রাজনীতি ও নির্বাচন
ড. মোসলেহউদ্দিন আহমেদ
প্রকাশ : ০৫ নভেম্বর ২০২৩ ১০:১৮ এএম
ড. মোসলেহউদ্দিন আহমেদ
কদিন আগে এ স্তম্ভেই বিএনপির ২৮ অক্টোবরের মহাসমাবেশ নিয়ে লিখেছিলাম,
সমাবেশ করার জন্য ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সদিচ্ছা জরুরি। এও লিখেছিলাম, যদি
বিএনপি এ সমাবেশ সফল করার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সদিচ্ছার পরিচয় দিয়ে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির
নজির স্থাপন করতে পারে তাহলে তা গণতন্ত্রের শোভা বাড়াবে। আরও লিখেছিলাম, বিএনপি যদি
অহিংস অর্থাৎ শান্তিপূর্ণভাবে রাজনৈতিক দাবি আদায়ের আন্দোলন করে তাহলে জনসমর্থন আদায়
করতেও সক্ষম হবে। কিন্তু ২৮ অক্টোবর প্রত্যাশিত কিছুই ঘটেনি। রাজনৈতিক অঙ্গন আগেই উত্তাপ
ছড়াচ্ছিল। এবার তা দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। সারা দেশেই থমথমে পরিবেশ। ৩১
অক্টোবর থেকে বিএনপি তিন দিনের অবরোধ কর্মসূচি পালন করে। প্রথম দিনই ব্যাপক সহিংস ঘটনা
ঘটেছে, বাকি দুদিনও তা-ই। হতাহতের মর্মন্তুদ ঘটনাও ঘটেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী
রাস্তায় অবস্থান নিয়েছে এবং আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনা সংবাদমাধ্যমেই মিলছে।
যাত্রীবাহী বাসে আগুন দেওয়া হচ্ছে। আজ ৫ অক্টোবর থেকে বিএনপি ফের দুদিনের অবরোধ কর্মসূচি
দিয়েছে। গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক পরিবেশ এবং দেশের ভাবমূর্তির জন্য এসব কোনোভাবেই সুখকর
নয়। বরং রাজনৈতিক সহিংসতা দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে আমাদের জন্য বহুমুখী সংকট
তৈরি করবে। বিষয়টি রাজনীতিকদের বোঝা জরুরি। বিদ্যমান সংকট তা সদিচ্ছার মাধ্যমে সহজেই
সমাধান করা যায়। সহিংসতা, জ্বালাও-পোড়াওয়ের আন্দোলনের মাধ্যমে সংকট সমাধানের পথ মিলবে
না। বরং তা আরও ঘনীভূত হবে। বিদ্যমান রাজনৈতিক সংকটের চাপ ভোগ করতে হবে সাধারণ মানুষকে।
গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে সহিংসতার কোনো অবকাশ নেই। অহিংস নীতিই গণতন্ত্রের
সংজ্ঞাসূত্র। আন্দোলন-প্রতিবাদ-অধিকার আদায়ের দাবি সবই হতে হবে অহিংস পথে।
৪ অক্টোবর ইসি সংলাপ ডেকেছিল। ওই সংলাপে আওয়ামী লীগসহ ১৩টি দল
অংশ নেয়। আমরাও শান্তি-স্বস্তির লক্ষ্যে সংলাপের ব্যাপারেই জোর দিই। সংলাপ ভিন্ন সংকট
নিরসনের পথ রুদ্ধ বলেই মনে করি। ২৮ অক্টোবর বিএনপি বাদেও আওয়ামী লীগ শান্তি সমাবেশ
করেছে। তা ছাড়া জামায়াতে ইসলামী এবং আরও কয়েকটি রাজনৈতিক দলও সমাবেশ করেছে। একই দিনে
কয়েকটি দলের সমাবেশ ঘিরে আগে থেকেই শঙ্কা ছিল। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও এ ব্যাপারে
তৎপরতা দেখিয়েছে। কিন্তু বারবার সতর্ক করার পরও আশঙ্কা সত্য প্রমাণিত হয়েছে। ফের সহিংস
হয়ে উঠলো রাজনীতি। বিভিন্ন মহল থেকে বিদ্যমান রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা নিরসনে রাজনৈতিক
দলকে উদ্যোগ নেওয়ার তাগাদা দেওয়া হচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে, তা কীভাবে সম্ভব। ২৮ অক্টোবর
বিএনপিকে এলাকা নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছিল। বিএনপি বরাবরই শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির কথা
