পরিপার্শ্ব
ডা. লিপি বিশ্বাস
প্রকাশ : ০৫ নভেম্বর ২০২৩ ১০:১৫ এএম
বাংলাদেশ থেকে ভারতে সচরাচর যে ট্যুর প্যাকেজগুলো প্রচলিত এবং জনপ্রিয় সেগুলো মোটামুটি গতানুগতিক। কলকাতা, দার্জিলিং-সিকিম, মেঘালয়-আসাম, দিল্লি-আগ্রা-জয়পুর-আজমির, কাশ্মির-লাদাখ এসব স্পট ঘোরাঘুরির জন্য আর চিকিৎসাসংক্রান্ত বিষয়ে দক্ষিণ ভারতে গেলে তামিলনাড়ু-কর্ণাটক-তেলেঙ্গানা-কেরালার কিছু স্পট দেখার সুযোগ হয়। আমাদের দেশের মানুষের ভারত ভ্রমণ অনেকটাই এসব জায়গায়। পশ্চিম ভারতে একটা ট্যুর করে আসা, তাও কোনো এজেন্সির সাহায্য ছাড়া নিজেরা সবকিছুর ব্যবস্থা করে; সেটা আক্ষরিক অর্থেই আমাদের জন্য ‘চ্যালেঞ্জ’ ছিল। তাও মুম্বাই পর্যন্ত হয়তো ব্যবসা/চিকিৎসা/ওয়ার্কশপ নানা কারণে অনেকেই যান, কিছু তথ্য এদিক-সেদিকে পেয়েও গেলাম, কিন্তু অরঙ্গাবাদ শহরে এর আগে আমাদের পরিচিত কেউই যাননি।
সারা রাত মুম্বাই থেকে অরঙ্গাবাদ পর্যন্ত এক অভিনব ‘স্লিপার’ বাসের
খোলের ভেতর এদিক-সেদিক দোল খেয়ে কোনো একদিন ‘সুপ্রভাত’-এ আমরা অরঙ্গাবাদের মাটি স্পর্শ
করলাম। ছিমছাম, বাহুল্যবর্জিত শহরটাকে প্রথম দেখাতেই ভালো লেগে গেল, বিশেষ করে মুম্বাইয়ের
ভিড়ভাট্টার মধ্য থেকে অরঙ্গাবাদ এসে খুব শান্তি লাগছিল। কিন্তু শহরটা সতেজ-সুন্দর-শান্তিময়
হলেও একে বড় শহরের তকমা দেওয়া যায় না কিছুতেই। আর অরঙ্গাবাদে বিদেশি নাগরিকের থাকার
মতো হোটেলের সংখ্যাও অপ্রতুল। কিন্তু আমাদের ভ্রমণভাগ্য বরাবরই খুব ভালো, এটুকুই ছিল
ভরসা। রাস্তায় নেমে আমরা যখন দ্বিধাগ্রস্ত চিত্তে এদিক-সেদিক তাকাই তখনই কীভাবে যেন
সঠিক সময়ে সঠিক মানুষটির সঙ্গে দেখা হয়ে যায়! যেমন কাশ্মির ট্যুরে দেখা হয়েছিল হানিফ
ভাইয়ের সঙ্গে, অরঙ্গাবাদে পেয়ে গেলাম রইছ ভাইকে! তিনিই বিদেশিদের থাকার পারমিশন আছে
এমন হোটেলের সন্ধান দিলেন। তার গাড়িতেই বাকি দুই দিন অরঙ্গাবাদ চষে বেড়ালাম। ভারতের
রাজনীতি-অর্থনীতি-কূটনীতি সম্পর্কে ব্যাপক দ্বিপক্ষীয় আলোচনা হলো। সবচেয়ে বড় কথা, অজন্তা-ইলোরা
দেখার অন্যতম সেরা স্বপ্ন পূরণেও তিনি উজ্জ্বল সাক্ষী হয়ে রইলেন। সারা রাত সড়কপথে নৌকার
মতো দুলুনি খেয়ে কোনোরকম হোটেলে চেক-ইন করে স্নান সেরে ছুট দিলাম শখানেক কিলোমিটার
দূরের অজন্তার উদ্দেশে। নিজের মনেই প্রশ্ন জাগে, আমাদের দেহযন্ত্র কোন জ্বালানিতে চলে!
কতদিনের লালিত স্বপ্ন। ২০১৮ সালের কোনো একসময় অজন্তা-ইলোরা যাওয়ার স্বপ্ন দেখা শুরু করি। সেই থেকে কত কত ভিডিও/ছবি দেখছি ও লেখা যে পড়েছি তার শেষ নেই। তবু যখন সত্যি সত্যি অজন্তা-ইলোরা দেখতে পেলাম তখন নিজের চোখকেই যেন বিশ্বাস হচ্ছিল না। সেই গল্প না হয় আরেক দিন হবে। তবে পড়াশোনা করে গেলে যা সবচেয়ে বেশি সুবিধা হয়, তা হলো ভ্রমণ স্পটের অনেক তথ্য জানা থাকে এবং ভ্রমণ হয় স্বচ্ছন্দ। তাই তো যখন বললাম আমাদের ভিউ পয়েন্টে আগে নিতে হবে এবং সেখান থেকে হেঁটে আমরা অজন্তার গেটে যাব, রইছ ভাই আর হোটেল মালিক পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করছিলেন। ফেরার পথে বলেই ফেললেন, ‘আপ লোগ্ বহুত হোমওয়ার্ক কারকে আয়ে।’ কারণ, বেশিরভাগ ট্যুরিস্ট এ ভিউ পয়েন্টের বিষয়ে নাকি জানেনই না। বিশেষ করে বাংলাদেশ থেকে যাওয়া নিতান্ত সাদামাটা শাড়ি-পাঞ্জাবি পরা রইছ ভাইয়ের গাড়ির প্রথম বাংলাদেশি সওয়ারি এত কিছু জানবে এটা হয়তো তার কল্পনায়ই আসেনি। মনে মনে হাসলাম আর ভাবলাম, আসলেই ‘আগে দর্শনদারি পরে গুণবিচারি’ কথাটা নিখাদ সত্য। ভ্রমণ শুধু মানসিক স্বাস্থ্যের জন্যই দরকারি টনিক নয়, জানার পরিসর বৃদ্ধির খোরাকও জোগায়।