× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

স্মরণ

যে রশ্মি ছড়াচ্ছেন লালন

শহিদুল ইসলাম

প্রকাশ : ১৭ অক্টোবর ২০২৩ ০৮:১৫ এএম

যে রশ্মি ছড়াচ্ছেন লালন

মানুষের মন মুহূর্তে পৃথিবী ঘুরে আসতে পারে মন সীমানাহীন গতিতে আলোর গতিকেও হার মানায় দেহ নশ্বর, মৃত্যুর পর দুই তিন প্রজন্মের মধ্যেই দেহের কথা মানুষ ভুলে যায় কিন্তু মনের সৃষ্টি, যদি তা মানুষের জন্য কল্যাণকর হয়, তার মৃত্যু নেই আজ এমন একজন মানুষকে সামনে রেখে লিখতে বসেছি, যিনি একশ তেইশ বছর আগে পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে চলে গেছেন তবুও সেই অশিক্ষিত, গ্রাম্য ফকির নিয়নের রশ্মি ছড়িয়ে আজও নিজের আলোয় উদ্ভাসিত তিনি আজও জীবন্ত কেবল বাঙালি জাতির কাছেই নয়, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের লন্ডন বক্তৃতার মাধ্যমে তিনি বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়েন ১৭৭৪ ১৮৯০-এর একই দিন, ১৭ অক্টোবরে তাঁর জন্ম মৃত্যু দিন ১১৬ বছর তিনি বেঁচেছিলেন মারাও গেছেন ১৩৩ বছর আগে মৃত্যুর ছোঁয়া তিনি পেয়েছিলেন শৈশবেই ভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষের বাড়িতে বড় হয়েছেন দুঃখ-কষ্ট তাঁর জীবনে ছিল নিত্যকার সঙ্গী তাঁর শরীর মনোজগতে ছিল না কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার স্পর্শ তাঁর দেহ বহু আগে মাটির সঙ্গে মিশে গেছে কিন্তু তাঁর সৃজনশীল মনের উপজাত মানবপ্রেমী দর্শন আজও আমাদের পথ প্রদর্শক হিসেবে উপস্থিত তিনি আর কেউ নন

সকল ধর্ম সমন্বয়ে গঠিত, সকল প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাঙ্গন থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারীর চেয়েও শিক্ষিত কবি, গায়ক, গীতিকার সুরকার লালন শাহ্ মৃত্যুর এত বছর পরও তিনি বেঁচে আছেন তাঁর গানের মাঝে তাঁর লেখা গানের কোনো পাণ্ডুলিপি ছিল না, কিন্তু গ্রাম-বাংলায় আধ্যাত্মিক ভাবধারায় লোকের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে তাঁর রচিত গান সকল ধর্মের গণ্ডিবদ্ধ সীমানার ঊর্ধ্বে উঠে তিনি বিশ্ব মানবতাবাদের জয়গান গেয়ে গেছেন সেই অশিক্ষিত ফকিরের ওপর গবেষণা করে আমরা পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করছি তাঁরই রচিত সুরারোপিত গান গেয়ে আমরা আসর মাত করছি জাতপাতের ঊর্ধ্বে উঠে তিনি গিয়েছিলেন, ‘সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে/ লালন কয় জাতের কি রূপ দেখলাম না এই নজরে

আজ লালনের জন্ম-মৃত্যু দিন তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন তো বটেই, সেই সঙ্গে লালন-প্রতিভার আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে একটু যাচাই করে দেখার এক প্রবল ইচ্ছার জন্যই আজকের এই সামান্য প্রচেষ্টা বৈষ্ণব সহজিয়া, বৌদ্ধ সহজিয়া সুফিবাদের সংমিশ্রণে মানবগুরুর ভজনা, দেহকেন্দ্রিক সাধনাই লালন প্রদর্শিত বাউল ধর্মের মূলমন্ত্র লালনের দর্শন ছিল, ‘যা আছে ভাণ্ডে, তা- আছে ব্রহ্মাণ্ডে লালন ফকির বিশ্বাস করতেনÑ সব মানুষের মধ্যেই বাস করে এক মনের মানুষ আর সেই মনের মানুষের সন্ধান পাওয়া যায় আত্মসাধনার মাধ্যমে দেহের ভেতরেই সেই মনের মানুষ বা যাকে তিনি অচিন পাখিবলেছেন, তার বাস

আজকের এই প্রযুক্তিনির্ভর পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে কি লালনের প্রতি সুবিচার করা সম্ভব? কীভাবে তিনি নিজেকে গড়ে তোলেনÑ যখন আজকের দৈনন্দিন প্রযুক্তির অনায়াসলব্ধ সম্ভারের ছিটেফোঁটার অস্তিত্বও ছিল না? আমরা আজ ভাবছিÑ তিনি কী করে বিশাল জ্ঞানভাণ্ডারের অধিকারী হলেন? কীভাবে দুহাজারের ওপর গান রচনা করেছিলেন? সেসব গানে সুরারোপ করার যোগ্যতাই বা তিনি কোথা থেকে আহরণ করলেন? কী দিয়ে লিখেছিলেন? কাগজ-কলম কালি কোথায় পেলেন? সর্বোপরি কোথায় পেলেন সেই জীবন দর্শনÑ যার প্রশংসায় রবীন্দ্রনাথ তাঁকে ইংরেজ কবি শেলী কিটসের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন?