বলে এসেছে। সঙ্গত কারণেই আমাদের প্রত্যাশা ছিল তারা নিজ প্রত্যয়ের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ
রাখবে। দলটির নেতাকর্মীদের উচিত ছিল নির্ধারিত এলাকার মধ্যে কেউ যেন সুযোগ নিয়ে সহিংসতা
চালাতে না পারে সেদিকে নজর রাখা। আমরা জানি, যেকোনো বড় রাজনৈতিক কর্মসূচিতে তৃতীয় একটি
পক্ষ সুযোগ সন্ধান করে। তাদের উস্কানিতে অনেক সময় পরিস্থিতি নেতিবাচক দিকে ঝুঁকে পড়ে।
এ বিষয়টি বিএনপির অনেক নেতাকর্মীও অনুধাবন করেছিলেন এবং বিভিন্ন সময়ের দলটির নেতাকর্মীদের
বক্তব্যও তাই প্রমাণ করে। তাই ২৮ অক্টোবর যে অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় এর দায়
বিএনপির ওপর বর্তায় অবশ্যই। ব্যবস্থাপনাগত দিকটিতে তাদের আরও মনোযোগী হওয়া উচিত ছিল।
আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি অনেকটা ‘এক হাতে তালি বাজে না’ প্রবাদের
মতো। এখানে বিভাজন এতটা গভীর হয়ে উঠেছে যে, কোনো রাজনৈতিক ঘটনার পর পাল্টাপাল্টি বক্তব্য
বা দোষারোপ করাই স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়াচ্ছে। বিশেষত সহিংস বা উত্তপ্ত পরিবেশ সৃষ্টি হলে
তা-ই অবলম্বন করারও একটি প্রক্রিয়া রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে রয়েছে। মহাসমাবেশ করার জন্য
বিএনপির প্রস্তুতি এবং পরিকল্পনাও সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়েছে, এমন একটি বার্তা দলটি
থেকে পাওয়ায় আমাদেরও প্রত্যাশা ছিল তারা তা রক্ষা করবে। দলটি জানিয়েছিল প্রায় ১ লাখ
২৫ হাজার মানুষের জমায়েত হবে। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছিলেন,
তারা হেফাজতের মতো এক জায়গায় অবস্থান করবেন না। কাকরাইল মসজিদ পর্যন্ত তারা মহাসমাবেশের
পরিধি অনুমান করে রেখেছিলেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর উচিত ছিল। মহাসমাবেশের
আনুমানিক এলাকা পর্যন্ত ব্যারিকেড বসানো উচিত ছিল। যেহেতু কাছাকাছি পরিসীমায় আওয়ামী
লীগের কর্মসূচি চলছিল তাই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির দিকে বাড়তি নজর রাখা অতি আবশ্যক ছিল।
রাজনৈতিক পরিস্থিতি যেকোনো সময় পাল্টে যেতে পারে। আর এ পাল্টে যাওয়া প্রেক্ষাপট জননিরাপত্তা
কিংবা শান্তিপূর্ণ পরিবেশ যেন বিঘ্নিত না করে সেদিকে মনোযোগ রাখা দরকার। এ দায়িত্ব
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকেই পালন করতে হবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ২৮ অক্টোবরের
আগে থেকেই তৎপরতা দেখালেও ওইদিন দায়িত্ব পালনে তাদের কিছুটা ঘাটতি ছিল বলে মনে করি।
একাধিক রাজনৈতিক দলের কর্মসূচি চলাকালে নির্দিষ্ট এলাকায় নিরাপত্তা
জোরদার করার বিকল্প নেই। আগেই বলেছি, এমন সময়ে তৃতীয় একটি পক্ষ পরিস্থিতি ভিন্নপথে
চালিত করার সুযোগ খুঁজে থাকে। আর পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠলে এই উস্কানিদাতাদের খুঁজে
পাওয়া কঠিন হয়ে যায়। ২৮ অক্টোবর সমাবেশ এলাকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে যেমন
ঘাটতি ছিল তেমনই ঘাটতি ছিল নজরদারিতে। তা ছাড়া কিছু বিষয়ে স্পষ্ট ধারণাও আমাদের কাছে
ছিল না। যেমন জামায়াতে ইসলামীকে সমাবেশ করতে দেওয়া হবে না বলা হয়েছিল। কিন্তু তারা
