সংলাপ
মহিউদ্দিন খান মোহন
প্রকাশ : ১৬ নভেম্বর ২০২৩ ১২:৩২ পিএম
আপডেট : ১৬ নভেম্বর ২০২৩ ১২:৩৫ পিএম
মহিউদ্দিন খান মোহন
দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিবেশকে যদি মরু অঞ্চলের লু হাওয়ার সঙ্গে তুলনা
করা হয়, তাহলে খুব একটা অত্যুক্তি বলে মনে হয় না। লু হাওয়া যখন কোনো অঞ্চলের ওপর দিয়ে
প্রবাহিত হয়, তখন সেখানকার পরিবেশ এতটাই উত্তপ্ত হয়ে ওঠে যে, মানুষের জীবন প্রায় ওষ্ঠাগত
হয়ে পড়ে। শুধু মানুষই নয়, পশুপাখি, গাছপালাও এর প্রভাবে বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়। ভারতের
উত্তর প্রদেশ ও পাকিস্তানের বেলুচিস্তানের দক্ষিণাংশের মরু অঞ্চলে বছরের মে-জুনে লু
হাওয়া প্রবাহিত হয়। লু হাওয়ার প্রভাবে সেখানে নানা রকম রোগব্যাধি বেড়ে যায়, বিষাক্ত
কীটপতঙ্গের উৎপাত বৃদ্ধি পায়। মানুষ তখন ঘর থেকে পারতপক্ষে বাইরে যায় না। বিশেষ করে
বৃদ্ধ ও শিশুদের ক্ষেত্রে নিতে হয় বিশেষ ব্যবস্থা। ৪৫ থেকে ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার
ওই পরিবেশে জীবন সংকটাপন্ন হয়ে ওঠে। দরজা-জানালা বন্ধ করে লু হাওয়া থেকে বাঁচার চেষ্টা
করে সবাই।
আমাদের দেশে এখন যে রাজনৈতিক বায়ুপ্রবাহ বহমান তা মরু অঞ্চলের লু হাওয়ার
চেয়ে কোনো অংশে কম বলা যাবে না। চারদিকে গরম বাতাস। সরকার ও বিরোধী দলের নেতাদের গরম
বক্তৃতা, গরম কর্মসূচি, বোমা-ককটেলের বিকট শব্দের গরম, যানবাহনে অগ্নিশিখার গরম। সব
মিলিয়ে পরিবেশ অসহ্য করে তুলেছে। রাজপথে কোনো বড় মিছিল নেই। না, ভুল বলা হলো। মিছিল
আছে, কিন্তু তা সরকারি দলের নেতাকর্মীদের। কিন্তু রাজপথ যাদের মিছিলে গরম হওয়ার কথা
তারা অনুপস্থিত। রাজপথে তাদের চোখে পড়ে না। তবে রাতে টেলিভিশনের খবরে দেখা যায় শহর-নগর,
গ্রাম-গঞ্জের অলিগলিতে বিদ্যুচ্চমকের মতো মিছিলের চমক। ক্ষণিকের জন্য আলোর ঝলকানি দেখিয়েই
তারা চম্পট দেন। তাদের অবরোধ কর্মসূচি এখন ‘অমাবস্যার চাঁদ’, ‘ডুমুরের ফুল’ কিংবা
‘কাজির গরু খাতায় আছে, গোয়ালে নেই’ যেকোনো উপমার সঙ্গে তুলনা করা যায়। গুপ্তস্থান থেকে
একজন নেতা ভিডিওবার্তার মাধ্যমে কর্মসূচি ঘোষণা করেই দায়িত্ব শেষ করছেন। জনগণ সে কর্মসূচির
সঙ্গে একাত্ম হলো কি না, স্বতঃস্ফূর্তভাবে পালন করল কি না তা খতিয়ে দেখেন না।
এ নিবন্ধ যখন লিখছি তখন এ যাত্রায় বিএনপির সর্বাত্মক (?) অবরোধের পঞ্চম
পর্ব চলছে। এরপর তারা আবার কী কর্মসূচি দেয় তা বলা এ মুহূর্তে সম্ভব নয়। কতদিন এমন
বায়বীয় কর্মসূচি তারা দিতে থাকবে তাও অনিশ্চিত। ছোটবড় সব শহরেই যানবাহন চলাচল করছে,
দোকানপাট, অফিস-আদালত চলছে। জনজীবনে ছন্দপতন বলতে যা বোঝায়, তা ঘটেনি। সমস্যা দূরপাল্লার
যাত্রীদের। বোমা-আগুনের ভয়ে কোটি টাকা দামের গাড়িগুলো মালিকরা নিরাপদ জায়গায় বসিয়ে
রেখেছেন। ফলে জরুরি প্রয়োজনে এক শহর থেকে আরেক শহরে যেতে মানুষকে পোহাতে হচ্ছে বেজায়
ঝক্কি। যেখানে ট্রেনের সুবিধা আছে, মানুষ সেটা ব্যবহার করছে। অন্যরা বিকল্প পথে যাওয়া-আসা
করছে। ‘জনগণের ভোটাধিকার’ আদায়ের জন্য জনগণকেই দুর্ভোগে নিপতিত করা কতটা সুবিচেনাপ্রসূত,
এ প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়া যাবে না।
রাজনীতির প্রবহমান এ লু হাওয়ার মধ্যে কারও কারও মতে শীতল বায়ু প্রবাহের
বার্তা নিয়ে এসেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী
ডোনাল্ড লু’র একটি চিঠি। দেশের তিন প্রধান দল আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির কাছে
প্রেরিত ওই চিঠিতে মি. লু তার সরকারের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক সমস্যা
নিরসনের জন্য উপদেশ খয়রাত করেছেন। ডোনাল্ড লু’র ওই চিঠি ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাস ইতোমধ্যে
তিন দলের কাছে পৌঁছে দিয়েছে। খবরে বলা হয়েছে, চিঠিতে ভিসানীতির কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে
সংকট নিরসনে শর্তহীন সংলাপের উদ্যোগ নেওয়ার জন্য দলগুলোকে তাগিদ দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে
একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথাও বলা হয়েছে। চিঠির বিষয়বস্তুর পর্যালোচনায় তাতে
নতুন কোনো বিষয়ের সন্ধান পাওয়া যাবে না। যেসব কথা চিঠিতে বলা হয়েছে, সেগুলো বছরখানেক
ধরে মার্কিন সরকার শুধু নয়, বিশ্বের প্রভাবশালী অনেক রাষ্ট্র, আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং
দেশের বিশিষ্ট নাগরিকরা অনবরত বলে আসছিলেন। কিন্তু সমস্যা যে তিমিরে ছিল, সে তিমিরেই
রয়ে গেছে। সমাধানে প্রক্রিয়া একচুলও এগোয়নি, বরং পিছিয়েছে।
এ যেন সেই গল্পের মতো। এক ছেলেকে তার অসুস্থ পিতার অবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞেস
করা হলে সে বলল, আগের চেয়ে ভালো। কীরকম ভালো? সে জানাল, ‘আগে টয়লেটে গিয়ে সারত, এখন
বিছানায়ই সারে’। বিএনপি ও তাদের অনুগামীদের কর্মসূচি এতদিন ‘শান্তিপূর্ণ’ মিছিল-সমাবেশে
সীমাবদ্ধ ছিল, এখন তা সহিংস অবরোধ কর্মসূচিতে গিয়ে ঠেকেছে। অন্যদিকে সরকার তাদের এতদিনের
‘সহনশীলতা’র অবসান ঘটিয়ে কঠোরতার পথ অবলম্বন করেছে বেশ শক্তভাবেই। ফলে উদ্ভূত সমস্যার
সরল কোনো সমাধানের পথ এখন পর্যন্ত কারও দৃষ্টিসীমায় আসছে না। আর অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ ভেবে
উদ্বিগ্ন দেশবাসী। তবে এটা পরিষ্কার, দেশবাসীর সেই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার কানাকড়ি মূল্য সরকার
বা বিরোধী পক্ষের কারও কাছেই নেই। তারা গোঁ ধরে বসে আছে নিজেদের দলীয় স্বার্থের সংকীর্ণতায়
আচ্ছন্ন হয়ে। বিএনপির ডাকা অবরোধ পুরোপুরি সফল না হলেও তা যে জনজীবনে কিছুটা বিঘ্ন
ঘটাচ্ছে তাতে দ্বিমতের অবকাশ নেই। এর ফলে পণ্য পরিবহনে বাধার সৃষ্টি হচ্ছে। প্রতিক্রিয়ায়
নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাচ্ছে। গাড়ি পুড়িয়ে ধ্বংস করা হচ্ছে সম্পদ। পরিবহন সেক্টরের
শ্রমিক-কর্মচারীদের একটি বিরাট অংশ এখন কর্মহীন। এমনটা বেশিদিন চলতে পারে না। ফলে প্রতিটি
মানুষ চায় এ সমস্যার দ্রুত সমাধান।
ঠিক এমনি মুহূর্তে ডোনাল্ড লু’র চিঠি তাই অনেকের কাছে সুড়ঙ্গের শেষ প্রান্তে ক্ষীণ আলোকরশ্মি মনে হচ্ছে। তারা মনে করছে, এর ফলে হয়তো সরকার ও বিরোধী দল একসঙ্গে বসে সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসবে। কিন্তু সমস্যা অন্য জায়গায়। ডোনাল্ড লু তার চিঠিতে সব পক্ষকে শর্তহীন সংলাপে বসার পরামর্শ দিলেও তারা কতটা আমলে নেবে বলা মুশকিল। কেননা বিএনপির এক কথাÑ সরকারের পদত্যাগ ছাড়া তারা সংলাপে বসবে না। অন্যদিকে সরকারের সাফ কথাÑ তাদের ভাষায় ‘খুনি-সন্ত্রাসীদের’ সঙ্গে সংলাপ হবে না। এখন দুই পক্ষ যদি তাদের অবস্থান থেকে সরে না আসে, তাহলে ডোনাল্ড লুর চিঠি ফলপ্রসূ হবে না। সে ক্ষেত্রে বর্তমান প্রবহমান ‘লু হাওয়া’ শেষ পর্যন্ত দেশকে কোথায় নিয়ে যায়, সেটাই চিন্তার বিষয়।