এসব প্রশ্নের সম্মুখীন হলেই আমাদের বুদ্ধিভ্রম হয়; কথা হারিয়ে ফেলি স্বপ্নেও ভাবতে পারি না আমাদের চারপাশে যেসব প্রযুক্তি ছড়িয়ে আছে, যাদের ছাড়া আমাদের এক মুহূর্ত চলে না, সেসব ছাড়া লালন এবং সময় লালনের মতো মানুষেরা কী করে জীবনযাপন করতেন কেবল জীবনযাপনই নয়, এমন সৃজনশীল কর্মকাণ্ডের রসদ তিনি বা তাঁরা কোথায় পেলেন? প্রযুক্তি প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে না প্রযুক্তি আমাদের প্রয়োজনীয়-অপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের সুনামি এনেছে আমাদের পায়ের গতি বৃদ্ধি করেছে শতগুণ হাতের প্রসার ঘটিয়েছে দূর-দূরান্তে আমরা ছুটছি আর ছুটছি যদি জিজ্ঞেস করিকোথায়উত্তর খুঁজে পাই না উদ্দেশ্যবিহীন আমাদের ছোটা অর্থহীন হলেও ছোটার কোনো বিরতি নেই রবীন্দ্রনাথেরসোনার হরিণ চাইগানটির গভীরতা বোঝার ক্ষমতা আমরা হারিয়ে ফেলেছি তোরা পাবার জিনিস হাটে কিনিস, রাখিস ঘরে ভরে.../যারে যায় না পাওয়া তারি হাওয়া লাগল কেন মোরে

বাবা কাশেম ডাকাতদলের সম্পদ দেখে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল প্রযুক্তির সম্পদ আমাদের মধ্যে তেমনিই উন্মাদনার সৃষ্টি করেছে আমরা ক্রমশ কাশেমের ভাগ্য বরণ করতে চলেছি এই প্রেক্ষাপটেই আরও একটি বিষয়ের উল্লেখ করতে চাই পুঁজিবাদ আধুনিক বিজ্ঞান-প্রযুক্তির আবির্ভাব সমসাময়িক উভয়েই সামন্ততান্ত্রিক শোষণ থেকে মানুষের মুক্তি এবং নতুন এক গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখিয়েছিল মানুষ বড় আশায় বুক বেঁধেছিল কিন্তু উন্নয়নের এক পর্যায়ে পুঁজিবাদ তার প্রগতিশীল ভূমিকা হারিয়ে ফেলে নতুন পুঁজিবাদের গর্ভ থেকে জন্ম নেওয়া বুর্জোয়া শ্রেণি পৃথিবী দখল করে সেই সঙ্গে বিজ্ঞান প্রযুক্তি তাদের দখলে চলে যায় এবং বিজ্ঞান-প্রযুক্তি তার স্বাধীনতা হারায় বিজ্ঞান-প্রযুক্তি শাসক শ্রেণির হাতকেই শক্তিশালী করেছে তার সাহায্যে শাসক শ্রেণি মানুষের কথা বলার স্বাধীনতা হরণ করেছে ফলে একজন লালনের জন্ম আরও অসম্ভব করে তুলেছে লালনের মতো সাধারণ মানুষ যদি কথা, লেখার, এককথায় মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হারায়, তাহলে একজন শিল্পীর জন্ম হবে কীভাবে?

আমরা লালনের মতো পাখা মেলার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছি তাই ১৮ কোটি বাঙালির দেশ থেকে আজ আর একজন লালনের সৃষ্টি হলো না শিক্ষিত, আধুনিক মানুষ আমরা, লালনের ধর্ম কী? তা নিয়ে গবেষণা করতে পারি, কিন্তু লালনের মতো ধর্ম-বর্ণের ঊর্ধ্বে উঠে একজন লালন হতে পারি না লালন মহামানব এই মহামানব হয়ে ওঠার পেছনে আধুনিক প্রযুক্তির কোনো অবদান নেইÑ আমরা যাকে এত মূল্যবান মনে করি বরং যা ছিল তা ছিনিয়ে নিয়েছে প্রযুক্তি তা আমরা আর কখনও ফিরে পাব না বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করি অমর লালনকে

 

  •  অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপকরাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা