স্মরণ
মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী ছিলেন একাধারে সাংবাদিক ও সাহিত্যিক। ১৩০৩ বঙ্গাব্দের ২৮ ভাদ্র সাতক্ষীরার বাঁশদহ গ্রামে তাঁর জন্ম। তাঁর বাবা মুনশি মোহাম্মদ ইব্রাহিম ছিলেন পল্লীচিকিত্সক। বাবার চিকিৎসাকেন্দ্রে নিয়মিত সংবাদপত্র পাঠ ও নানা বিষয়ে বিতর্ক চলত। ওই সময় ওয়াজেদ আলী নিজেও এসব আলোচনা উপস্থিত থেকে শুনতেন। এসব আলোচনা বিভিন্ন সময় তাঁকে প্রভাবিত করেছে। ছোটবেলায় বাবার কাছ থেকেই সাংবাদিকতার স্বপ্ন বুকে বুনে নিয়েছিলেন। ওয়াজেদ আলীর শিক্ষাজীবন শুরু হয় বাঁশদহের মধ্য ইংরেজি বিদ্যালয়ে। স্থানীয় বাবুলিয়া উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয় থেকে বৃত্তিসহ এন্ট্রাস পাস করার পর তিনি কলকাতার বঙ্গবাসী কলেজে এফএ ক্লাসে ভর্তি হন। মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ এবং ইংরেজি ‘দি মুসলমান’ পত্রিকার সম্পাদক মৌলভী মুজীবুর রহমানের সংস্পর্শে এসে তিনি জাতির সেবা করার আদর্শে উদ্বুদ্ধ হন। পরীক্ষার আগেই পড়াশোনা চুকিয়ে সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে নেন। একই সঙ্গে যোগ দেন ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনবিরোধী অসহযোগ আন্দোলনে। সাংবাদিক জীবনের শুরুতে ১৯০৬ সালে ওয়াজেদ আলী চাকরি নেন ‘দি মুসলমান’ পত্রিকায়। এরপর ১৯০৮ সালে কাজ করেছেন আকরম খাঁর সাপ্তাহিক মোহাম্মদীর সম্পাদকীয় বিভাগে। ১৯২১ সালে দৈনিক সেবকে কর্মরত ছিলেন। একই বছর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন দৈনিক মোহাম্মদীর। ১৯২২-এ দ্বিপাক্ষিক সাম্যবাদী সম্পাদনা করেছেন। ১৯২৬ সালে সাপ্তাহিক খাদেম এবং ১৯২৮ সালে সাপ্তাহিক সওগাতের সম্পাদকীয় বিভাগে ছিলেন। এর মধ্যে ১৯২৪ সালের দিকে বিয়ে করেন শাহের বানুকে।
মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী
বিশ শতকের মধ্যভাগে প্রাঞ্জল ভাষায় প্রবন্ধ রচনায় মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী খ্যাতি লাভ করেন। মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী ছিলেন মুসলিম কৃষ্টি ও সমাজ জীবনের একজন ব্যাখ্যাকার এবং একজন আদর্শবাদী সাহিত্যিক। তিনি সরকারি চাকরি পরিত্যাগ করে সাংবাদিকতা ও সাহিত্যচর্চার মাধ্যমে সমাজসেবাকে জীবনের ব্রত হিসেবে গ্রহণ করেন। তিনি মুসলিম সমাজের নানা দোষত্রুটি, নতুন রাজনৈতিক পটভূমিতে সমাজ ও জীবন বিকাশের ধারা এবং ভাষা ও সাহিত্যের গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে সমকালীন পত্রপত্রিকায় বহু মূল্যবান প্রবন্ধ রচনা করেন। তিনি যুক্তিবাদী মন ও পরিচ্ছন্ন চিন্তার অধিকারী ছিলেন। দুই শতাধিক গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ লিখলেও জীবদ্দশায় তাঁর বই বেরিয়েছিল খুব কম। তাঁর লেখা ছোট বা মাঝারি আটটি গ্রন্থের হদিস পাওয়া যায়। তার বিষয়বস্তু ছিল ইসলামের আদর্শ-ঐতিহ্য-মূল্যবোধ। শিক্ষা, সাহিত্য, ধর্ম ও ভাষা সম্পর্কে তিনি অনেক মূল্যবান প্রবন্ধ লিখে গেছেন। ছোট ও মাঝারি আকারের জীবনী, অনুবাদ ইত্যাদি মিলিয়ে তাঁর আটটি গ্রন্থ পাওয়া যায়। সেগুলো হলো মরুভাস্কর, স্মার্ণানন্দিনী (অনুবাদ), ছোটদের হযরত মোহাম্মদ, কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, মোহাম্মদ আলী, ডন কুইজসোটের গল্প, মহামানুষ মুহসিন ও সৈয়দ আহমদ। এগুলোর মধ্যে মরুভাস্কর ও স্মার্ণানন্দিনী বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ওয়াজেদ আলী প্রথম দিকে ইংরেজিতেও কিছু প্রবন্ধ রচনা করেছেন। স্বাস্থ্যহানির দরুন ১৯৩৫ সালে নিজ গ্রামে ফিরে যান। জীবনের বাকি দুই দশক কাটিয়ে দেন সেখানেই। ১৯৫৪ সালের ৮ নভেম্বর নিজ গ্রামেই তাঁর মৃত্যু হয়।
তার রচনার একটি বড় বৈশিষ্ট্য, সহজ-সাবলীল প্রকাশভঙ্গি। বাংলা একাডেমি তাঁর রচনাবলির অংশবিশেষ দুই খণ্ডে প্রকাশ করেছে। আদর্শনিষ্ঠ ওয়াজেদ আলী এতই দৃঢ়চেতা ছিলেন যে, সরকারি চাকরি পেয়েও তা করেননি। বরং সাংবাদিকতা ও সাহিত্যের মাধ্যমে সমাজসেবাকে জীবনের ব্রতরূপে গ্রহণ করেছিলেন। যুক্তিবাদী মানস এবং পরিচ্ছন্ন চিন্তার অধিকারী এই মানুষটির প্রয়াণ দিবসে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।