সমাবেশ করেছে। এমন অস্পষ্টতা এবং তারপর অনুমতি দেওয়ার বিষয়টি জনমনে ভিন্ন বার্তা পৌঁছে
দিতে পারে। ২৮ অক্টোবরের ঘটনা খতিয়ে দেখলে আমরা এমন অনেক প্রশ্নই দাঁড় করাতে পারি।
তবে যা হওয়ার তা হয়ে গেছে। রাজনীতিকরা অস্থিতিশীল পরিস্থিতি উত্তরণের পথ খোঁজার চেষ্টা
করলেই বরং বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দেব। ২৮ অক্টোবর বিএনপির অনেক কর্মীর হাতেই লাঠিসোটা
ও অস্ত্র দেখা গেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উচিত ছিল আগেই এদের বিরুদ্ধে আইনি
ব্যবস্থা নেওয়া। আরেকটি বিষয় আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করে, সমাবেশে কেউ কেউ পুলিশের পোশাক
পড়ে এসেছিল। বিষয়টি জননিরাপত্তার জন্য ভয়াবহ বার্তা দেয়। পুলিশের প্রতি মানুষের মনে
এক ধরনের সন্দেহও পুঁতে দেওয়া হয়।
এবার আসা যাক শান্তিপূর্ণ পরিবেশের প্রসঙ্গে। এর আগের লেখায়
ভেনেজুয়েলার উদাহরণ টেনে বলেছিলাম কীভাবে তারা অভ্যন্তরীণ রাজনীতির সংকট নিরসন করে
সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করে। সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের মাধ্যমে তারা বিদেশি নিষেধাজ্ঞাও
এড়াতে পেরেছে। ভেনেজুয়েলার রাজনৈতিক পরিস্থিতির সঙ্গে আমাদের রাজনৈতিক পরিস্থিতির বেশ
সাদৃশ্য রয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সদিচ্ছা থাকলে সহজেই সংকট নিরসন করা সম্ভব।
কিন্তু যদি সহিংস পরিবেশ বিরাজ করে তাহলে আলোচনার প্রেক্ষাপট তৈরি হবে না। এ মুহূর্তে
রাজনৈতিক দলের স্বার্থকে প্রাধান্য দিলে চলবে না। দেশ-জাতির স্বার্থকে রাখতে হবে অগ্রভাগে।
আমাদের উন্নয়ন হয়েছে। কিন্তু বৈশ্বিক সংকটের পাশাপাশি আমাদের একাধিক সংকটও দেখা দিয়েছে।
এ সংকট তখনই সমাধান করা যাবে যখন অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল থাকবে। আমাদের
অর্থনীতির সম্ভাবনা পরিপূর্ণ করতে হলে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করা জরুরি। ২০২৬ সাল নাগাদ
আমরা উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের কাতারে দাঁড়াব। কিন্তু বিদ্যমান পরিস্থিতি ভিন্ন বার্তা দিচ্ছে।
আমাদের জাতীয় নির্বাচন ও রাজনীতি নিয়ে বিদেশিদের আগ্রহ রয়েছে। তা ছাড়া আমাদের ভূরাজনৈতিক
গুরুত্বও বাড়ছে। ভুলে গেলে চলবে না, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির বড় অস্ত্র
নিষেধাজ্ঞা। আমাদের অর্থনীতির স্বার্থে নিষেধাজ্ঞা এ মুহূর্তে কাম্য নয়।
এমন নয় যে, রাজনীতিকরা এ বিষয়গুলো বোঝেন না। সমস্যা হলো, তারা এখনও দলীয় স্বার্থকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন। এই সংকীর্ণ গণ্ডি থেকে বের হয়ে আসা জরুরি। জনপ্রতিনিধিদের কাছে দেশের মানুষের সঙ্গতই কিছু প্রত্যাশা থাকে। কিন্তু তারাই যদি ভুলপথে চালিত হন তাহলে চলমান সংকট আরও প্রকট হতে বাধ্য। বিদ্যমান সংঘাতময় পরিস্থিতির নিরসন করে জনমনে স্বস্তি আনার দায় রাজনীতিকদের, এ কথা ভুলে গেলে চলবে না। জনগণকে জিম্মি করে নয়, বরং আস্থায় আনাই গণতন্ত্রের সংজ্ঞাসূত্র। সহিংসতার পথ সবাইকে পরিহার করতেই হবে। অহিংস ও জনবৈরি নয় এমন আন্দোলনে গণতন্ত্র সায় দেয়। প্রশ্নমুক্ত নির্বাচন ব্যবস্থা নিশ্চিত হওয়াও জরুরি।