খাসভূমি
শেখ ইউসুফ হারুন
প্রকাশ : ১২ নভেম্বর ২০২৩ ০০:২৫ এএম
দাপ্তরিক কাজে কয়েক দিন আগে দ্বীপ জেলা ভোলা গিয়েছিলাম। ভোলা জেলা হিসেবে স্বীকৃতি পায় ১৯৮৪ সালে। ১৮৪৫ সালে সাব-ডিভিশন হিসেবে ভোলা নোয়াখালী জেলার সঙ্গে সংযুক্ত ছিল। পরে ১৮৬৯ সালে সাব-ডিভিশন হিসেবে বরিশাল জেলার অধীনে যুক্ত হয়। ভোলা শহরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত বেতুয়া নদীতে খেয়া পারাপারকারী বৃদ্ধ মাঝি ভোলা গাজী পাটনীর নামে ভোলা জেলার নামকরণ হয়। ভোলা পদ্মা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা অববাহিকায় পলি দ্বারা গড়ে ওঠা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর এক জেলা। এ জেলায় মনপুরা ও চর কুকরি মুকরি, ঢালচর, লতার চর, চর নিজাম দ্বীপসমূহ পর্যটকদের কাছে আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। নারকেল, সুপারি, ধান, মাছ মূল কৃষিপণ্য হিসেবে বিবেচিত হলেও কাঁচা মহিষের দুধের দই ও ঘি এ জেলার কৃষিপণ্যকে বৈচিত্র্য এনে দিয়েছে। প্রাকৃতিক সম্পদেও ভোলা পিছিয়ে নেই। এ জেলার শাহবাজপুরে আবিষ্কৃত হয়েছে গ্যাসক্ষেত্র। এখন পর্যন্ত খননকৃত ৯টি কূপে ১ দশমিক ৭ ট্রিলিয়ন ঘনফুট প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুদ রয়েছে বলে জানা যায়। নতুন এই কূপ থেকে দৈনিক ২০ থেকে ২২ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পাওয়া যাবে। বিশাল ব্যয়ের কথা বিবেচনা করে কালাবদর নদী পার করে এ গ্যাস জাতীয় গ্রিড লাইনে নিয়ে আসা ‘ফিজিবল’ নয় বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
ভোলায় কোনো অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলা যায় কি না, তা যাচাই করার উদ্দেশ্যেই সেখানে যাই। ওখানে যদি একটি সরকারি ও একটি বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করা যায়, তবে দ্বীপ জেলা ভোলার কর্মহীন মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে বলে মনে করি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বেজার গভর্নিং বোর্ডের চেয়ারপারসন হিসেবে ভোলায় একটি সরকারি জোন প্রতিষ্ঠার সদয় নির্দেশনা প্রদান করেছেন। ভবিষ্যতে নিশ্চয়ই ভোলায় একটি সরকারি জোন স্থাপন করা হবে। অনুমোদন পেলে একটি বেসরকারি জোনও এখানে স্থাপন করা যেতে পারে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ভোলা জেলার সদর উপজেলার বাগমারা মৌজার তেঁতুলিয়া নদীর প্রাকৃতিকভাবে ভরাট হওয়া ভূমিতে একটি সরকারি অর্থনৈতিক জোন প্রতিষ্ঠা করার বিষয়ে বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যানকে নির্দেশনা প্রদান করে। কিন্তু বেজার অনুকূলে ভূমি বরাদ্দ না পাওয়ায় এ জোনটি প্রতিষ্ঠা করা যাচ্ছে না। তেঁতুলিয়া নদীর গতিপথ ভিন্ন ধারায় প্রবাহিত হলে পূর্বের নদীটি ভরাট হয়ে গড়ে উঠেছে বিশাল এক চর। এ চরভূমি স্থায়ী নাল ভূমিতে রূপান্তরিত হয়েছে বহু বছর আগে। এলাকার ভূমিদস্যুরা বিভিন্নভাবে মামলা-মোকদ্দমা করে চরটি নিজেদের ভূমি বলে প্রমাণ করার চেষ্টা করলেও সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের রায়ে এটি নদীভরাট চরভূমি হিসেবে রাষ্ট্রের মালিকানা নিশ্চিত হয়েছে। কিন্তু ভূমিদস্যুরা থেমে নেই। ভূমি প্রশাসনের দুর্বলতার সুযোগে চলমান আরএস জরিপে তাদের নামে সম্পূর্ণ ভূমি রেকর্ড করিয়ে নিয়েছেন। জেলা প্রশাসন জোনাল সেটেলমেন্ট অফিসার বরারর একটি পত্র দিয়ে তাদের দায়িত্ব শেষ করেছে।
ভূমি জরিপ একটি দীর্ঘমেয়াদি ও জটিল প্রক্রিয়া। ১৮৮৫ সালের জরিপ আইনে জরিপপ্রক্রিয়া পরিচালিত হয়। জরিপ শুরু হলে শেষ করতে কোনো কোনো সময় ৫০ বছর বা তার অধিক সময় ব্যয় হয়। প্রজাস্বত্ব বিধিমালা, ১৯৫৫-এর বিধি ২৭, ২৭ এ ও ২৮ অনুযায়ী মাঠপর্যায়ে জরিপকাজ শেষ হলে ওই বিধিমালার ২৯ বিধি অনুসারে সেটেলমেন্ট অফিসার খসড়া খতিয়ান প্রকাশ করেন। খতিয়ান প্রকাশের আগে খসড়া খতিয়ান প্রকাশের সময়সূচি প্রদান করে বিজ্ঞপ্তি জারি করে। বিজ্ঞপ্তির কপি কালেক্টর (জেলা প্রশাসক), উপজেলা নির্বাহী অফিসার, এসি ল্যান্ডসহ বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে প্রেরণ করা হয়ে থাকে। এ সময় ভূমি ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মকর্তা বিশেষ করে এসি ল্যান্ড বা সহকারী ভূমি কর্মকর্তাদের দায়িত্ব হলো খাসভূমি রাষ্ট্রের পক্ষে জেলা প্রশাসক বা কালেক্টরের নামে রেকর্ড হয়েছে কি না, তা পরীক্ষা করে দেখা। যদি কালেক্টরের নামে রেকর্ড না হয়ে থাকে তবে ৩০ বিধি অনুযায়ী সহকারী সেটেলমেন্ট অফিসার বা রাজস্ব কর্মকর্তার নিকট আপত্তি দায়ের করতে হয়।
জরিপ চলাকালে খাসভূমি রাষ্ট্রের পক্ষে রেকর্ড করার এটাই বিধিবদ্ধ নিয়ম। ৩০ বিধি অনুযায়ী প্রতিকার না পাওয়া গেলে ৩১ বিধি অনুযায়ী আপিল দায়ের করা যায়। জরিপ বিভাগ আপিল শুনানির পর ৩২ বিধি অনুযায়ী চূড়ান্ত রেকর্ড প্রকাশ করে। সেখানেও খাস বা সরকারি ভূমি অন্যের নামে রেকর্ড হলে ৪২ক ও ৪২খ বিধি অনুযায়ী মহাপরিচালক, জরিপ অধিদপ্তর বরাবর প্রতিকার প্রার্থনা করা যায়। কিন্তু ভোলার ক্ষেত্রে আপত্তি দায়েরের সময় অতিক্রান্ত হওয়া সত্ত্বেও জেলা প্রশাসন আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো আপত্তি দায়ের করেনি। মৌজার রেকর্ড কার্যক্রম এখন আপিল পর্যায়ে চলছে। এখন সরাসরি আপিল দাখিলের কোনো সুযোগ নেই। এতগুলো স্তর অতিক্রম করার পরও যদি কোনো খাস বা সরকারি ভূমি ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের অগোচরে ব্যক্তির নামে রেকর্ড হয়ে যায় তবে খতিয়ান চূড়ান্তভাবে প্রকাশিত হওয়ার পর ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনালে মামলা করা যায়। উপযুক্ত ব্যবস্থা নিলে খাসভূমি ব্যক্তিমালিকানায় রেকর্ড হওয়ার কোনো কারণ নেই।
বললাম ভূমি ব্যবস্থাপনা বিভাগের দায়িত্বের কথা। কিন্তু জরিপ বিভাগের কথা না বললেই নয়। তাদেরও খাসভূমি রাষ্ট্রের অনুকূলে রেকর্ড করার দায়িত্ব রয়েছে। জরিপ বিভাগের মাঠপর্যায়ে জরিপের মূল কাজ করেন মৌসুমি কর্মচারীরা। তাদের মূলত কোনো দায়দায়িত্ব নেই। ‘ফুল টাইম’ কর্মচারীরা যেখানে কাজ করেন না সেখানে মৌসুমি কর্মচারীদের কাছ থেকে কতটুকু কাজ আশা করা যায়। ভরাট করা নদীর যা সিএস ও এসএ খতিয়ানে নদী হিসেবে রেকর্ড ছিল তা কী করে ব্যক্তিমালিকানায় রেকর্ড হয়? জরিপের সময় মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা কী চোখ বন্ধ করে ছিলেন? এসব বিষয় দেখার কী কেউ নেই? আসলে এর পেছনে রয়েছে দুর্নীতি বা কর্তব্যকর্মে চরম অবহেলা। জরিপ বিভাগের মাঠপর্যায়ের জরিপের ফলাফল প্রকাশ হতে অনেক সময় ব্যয় হয়। খাসভূমি ব্যক্তির নামে রেকর্ডের বিষয়টি যখন প্রকাশিত হয় তখন জড়িত কর্মচারীদের আর পাওয়া যায় না।জজরিপ বিভাগ বা জেলা প্রশাসন এসব বিষয়ে নির্বিকার। অথচ সার্ভে ও সেটেলমেন্ট প্রশিক্ষণে প্রশাসন ক্যাডারের সব কর্মকর্তাকে জরিপপ্রক্রিয়া এবং এর প্রতিটি ধাপে কার কী কর্তব্য তা অবহিত করা হয়ে থাকে।
বদ্বীপের এই বাংলাদেশে প্রাকৃতিক নিয়মেই নদীর গতিপথ পরিবর্তিত হয়। নদী তার হারানো গতিপথে ফেলে রেখে যায় প্রচুর পরিমাণে খাসজমি। সময়ের পরিক্রমায় এ খাসভূমি চলে যায় প্রভাবশালীদের দখলে। তারা বিভিন্নভাবে মামলা-মোকদ্দমা ও ভূমি প্রশাসনের দায়িত্বহীনতার কারণে একসময় নিজেদের নামে রেকর্ড করাতে সমর্থ হয়। এ চিত্র বাংলাদেশের সর্বত্র। অথচ ভূমিস্বল্পতার এ দেশে এসব ভূমিতে পরিকল্পিতভাবে শিল্পায়ন করা গেলে শিল্পায়নের জন্য সরকারের আবাদি জমি অধিগ্রহণ করতে হয় না। এতে প্রকল্প ব্যয় অনেক কমে যায় এবং কৃষিজমি সংকোচন হতে দেশ বেঁচে যায়। একই কারণে টাঙ্গাইল, সাতক্ষীরা, নাটোর জেলায়ও অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করা যাচ্ছে না। খোঁজ করলে দেখা যাবে বাংলাদেশের বড় বড় নদী বা সাগর উপকূলের জেলাগুলিতে নদী ভরাট প্রচুর পরিমাণ খাসভূমি প্রভাবশালী ব্যক্তিদের নামে রেকর্ড হয়ে গেছে। জেলা প্রশাসনের এ বিষয়ে নজর দেওয়া প্রয়োজন। ভূমি মন্ত্রণালয়েরও বিষয়টি খতিয়ে দেখার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। তা না হলে একসময় দেখা যাবে, বাংলাদেশে আর কোনো খাসভূমি অবশিষ্ট নেই।