টু প্লাস টু বৈঠক
ড. ফরিদুল আলম
প্রকাশ : ১৪ নভেম্বর ২০২৩ ০০:৩২ এএম
গত ১০ নভেম্বর ভারতের রাজধানীতে
যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের পররাষ্ট্র এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রীদের মধ্যকার টু প্লাস টু বৈঠক
অনুষ্ঠিত হয়। সার্বিক বৈশ্বিক পরিস্থিতি নিয়ে দুই দেশের মধ্যকার স্বার্থসংশ্লিষ্ট ওই
বৈঠকে অনিবার্যভাবেই ঘুরেফিরে আসে বাংলাদেশের রাজনীতি এবং আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের
বিষয়টি। বৈঠক শেষে যৌথ প্রেস ব্রিফিংয়ে বিষয়টি উঠে না এলেও ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিনয়
কোয়াত্রার বক্তব্য থেকে জানা যায়, ভারতের দিক থেকে স্পষ্ট করে যুক্তরাষ্ট্রকে জানিয়ে
দেওয়া হয়েছে, তারা বাংলাদেশের রাজনীতি এবং নির্বাচনের বিষয়টিকে একান্তই অভ্যন্তরীণ
বিষয় বলে মনে করে। আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার স্বার্থে তারা এক্ষেত্রে কোনো ধরনের হস্তক্ষেপকে
সমীচীন বলে মনে করে না। কিছুদিন ধরেই বিষয়টি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের তরফে ভারতের ওপর এক
ধরনের চাপ ছিল। ভারত বিষয়টিকে নিয়ে কোনো ধরনের রাখঢাক না করে এর আগেও কয়েকবার তাদের
অবস্থান জানান দিয়ে রেখেছে। উল্লেখ্য, কিছুদিন আগে ওয়াশিংটনে মোদি-বাইডেনের মধ্যকার
শীর্ষ বৈঠকে প্রথমবারের মতো ভারতের অবস্থান মার্কিন সরকারকে জানিয়ে দেওয়া হয়। তারপরও
যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকে ভারতের ওপর এ নিয়ে কেন চাপ প্রয়োগ করা হচ্ছেÑ এর বিশ্লেষণ
প্রয়োজন।
আমরা অতীতেও দেখেছি, এখনও দেখছি
বাংলাদেশের নির্বাচনের আগমুহূর্তে সব সময়ই যুক্তরাষ্ট্র তথা পশ্চিমা বিশ্বের পক্ষ থেকে
গণতন্ত্র, বাক স্বাধীনতা, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, মানবাধিকার ইত্যাদি নানা ছদ্মাবরণে
অনাকাঙ্ক্ষিত উদ্বেগ প্রকাশ করতে। একটি দেশের সার্বভৌম শক্তির বলে যেখানে জনগণের দিক
থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অপরাপর রাষ্ট্র কর্তৃক এ ধরনের অতিমত্তাকে শুভলক্ষণ হিসেবে দেখা
হচ্ছে না। সেখানে বারংবার তাদের দিক থেকে উদ্বেগ প্রকাশের নামে এ ধরনের পদক্ষেপ কেবল
অরুচিকরই নয়, কূটনীতিক শিষ্টাচারের কোনো মানদণ্ডেই পড়ে না। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন প্রতিনিধিদলের
সফর, চাপ প্রয়োগ, শর্ত আরোপ এবং সর্বোপরি এদেশে অবস্থানরত কূটনীতিক মিশনগুলোকে কাজে
লাগিয়ে সরকারের অভ্যন্তরীণ নীতির সমালোচনা এবং সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে পরোক্ষ
উস্কানি প্রদানের মধ্য দিয়ে কার্যত তারা বাংলাদেশকে পেছনের দিকে টেনে নিতে চাইছে, এটা
বোঝার জন্য খুব বেশি বিদ্যা-বুদ্ধির প্রয়োজন পড়ে না। বৈশ্বিক নানা সংকট এবং যুদ্ধের
থাবায় যেখানে পশ্চিমা দেশগুলো নাকাল। বাংলাদেশের ব্যাপক উন্নয়ন এবং অর্থনৈতিক গতিধারা
বাধাহীনভাবে এগিয়ে যাওয়া সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্বের দিক থেকে যদি গণতন্ত্র
ও মানবাধিকারের এত বুলি আওড়ানো হয় কেন? সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন জাগে, এত মনোযোগের কিয়দাংশ
তারা কেন মধ্যপ্রাচ্যের ফিলিস্তিনের নির্যাতিত মানুষের জন্য নিবেদন করছে না? ইসরায়েলের
আগ্রাসন এবং ব্যাপকভাবে নারী ও শিশু হত্যায় যারা নিয়মিত প্ররোচনা জুগিয়ে যাচ্ছে, তাদের
মুখে আর যাই হোক বাংলাদেশের গণতন্ত্র, নির্বাচন এবং মানবাধিকার নিয়ে তথাকথিত উদ্বেগ
যথেষ্ট দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
ইতোমধ্যে জাপান, যুক্তরাষ্ট্রসহ
বেশ কয়েকটি দেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ৫০ বছর বা সুবর্ণজয়ন্তী পূর্ণ করেছে বাংলাদেশ।
তবে এক্ষেত্রে ভারত এবং বাংলাদেশের মধ্যকার সম্পর্ক সব সময়ের জন্যই অনন্য হয়ে আছে এবং
থাকবে। আর এর বড় কারণ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সক্রিয় সমর্থন এবং জাতীয় স্বার্থের
বিষয়ে উভয়ের মধ্যকার কিছু অভিন্নতা। বিষয়টি উপলব্ধি করতে পেরেই কলকাতায় জাতির পিতা
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালে বলেছিলেন, ‘উভয় দেশের মধ্যকার সম্পর্ক চিরন্তন’।
তিনি বোঝাতে চেয়েছেন এই সম্পর্কের মধ্যে কোনো চিড় ধরার সুযোগ নেই। সময়ের পরিক্রমায়,
বিশেষত ১৯৭৫ সালে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর অগণতান্ত্রিক পন্থায় দীর্ঘ দেড়
দশক রাষ্ট্র পরিচালনা, ১৯৯১ সালের নির্বাচনে তথাকথিত বেসামরিক শাসন এবং এসব কিছুর ছত্রছায়ায়
জেঁকে বসা অভ্যন্তরীণ অস্থিতিশীলতা, সন্ত্রাসবাদ এবং উগ্র ধর্মীয় মৌলবাদ বাংলাদেশের
আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থাকে যেমন কলুষিত করেছে। এর অপছায়া গিয়ে পড়েছে ভারতের রাজনীতিতেও।
এ সময়ের মধ্যে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই নিজেদের স্বার্থে এই অপশক্তিগুলোকে
পেলে পুষে যেমন বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে বিকশিত হতে দেয়নি, তেমনি এদেশকে
ব্যবহার করেছে তাদের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ভারতের বিরুদ্ধে। এই পুরো সময়টায় পাকিস্তানকে
সক্রিয় সহযোগিতা জুগিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ১৯৪৭ সালের পর থেকে পাকিস্তানের গণতন্ত্র বিকাশ
হতে না পারা এবং বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক চেতনার ওপর আঘাত একই সূত্রে গাঁথা।
বাংলাদেশ নিয়ে পশ্চিমাদের সঙ্গে
ভারতের এই দৃষ্টিভঙ্গির বৈপরীত্বের কারণ কীÑএ বিষয়ে স্পষ্ট হওয়া জরুরি। পশ্চিমা স্বার্থ
আসলে মার্কিন স্বার্থের অনুকূলেই পরিচালিত। এটা কেবল বাংলাদেশের ক্ষেত্রেই নয়, বৈশ্বিক
পরিসরেও আমরা দেখি মার্কিন দৃষ্টিতেই আসলে বিশ্বকে দেখে থাকে গোটা পশ্চিমা বিশ্ব। ভারতের
সঙ্গে এক্ষেত্রে দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য থাকার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এশিয়ার
বড় শক্তি চীনের প্রভাব অনেক বেড়েছে, সেই সঙ্গে বেড়েছে ভারতের সঙ্গে তাদের দূরত্ব। এদিকে
দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে ভারতের প্রভাববলয়েও অনেকটা চিড় ধরেছে। বাংলাদেশ ছাড়া অপরাপর দেশগুলোর
সবকটিতেই এ মুহূর্তে চীনপন্থি সরকার বিদ্যমান। বাংলাদেশের সঙ্গেই সামাজিক, রাজনৈতিক
এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ভারতের দ্বিপক্ষীয় স্বার্থের বিষয়টি অনেক বেশি। সেই সঙ্গে ভারতের
অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা, বিশেষ করে উত্তর-পূর্ব ভারতের ৭টি অঙ্গরাজ্যের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা
গত প্রায় দেড় দশক সময়ে পুরোপুরি ভারতের নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রয়েছে। এর পেছনে রয়েছে বাংলাদেশ
সরকারের বিশেষ অবদান। একটা সময় বাংলাদেশকে ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী বিভিন্ন গ্রুপগুলো
তাদের হীনস্বার্থ চরিতার্থের কাজে ব্যবহার করে এলেও বর্তমান সরকারের এক্ষেত্রে কঠোর
পদক্ষেপ ভারতের রাজনীতিতে অনেকটা স্বস্তি এনেছে। একইভাবে বাংলাদেশের ভেতর থেকে পরিচালিত
বিভিন্ন সন্ত্রাসী, জঙ্গি এবং মৌলবাদী গোষ্ঠী তাদের অপতৎপরতা পরিচালনার ক্ষেত্রে এদেশ
অতিক্রম করে ভারতে অবস্থান নেওয়া সেদেশের নিরাপত্তার ক্ষেত্রেও হুমকি ছিল। বাংলাদেশ
সরকার সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এক্ষেত্রে যথেষ্ট কাজ করেছে। এর ফলে বাংলাদেশের পাশাপাশি
ভারতের নিরাপত্তা উদ্বেগও অনেকাংশে প্রশমিত হয়েছে।
আমাদের মনে রাখতে হবে ভারতের
সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক আর বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ককে একই মাপকাঠি দিয়ে
বিবেচনা করলে চলবে না। ভূরাজনীতি এবং আঞ্চলিক রাজনীতি এক্ষেত্রে ভিন্নভাবে বিশ্লেষণ
করতে হবে। বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যে ভৌগোলিক সীমান্ত বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম। এক্ষেত্রে
সীমান্ত নিরাপত্তার বাইরেও দুই দেশের মধ্যকার অব্যাহতভাবে স্থিতিশীল সম্পর্কের মধ্যেই
উভয়ের ভবিষ্যৎ সমৃদ্ধি নির্ভর করছে। যদিও এই দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের মধ্যে জাতীয় স্বার্থের
বিষয়টি সর্বাগ্রে থাকে, তবে পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক নির্ভর করছে সামগ্রিক
ভূরাজনীতির আলোকে। এক্ষেত্রে ভূরাজনীতির পরিবর্তন সম্পর্কের পরিবর্তনে যথেষ্ট সহায়ক
ভূমিকা পালন করে। এও মনে রাখতে হবে, বর্তমান যুক্তরাষ্ট্র-ভারতের মধ্যকার সম্পর্ক ভূরাজনীতির
আলোকে এক ধরনের কৌশলগত পন্থায় পরিচালিত, যা নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝিতে তৎকালীন মার্কিন
