× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

রাজনৈতিক-সামাজিক মনস্তত্ত্ব

লিপস্টিক যখন স্টিক অব লিভিং

ইমতিয়ার শামীম

প্রকাশ : ১২ নভেম্বর ২০২৩ ০০:২৮ এএম

লিপস্টিক যখন স্টিক অব লিভিং

লিপস্টিক তার এ নামটি পেয়েছিল ১৮৮০ সালে। যদিও এর প্রচলন বলতে গেলে সৌন্দর্যচর্চার শুরুতেই। উচ্চবিত্ত মেসোপটেমিয়ানরা নাকি ঠোঁটে রত্নচূর্ণ লাগাতেন। ফারাও রানী ক্লিওপেট্রাও লাল রঙ লাগাতেন ঠোঁটে। সৌন্দর্যচর্চায় ব্যবহৃত প্রায় সব উপকরণেরই এমন ইতিহাস রয়েছে, যা কৌতূহলোদ্দীপক, চিন্তাজাগানিয়া এবং সুখপাঠ্যও। লিপস্টিকের মতো এমন সব উপকরণ প্রচলনের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে ধর্ম এবং রাজনীতির নানা বিতর্কও, জড়িত রয়েছে অর্থনীতি। লিপস্টিক নাম অর্জনের আগে থেকেই এর ব্যবহার ঘিরে দেখা দেয় নানা বিতর্ক; আর তা যে এখনও শেষ হয়নি, তা খানিকটা আঁচ করা যায় কয়েক দিন আগে আমাদের বাণিজ্যমন্ত্রীর এক ভাষ্য থেকেও। তিনি বলেছেন, তার অঞ্চলের মানুষ খুব ভালো আছে। তাদের রংপুরের নারীরা এখন দিনে তিনবার লিপস্টিক দিচ্ছে আর চারবার স্যান্ডেল বদলাচ্ছে। পুরুষরা কী করছে, তা অবশ্য বলেননি তিনি। অনুমান করি, তারা আলু চাষে ব্যস্ত আছে।

তবে বলা অত্যুক্তি হবে না, যেমন টিপ তেমনই লিপস্টিক সম্পর্কে আমরা যে ধারণা পোষণ করি, তাতে আমাদের রাজনৈতিক-সামাজিক মনস্তত্ত্বেরও প্রকাশ ঘটে। নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি কী, তারও প্রতিফলন ঘটে। ‘লিপস্টিক আন্ডার মাই বুরখা’ সিনেমাটির কথা নিশ্চয়ই অনেকের জানা আছে। জানা আছে অবরোধবাসী নারী কী করে নিভৃতে অবদমনের জগৎ পাড়ি দিয়ে বর্ণিল হয়ে উঠতে চায়। আমি নিজেই অন্তত দুজন মানুষকে জানি, লিপস্টিকের ব্যবহার যারা সহজভাবে নিতে পারেন না। তাদের একজন এ দেশের চিকিৎসা ক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে আমৃত্যু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। প্রগতিশীল মানুষ হলেও ঠোঁট রঞ্জিত করার ব্যাপারটি কেন যেন তিনি সহ্য করতে পারতেন না। এজন্য তার প্রতিষ্ঠানের পদস্থ নারী কর্মকর্তাকেও অপদস্থ হতে হয়েছে। জানি না ট্যাবু ভেঙে তারা কোনো দিন এ প্রসঙ্গে মুখ খুলবেন কি না। আরেকজন আছেন, বাঙালি সমাজ-সংস্কৃতি-শিক্ষা বিকাশে নিবেদিত একটি প্রতিষ্ঠানে যিনি অগ্রণী ভূমিকায় নিবেদিত। কপালে টিপ দেওয়ার ব্যাপারে তার সবিশেষ দুর্বলতা ও পক্ষপাতিত্ব থাকলেও কোনো সহকর্মী ও ছাত্রীকে লিপস্টিক ব্যবহার করতে দেখলেই তিনি প্রচণ্ড খেপে যান। ওই প্রতিষ্ঠানের অনেক তরুণীকে লিপস্টিক ব্যবহারের অপরাধে অন্তত বাক্যবাণে লাঞ্ছিত হতে হয়েছে। হয়তো ভবিষ্যতেও হতে হবে।

