি রাজনৈতিক পদক্ষেপ, যার
তাৎপর্য অন্যরা তো বটেই, এমনকি তাঁর আন্তরিক অনুসারীদেরও কেউ কেউ ঠিক বুঝতে পারেননি।
ভাসানী চেয়েছিলেন নির্বাচনের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার পক্ষে অবিভক্ত একটি রায় বেরিয়ে আসুক,
যাতে স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়। সেটি ঘটেছে। নির্বাচনের
পর ভাসানী মুজিবকে উদ্বুদ্ধ করতে চেয়েছেন গণরায়ের সূত্র ধরে আরও সামনে এগিয়ে যেতে,
ইয়াহিয়ার সঙ্গে আলাপ-আলোচনায় না গিয়ে বরং পশ্চিম পাকিস্তানের কাছে পূর্ব পাকিস্তানের
পাওনাপাতি যা আছে তা মেটানোর দাবি জানাতে।
সেই ১৯৪৯ সালে, মুজিবের বয়স যখন ২৯, ভাসানীর বয়স ৬৯, গুরুশিষ্য তখন জেলে
বসে যে সশস্ত্র যুদ্ধের কথা কল্পনা করেছিলেন, বাস্তবে তা ভয়াবহ আকারে যখন সত্যি সত্যি
এলো, তখন তাঁরা দুজনে যে একসঙ্গে যুদ্ধের ময়দানে থাকবেন তা সম্ভব হলো না। কারণ তত দিনে
তাঁরা পৃথক হয়ে গেছেন, একে অন্যের কাছ থেকে। বন্দি হয়ে মুজিবকে চলে যেতে হলো পাকিস্তানে,
আর বন্দি হওয়ার মুখে ভাসানী চলে গেলেন ভারতে। যুদ্ধটা বাংলার দুই নেতার অনুপস্থিতিতেই
চলল। যুদ্ধের পরে দুজন যে একসঙ্গে হবেন তাও সম্ভব ছিল না। কেননা মুজিব তখন সদ্যস্বাধীন
বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী আর ভাসানী তখনও রাজপথে। ভাসানীর স্বপ্ন ছিল স্বাধীনতা
মুক্তিতে পরিণত করবেন। পারলেন না; কারণ তখন তিনি অনেকটা একা হয়ে গেছেন। তার পরও চেষ্টা
করেছেন; জনসভা, সম্মেলন, বিবৃতি, ফারাক্কা লং মার্চ সবই করলেন, কিন্তু স্বপ্নটা বাস্তবায়িত
হলো না। স্বাধীন বাংলাদেশের সরকার ভাসানীকে শেষ পর্যন্ত অন্তরিন করেছিল, কারণ মুক্তির
কাঙ্ক্ষিত সংগ্রাম তিনি সামনে এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছিলেন। সপরিবার শেখ মুজিবকে হত্যার
সেই অতিনির্মম ঘটনা যখন ঘটে ভাসানী তখন সন্তোষে, গৃহবন্দি অবস্থায়। রেডিওতে খবরটি শুনে
তাঁর চোখ দিয়ে অবিরাম অশ্রুধারা নেমেছিল বলে জানিয়েছেন একজন প্রত্যক্ষদর্শী। অশ্রুসিক্ত
মওলানা বলেছিলেন, ‘সব শেষ হয়ে গেল।’ বিদেশি সাংবাদিকদের নিজের মতো করে তিনি বলেন, ‘আমার
মজিবর ভুঁইফোঁড় রাজনীতিক নয়। [...] সে পাশে না থাকলে আমি স্বৈরাচারী মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে
আন্দোলন জাগিয়ে তুলতে পারতাম না।’
১৫ আগস্টের দুই দিন পর মেজর ফারুক, মেজর ডালিম, মেজর হুদা ও আরও কয়েকজন সন্তোষে গিয়েছিলেন ভাসানীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ‘জালেমশাহিকে খতম’ করেছেন এটা জানাতে। ভাসানী তাদের ধমকে দিয়েই বলেছিলেন, ‘তোমরা কি জানো যে তোমরা এক গভীর আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের পক্ষ হয়ে কাজ করেছো?’ মোশতাকের নির্দেশে আগস্টের ১৬ তারিখেই জেনারেল ওসমানী হেলিকপ্টারে করে সন্তোষে গিয়ে ভাসানীকে ঘটনা জানান এবং সমর্থন-বিবৃতি দিতে চাপাচাপি করেন। ভাসানী সম্মত হননি। ২১ আগস্ট মোশতাক নিজে ভাসানীর সঙ্গে দেখা করতে যান, ভাসানী দেখা করেননি। ১৯৭৫-এর ৮ মার্চ মুজিব গিয়েছিলেন সন্তোষে। উপলক্ষ মোহাম্মদ আলী কলেজের সরকারিকরণ। তখন সেই আবেগঘন ঘটনাটি ঘটে যেটি ফটোগ্রাফাররা ধারণ করেছেন; রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান মওলানাকে কদমবুসি করতে যান, মওলানা তাঁকে বুকে জড়িয়ে ধরেন। যেন দুই পরমাত্মীয়ের পুনর্মিলন। ১২ আগস্ট ভাসানী শেখ মুজিবকে একটি চিঠি পাঠিয়েছিলেন। লিখেছিলেন, ‘প্রিয় মুজিব, আমি রাতে এক মিনিটও ঘুমাইতে পারিনি। চক্ষু বুজিলেই দেখিতে পাই, তোমার মৃতদেহ বহন করিয়া লইয়া যাইতেছে। তোমার চারদিকে দুর্নীতির পাহাড় গড়িয়া উঠিয়াছে। তাই সাবধান হও, সাবধান হও, সাবধান হও।’ ‘সাবধান হও’ কথাটি তিনবার ছিল। চিঠিতে ভাসানী মুজিবকে শিগগিরই সন্তোষে এসে দেখা করতে অনুরোধ জানিয়েছিলেন। যোগাযোগের সেটাই ছিল অন্তিম প্রচেষ্টা। এর তিন দিনের মধ্যেই তো সপরিবার শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হলেন , পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী শক্তির হাতে, মওলানা ভাসানী যাকে অনেক আগেই শত্রু বলে চিহ্নিত করে ফেলেছিলেন, যার বিরুদ্ধে তিনি লড়ছিলেন প্রাণপণে।