প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের সময় থেকে চলমান। এর মধ্যে বৈশ্বিক রাজনীতিতে অনেক পরিবর্তন
এসেছে। তখনকার রাশিয়া ভঙ্গুর পরিস্থিতি উতরিয়ে আজ মার্কিন শক্তিমত্তাকে চ্যালেঞ্জ করছে।
এক মেরুকেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থা এখনও বর্তমান রয়েছে, এটা খোদ মার্কিনিদের পক্ষ থেকেও
জোর দিয়ে বলা হচ্ছে না। ইউক্রেন-রাশিয়ার মধ্যকার চলমান যুদ্ধে পশ্চিমাদের চোখ রাঙানি
উপেক্ষা করে ভারতের পক্ষ থেকে রাশিয়ার তেল আমদানি করা হচ্ছে। জানা গেছে, এই নিষেধাজ্ঞা
চলাকালীন সময়ে রাশিয়া থেকে ভারতের তেল আমদানি ১০ গুণ বেড়েছে এবং গত মে মাস নাগাদ এক
পরিসংখ্যানে দেখা যায়, এর মধ্য দিয়ে ভারত ৫০০ কোটি ডলার সাশ্রয় করেছে। চীনের সঙ্গে
সম্পর্কের তিক্ততা থাকলেও রাশিয়া নিয়ে চীন এবং ভারতের অভিন্ন অবস্থান বিশ্বরাজনীতিতে
পশ্চিমাদের প্রভাববলয়ে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে। সেই সঙ্গে চীন এবং ভারতের পক্ষ থেকে
ফিলিস্তিনের নিপীড়িত মানুষের প্রতি সহানুভূতি মধ্যপ্রাচ্যে পশ্চিমাদের অবস্থানকে নৈতিকভাবে
প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। এসব কিছু নিয়ে টু প্লাস টু বৈঠক, যা আগে কখনও দেখা যায়নি। এশিয়ার
শক্তি চীনের চোখ রাঙানি, অন্যদিকে ভারতের দিক থেকে বর্তমান বিশ্বরাজনীতির প্রায় সব
ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের বিপরীতে অবস্থান তাদের জন্য বেশ দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকে যে
বিষয়টি অনুমানের ক্ষেত্রে বড় ভুল, তা হচ্ছে এত কিছুর পরও তারা বারংবার বাংলাদেশের রাজনীতি
নিয়ে ভারতকে তাদের অবস্থান পরিবর্তনের জন্য চাপ দিয়ে যাচ্ছে। তারা জানে ভারতের মত আঞ্চলিক
শক্তির সহযোগিতা কিংবা নিষ্ক্রিয়তা ছাড়া বাংলাদেশের রাজনীতিতে তারা কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন
সাধন করতে পারবে না। বর্তমান বাংলাদেশ সরকার যে ভারতকে কোনো ধরনের ছাড় দিয়ে তাদের সমর্থন
পাচ্ছে, এমনটাও বলার কোনো সুযোগ নেই এক্ষেত্রে অভিন্ন কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার ক্ষেত্রে
নিজেদের মধ্যকার বোঝাপড়াই সবচেয়ে প্রধান নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে। আর তাই ভারতের আপত্তি
সত্ত্বেও বাংলাদেশ চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) সদস্য হয়েছে। চীনের
সঙ্গে ব্যাপকভাবে বাণিজ্যিক এবং অর্থনৈতিক সম্পর্কে আবদ্ধ হয়েছে, যা আগামী দিনগুলোতে
আরও বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। জোরালো কূটনৈতিক সামর্থ্য আমাদের এক ধরনের ভারসাম্যপূর্ণ
কূটনীতি রক্ষা করে চলতে সাহায্য করে যাচ্ছে। আর এর ওপর ভিত্তি করেই আমরা আগামী দিনগুলোতে
সব বিদেশি চক্রান্ত এবং ষড়যন্ত্রকে মোকাবিলা করে নিজেদের মর্যাদাকে সমুন্নত রাখতে পারব।