লিপস্টিককে বাংলায় অনেকে বলেন ওষ্ঠরঞ্জনী। এ ওষ্ঠরঞ্জনীর ব্যবহার নাকি প্রাচীন গ্রিসের যৌনদাসী বা যৌনকর্মীদের জন্য ছিল রীতিমতো বাধ্যতামূলক। যৌনকর্মী হওয়ার পরও লিপস্টিক না লাগালে সেই নারীকে শাস্তি দেওয়া হতো। এমনকি রানী ভিক্টোরিয়ার যুগেও লিপস্টিককে যৌনকর্মীদের প্রসাধনসামগ্রীর অন্তর্ভুক্ত করা হতো। জানি না, যারা লিপস্টিকবিরোধী, তারাও তেমন ভাবেন কি না। খ্রিস্টধর্মের প্রাথমিক বিকাশ পর্বেও লিপস্টিকের ব্যবহারকে ভালো চোখে দেখা হতো না। বিশেষত লাল রঙের লিপস্টিক ব্যবহারকে তখন মনে করা হতো শয়তানের কাজ। শেষ পর্যন্ত যাজকরা বিষয়টি ঘিরে একটি সমঝোতায় যেতে বাধ্য হন। তারা ঘোষণা দেন, কেবল গোলাপি রঙের লিপস্টিক ব্যবহার করা যাবে। কেননা প্রাকৃতিক গোলাপি রঙ নারীদের পাপহীনতার প্রতীক, এ রঙের ব্যবহারও তাই তাকে অপাপবিদ্ধ করে তোলে।

ভিক্টোরিয়ান যুগেই সূত্রপাত ঘটে নারীবাদের। তখন অনেক নারীর কাছেই লিপস্টিক হয়ে ওঠে সমাজের প্রচলধারণা অস্বীকার করার প্রতীক, বিদ্রোহের প্রতীক। এখন অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে দেখা দিয়েছে লিপস্টিকতত্ত্ব। যার মোদ্দা কথা, লিপস্টিকের আমদানি বৃদ্ধি থেকে কিংবা স্থানীয় বাজারে কেনাবেচা বৃদ্ধি থেকেই বোঝা যায়, সেই দেশটিতে জীবনযাপনের মান কমে যাচ্ছে নাকি বেড়ে যাচ্ছে। লিপস্টিক হয়ে উঠেছে ‘স্টিক অব লিভিং স্ট্যান্ডার্ড’। ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক মন্দার সময় এ লিপস্টিকতত্ত্বের কার্যকারিতা লক্ষ করা যায়। একই অবস্থা দেখা গেছে ২০০৮ সালে, এমনকি ১৯২৯ সালের অর্থনৈতিক মন্দার সময়ও। ২০০৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রসাধন কোম্পানি এস্টি লাউডারের চেয়ারম্যান লিওনার্দ লাউডার জানান, মন্দায় অন্যান্য প্রসাধনসামগ্রীর বিক্রি কমলেও লিপস্টিকের বিক্রি বেড়েছে। তিনি একে অভিহিত করেন ‘লিপস্টিক এফেক্ট’ হিসেবে। অর্থনীতিবিদরা এর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলছেন, অর্থনীতিতে যখন মন্দা দেখা দেয়, তখন মানুষ বিলাসবহুল প্রসাধনসামগ্রীর ব্যবহার কমিয়ে ফেলে, ঝুঁকে পড়ে অল্প দামি জিনিসপত্রের দিকে। তা ছাড়া অধিকাংশ মানুষেরই বিশেষ প্রবণতা হলো, কষ্টের সময় নিজেকে এমনভাবে সাজানো, যাতে চেহারায় কষ্টের ছাপ না থাকে। নারীদের মধ্যে তাই এ সময় লিপস্টিকের ব্যবহার আরও বেড়ে যায়। বিক্রিবাট্টা বাড়তে থাকে লিপস্টিকের।

লক্ষণীয় ব্যাপার হলো, যেসব তথ্য-উপাত্ত বা পরিসংখ্যান মিলছে, তা থেকে পরিষ্কার, বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও এ লিপস্টিক এফেক্ট নেমে এসেছে। এ দেশে অবশ্য পণ্যভিত্তিক খুচরা বেচাকেনার উপাত্ত পাওয়া কঠিন। কিন্তু আমদানিসংক্রান্ত যেসব পরিসংখ্যান রয়েছে, তা থেকে দেখা যাচ্ছে, লিপস্টিকের আমদানি চলতি বছর আগের বছরের তুলনায় বেড়েছে, যার অর্থ এখানকার স্থানীয় বাজারে লিপস্টিকের চাহিদা বেড়েছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের হিসাব বলছে, চলতি বছর জুলাই থেকে অক্টোবর অবধি ৪০ হাজার ৭৭৫ কেজি লিপস্টিকজাতীয় পণ্য আমদানি হয়েছে। কিন্তু ২০২২-২৩ অর্থবছরের একই সময়ে এ পণ্য আমদানি হয়েছিল ২৬ হাজার ৮৫৩ কেজি, যার অর্থ এখানকার মানুষজনও এ কম দামি উপকরণটির দিকে ঝুঁকে পড়েছে। তার মানে বাণিজ্যমন্ত্রী যা বলছেন, তথ্যের দিক থেকে তার সত্যতা মিললেও উপসংহারটি একদমই অন্যরকম। এখানে, এই বাংলাদেশে মানুষ এখন খুবই অসহায়। চলতি বছরের গত মাসে জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) ‘বাংলাদেশ ফুড সিকিউরিটি মনিটরিং রিপোর্ট : মে-আগস্ট’ নামে একটি জরিপ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, দেশের প্রতি চারজনের একজন এখন খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় রয়েছে। এ রিপোর্টটি অবশ্য প্রণীত হয়েছে পরিবেশ ও জলবায়ুগত মানদণ্ডের ভিত্তিতে। বলা হয়েছে, এ দেশে খাদ্য পরিস্থিতি অবনতির অন্যতম কারণ প্রাকৃতিক দুর্যোগ বেড়ে যাওয়া এবং দুর্যোগের কারণে মানুষের ফসলের ক্ষয়ক্ষতি বেড়ে চলা। কিন্তু খাদ্যনিরাপত্তাহীনতা তৈরির ক্ষেত্রে যে এখানকার রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও রাজনৈতিক সংস্কৃতিও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে, তা ওই রিপোর্টে অনুক্তই রয়ে গেছে। ডব্লিউএফপির ওই প্রতিবেদনমতে, সামগ্রিকভাবে দেশের ২৪ শতাংশ এবং হতদরিদ্র পরিবারগুলোর ৪৬ শতাংশ মানুষ বর্তমানে খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার গহ্বরে হাবুডুবু খাচ্ছে। খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়া এ জরিপে অংশগ্রহণকারী ৭১ শতাংশ পরিবারের মতে সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয়। তাতে দেখা যাচ্ছে, প্রতি ১০ জনের সাতজনই এখন চেষ্টা করছে জীবনযাত্রার মান কমিয়ে ব্যয় আয়ত্তের মধ্যে রেখে বেঁচে থাকতে। খাবার কেনার জন্য ঋণগ্রস্ত হওয়া মানুষের সংখ্যাও এখন ক্রমেই বাড়ছে। বাকিতে খাবার কিনছে, নিম্ন আয়ের মানুষের মধ্যে এ সংখ্যা চলতি বছরের মে-তে ছিল ৩২ শতাংশ, যা আগস্টে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৬ শতাংশে। এভাবে বাকিতে খাবার কিনতে যাওয়া মানুষের সংখ্যা সিলেটে ছিল ৫৩ আর চট্টগ্রামে ৫৮ শতাংশ। অন্যদিকে জাতিসংঘের পাঁচটি সংস্থার ২০২৩ সালের বৈশ্বিক খাদ্যনিরাপত্তা ও পুষ্টিসংক্রান্ত প্রতিবেদন জানাচ্ছে, দেশের সোয়া ৫ কোটির বেশি মানুষ তীব্র থেকে মাঝারি ধরনের খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় রয়েছে। এর মধ্যে তীব্র খাদ্যনিরাপত্তাহীনতা গ্রাস করেছে ১ কোটি ৮৭ লাখ মানুষকে।

আমাদের গার্মেন্ট শিল্পের দিকে তাকালেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে, আমাদের রাজনীতি এবং রাজনৈতিক সংস্কৃতিও খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার ক্ষেত্রে কী নেতিবাচক ভূমিকা রেখে চলেছে। ১২ হাজার ৫০০ টাকা বেতনে একজন শ্রমিকের সংসার চলতে পারে না, মজুরি যৌক্তিক করতে হবে, এ দাবিতে রাজপথে নামতে কোনো উস্কানি লাগে না। আর যদি কারও উস্কানি আছে বলে মনে হয়, সে ক্ষেত্রে এও একবার ভাবা জরুরি, উস্কানি দেওয়ার মতো পরিস্থিতি শ্রমিকপক্ষ তৈরি করেনি, করে রেখেছে অন্য পক্ষগুলোই। এ দেশে উস্কানির রাজনীতি যেমন আছে, তেমন অপবাদের রাজনীতিও আছে। আর উস্কানি ও অপবাদের রাজনীতি থাকার মানেই হলো, সুস্থ রাজনীতির ধারাও আছে; সুস্থ রাজনীতির সেই ধারাটি যাতে মরে যায়, শুকিয়ে যায় সে কারণেই শাসক ও শোষকদের উস্কানি ও অপবাদের রাজনীতি জিইয়ে রাখতে হয়। মজুরি বৃদ্ধি বোর্ডের বৈঠকে সরকার ও শ্রমিক পক্ষ উভয়েই নীরবতার সঙ্গে দরকষাকষি না করে যেভাবে মালিকপক্ষের প্রস্তাব মেনে নিয়েছে, তাতে স্পষ্ট যে গোটা ব্যাপারটাই সাজানো। সাধারণ মানুষ প্রত্যাশা করেছিল, শ্রমিকদের দাবি অনুযায়ী মজুরি ২০ হাজার টাকা না হোক, সিপিডির প্রস্তাব অনুযায়ী ১৭ হাজার না হোক, সরকারপক্ষ সেটি অন্তত ১৫-১৬ হাজার টাকায় উন্নীত করার জোর উদ্যোগ নেবে। কিন্তু তাও হয়নি।

গার্মেন্ট শ্রমিকদের এবারের এ আন্দোলনে শহীদ হয়েছেন সিরাজগঞ্জের আনজুয়ারা বেগম। এখন তার এ শহীদান নিয়ে শুরু হয়েছে রাজনীতি। গুলিতে মৃত্যু হলে তদন্ত করতে হয়, কার গুলিতে মৃত্যু হলো তা জানাতে হয়; তাই বলা হচ্ছে, গুলিতে নয়, তিনি মারা গেছেন পদপিষ্ট হয়ে! তার ঠোঁটে সেদিন লিপস্টিক বা ওষ্ঠরঞ্জনী ছিল কি না জানি না; জানি না জীবনযাপনের ওই সামান্য মানদণ্ডটুকুও তার ছিল কি না, তবে পুলিশের গুলিতে নিজেকে রক্তে রঞ্জিত করে তিনি জানিয়ে দিয়ে গেছেন, তারা আসলে কেমন আছেন। গার্মেন্টস শ্রমিক আনজুয়ারার লাশ দাফনের পর তার আট বছরের ছেলে আরিফ তার প্রিয় সস্তা প্লাস্টিকের অ্যাঁও অ্যাঁও গাড়িটি ছুড়ে ফেলে দিয়েছে পুকুরের মধ্যে। মায়ের মৃত্যুতে সে নাকি একবারও কাঁদেনি, একবারও তার চোখের কোণে জলের আভাস দেখা যায়নি।

আমরা কি আসলেই কখনও ভাবি, জীবনযাপনেরÑউন্নয়নের কী মানদণ্ড আমরা তৈরি করে চলেছি?

  • সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা