নগর যোগাযোগ
১
বিশ্বের সবচেয়ে ধীরগতির নগর কিংবা শহর ঢাকা। গত সেপ্টেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ব্যুরো অব ইকোনমিক রিসার্চ একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সংস্থাটি বিশ্বের ১৫২টি দেশের ১ হাজার ২০০টির বেশি নগর কিংবা শহরে যান চলাচলের গতি বিশ্লেষণ করে। বিশ্লেষণে বলা হয়, ধীরগতির শহরের মধ্যে ঢাকা রয়েছে প্রথম স্থানে। যারা ঢাকায় থাকে, তারা কিন্তু খবরটি শুনে চমকে ওঠেনি। বরং স্বাভাবিকই মনে হয়েছে। খবরটি শুনে মনের মধ্যে কোনো হেলদোলও কাজ করেনি। যেন এ আর এমন কী খবর। এর জন্য গবেষণা লাগে? এ তো চোখ বন্ধ করেই বলে দেওয়া যায়। সেই ঢাকা, ধীরগতির নগর বা শহরে যখন মেট্রোরেল চালু হয়, তখন সেটিই হয়ে ওঠে চমকে দেওয়ার খবর। ঢাকার বুকে মেট্রোরেল ছুটছে একশ কিলোমিটার গতিতে। এটাই তো অবাক করা, চমকে যাওয়ার খবর। যখন মেট্রোরেলের কাজ শুরু হয়, তখন চলতি পথের যাত্রীদের ‘কী হবে, কবে হবে’ এমন নানা প্রশ্ন ছিল। চলতি পথে ছিল বিস্ময় ও বিরক্তি নিয়ে চেয়ে থাকা। দুর্ভোগেরও কমতি ছিল না। মিরপুর-১২ থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত রাস্তা যেন হয়ে উঠেছিল দুর্ভোগেরই আরেকটি নাম। বাসে ওঠার পর কখন গন্তব্যে পৌঁছাবে, তারও নিশ্চয়তা ছিল না। মেট্রো নির্মাণে বেশি ভোগান্তি গেছে মিরপুরবাসীরই। সেই ভোগান্তি-দুর্ভোগ শেষে ২৮ ডিসেম্বর ২০২২ সালে খুলে যায় এমআরটি লাইন-৬। এদিন মেট্রোরেলের দিয়াবাড়ী থেকে আগারগাঁও অংশ উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পরদিন ২৯ ডিসেম্বর থেকে জনসাধারণের চলাচলের জন্য চালু হয় মেট্রোরেল। আংশিক চালু হলেও এর মাধ্যমে বাংলাদেশ প্রবেশ করে যোগাযোগের নতুন দিগন্তে। প্রথম দিনেই মেট্রো জয় করে যাত্রীদের মন। প্রাথমিক পর্যায়ে ছিল ভ্রমণাকাঙ্ক্ষী এবং কৌতূহল নিবৃত্ত করা মানুষের চাপ। ধীরে ধীরে ওই অধ্যায়েরও শেষ হয়। আর এখন তো লাইনের পুরো অংশই উন্মুক্ত। উত্তরা থেকে ছুটছে মতিঝিল। ফলে যাত্রীদের দুর্ভোগ কমেছে, সময়ও বেঁচেছে।
২.
প্রাথমিকভাবে মেট্রোর যে অংশের উদ্বোধন হয়, তা আমার নিয়মিত পথ নয়। তবু কৌতূহল মেটাতে দুয়েকবার ওঠা হয়। এখন পুরো পথ খুলে গেলেও সেটিও আমার নিয়মিত যাত্রাপথ নয়। তবে পথের পুরো অংশ খুলে যাওয়ায় একটি সুবিধা পেয়েছি। তা হলো, নতুন অংশের যাত্রাপথে নিয়মিত না হলেও প্রায়ই আসা-যাওয়ার প্রয়োজন হবে। সেই প্রয়োজন থেকেই মেট্রোরেলের পুরো অংশের উদ্বোধনের দ্বিতীয় দিনেই আবারও মেট্রো স্টেশনে। যাত্রী রয়েছে, তবে অফিসের সময় নয় বলেই তুলনামূলক ভিড় কম। উৎসাহী যাত্রী প্রায় নেই বললেই চলে। যারা রয়েছে, তাদের এ পথের নিয়মিত যাত্রী বলেই মনে হলো। স্টেশনের টিকিট কাউন্টারের বাইরে আলাদা করা র্যাপিড পাস-নেওয়ার স্থান। নিয়মিত না হলেও, কাজে দেবে ভেবে কাউন্টারে খোঁজ নিই র্যাপিড পাসের বিষয়ে। বাইরেই নির্ধারিত স্থানে রাখা রয়েছে পাস গ্রহণের নির্ধারিত ফাঁকা আবেদনপত্র এবং সুতোয় বাঁধা কলম। ঠিকঠাক শূন্যঘরগুলো পূরণ করে কাউন্টারে ফিরে ৫০০ টাকাসহ জমা দিই। ভেতরে যিনি দায়িত্ব পালন করছেন তিনি কম্পিউটারে নাম লিপিবদ্ধ করার সময়ে বাইরে রাখা পর্দায় তাকাতে বলেন। তথ্য লিপিবদ্ধ হচ্ছে, বাইরের দিকে ফিরিয়ে রাখা আরেকটি পর্দায় তা দেখা যাচ্ছে। পূরণ হয়ে গেলে জানতে চাইলেন, ‘ভুল নেই তো’? উত্তর হ্যাঁ বোধক হওয়ায় প্রায় সঙ্গে সঙ্গে একটি কার্ড ধরিয়ে দিলেন। বললেন, ‘সচল হয়ে গেছে।’ মুহূর্তেই সচল হয়ে ওঠা কার্ড দিয়েই কয়েকটি স্টেশন পেরিয়ে আসি নির্ধারিত গন্তব্যে। বেরুনোর মুখে মেশিনে কার্ড ধরতেই দেখায় ভ্রমণের জন্য কেটে নেওয়ার পরে টাকার অঙ্ক। নির্ধারিত দামের টিকিটের চেয়ে দশ শতাংশ ছাড়ও মেলে কার্ডের কল্যাণে। তারপরও যে টাকা ভ্রমণবাবদ কাটা গেল, বাসে এলে যেত তার অর্ধেক। কিন্তু সময় লাগত কয়েকশ গুণ বেশি।
৩.
গতিহীন রাজধানীতে মেট্রোরেল নিয়ে এসেছে গতি। নিতান্ত প্রয়োজনের ভ্রমণেই বারবার মনের ভেতরে গুঞ্জরিত হয়েছে, নিয়মিত যাত্রাপথেও যদি থাকত এমন সুবিধা। আশার কথা, আরও কয়েকটি মেট্রোরেলের লাইনের পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। ইতোমধ্যে কাজের উদ্বোধনও হয়েছে। সব মিলিয়ে ২০৩০ সালের মধ্যে পুরো রাজধানীই মেট্রোর আওতায় আনার যে পরিকল্পনা রয়েছে তা বাস্তবায়িত হলে, নিঃসন্দেহে উপকারভোগীর সংখ্যা বাড়বে। তবে এই সংখ্যা কখনও নিচের যাত্রীর চেয়ে বেশি নয়। মেট্রোর নিচে যে সড়ক এই অংশেই যাত্রীর সংখ্যা বেশি। তাই শুধু ওপরের যাত্রী নয়, নিচের যাত্রীদের সুযোগ-সুবিধার কথাও ভাবার সময় এসেছে। একদিকে দুরন্ত গতি অন্যদিকে গতিহীনতার মহড়ার মধ্যে যে বৈষম্য এবং বৈসাদৃশ্য তাও কিন্তু একটি নগর কিংবা শহরকে আধুনিক হয়ে ওঠার পথে বাধা।
৪.
লেখাটি শেষ করার আগে গত বছর ডিসেম্বরে সীমিত পরিসরে মেট্রোরেলের যাত্রা শুরুর প্রাক্কালে বলা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি আহ্বানের কথা মনে পড়ছে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মেট্রো তৈরিতে প্রচুর খরচের কথা মনে করিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেদিন সকলের কাছে আহ্বান জানিয়ে বলেছিলেন, ‘অনেক টাকা খরচ করে মেট্রোরেল করা হয়েছে। এই মেট্রোরেলকে সংরক্ষণ করা সকলের দায়িত্ব। যাতে মেট্রোরেলের কোনো কিছু নষ্ট না হয়, সেজন্য আমাদের সবাইকে যত্নশীল হতে হবে।’ তার ওই আহ্বানই নতুন করে মনে আসছে চলমান রাজনৈতিক সংকটে। নভেম্বরের শুরুতেই প্রথম দফা অবরোধের সময়ে, মিরপুরে তাণ্ডব-গাড়ি ভাঙাসহ আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটে। সেই সঙ্গে রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে রাজনৈতিক কর্মীদের গাড়ি ভাঙা-আগুন দেওয়ার ঘটনাও ঘটে। জিঘাংসায়, প্রতিহিংসায় আমরা কেন যেন ভুলে যাই, ব্যক্তিগত গাড়িও বৃহদার্থে রাষ্ট্রীয় সম্পদ। ব্যক্তিগত এবং রাষ্ট্রীয় কোনো সম্পদই তো রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ও সংঘাতের শিকার হওয়ার কথা নয়। দেশের সম্পদ, আমাদেরই সম্পদ। তা যত্ন ও রক্ষার দায়িত্বও সবার। তা কোনো নির্ধারিত রাজনৈতিক দলের নয়। আমাদের রাজনৈতিক বিবাদ দেশপ্রেমে ঘাটতি না আনুক। দেশ যেন সবসময়ই থাকে সবকিছুর ঊর্ধ্বে।