× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

পরিবেশ-প্রতিবেশ

তালগাছের নিরাপত্তাহীনতা

পাভেল পার্থ

প্রকাশ : ১১ অক্টোবর ২০২৩ ১১:১৫ এএম

তালগাছের নিরাপত্তাহীনতা

দীর্ঘ উচ্চতার গাছ কমছে দেশে। বৈলাম, গর্জন, তেলশুর, সুন্দরী, চাপালিশ, গগনশিরীষ, চাউসুপারির মতো দীর্ঘ উচ্চতার বৃক্ষেরা হরদম খুন হয়েছে। এমনকি তাল, সুপারি, নারকেলের মতো দীর্ঘ উচ্চতার গাছেরাও ঝুঁকিতে। নারকেল ও সুপারি থেকে আয় ভালো হয় বলে এসব হয়তো টিকে আছে। কিন্তু তালগাছ থেকে আয়ের খাতগুলো নানাভাবে কমছে। এ কারণে গ্রাম বাংলায় উন্নয়নের নিদারুণ কোপ সবচেয়ে বেশি পড়েছে তালগাছের ওপর। ক্রমে তালবৃক্ষশূন্য হতে থাকা একটি অশনিসংকেত। তালনির্ভর জীবন থেকে আমরা ক্রমাগত বিচ্ছিন্ন হচ্ছি। পাশাপাশি এটি প্রাকৃতিক বিশৃঙ্খলাকেও নিশানা করে। কেমন বিশৃঙ্খলা? তালগাছের ডগা থেকে গোড়া সবকিছু আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িত। তালের পাতা হাতপাখা, ঘরের ছাউনি, মাদুর কিংবা কৃষকের মাথাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তালের আঁশ দিয়ে অনেক কিছু বোনা যায়। তালের ফল, কচি শাঁস কিংবা পাকা ফল আমরা নানাভাবে খাই। তালের ডগা, পুষ্পমঞ্জরী জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার হয়। তালের রস গুরুত্বপূর্ণ খাদ্য উপকরণ এবং এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে গাছি ও গুড় কারিগরের মতো পেশা। তালের কাণ্ড ডোঙা নৌকা, গোড়া ঢেঁকি ও গাইল তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। তালের কাঠ ঘরের খুঁটি। শতবর্ষী বহু গ্রামীণ গৃহস্থঘরের স্থাপত্যে তালের খুঁটি ব্যবহারের নমুনা এখনও মেলে। বাংলাদেশের বেশিরভাগ গ্রামীণ জনপদ সমতল নিম্নাঞ্চলে। গ্রামের উঁচু তালগাছ পরিচিতির সহজ স্মারক। তালের স্মৃতিতে বহু স্থাননাম আছে। তালতলা, তালগাঁও, তালপুকুর, তালন্দ কিংবা তালপুর। আমাদের ছড়া, প্রবাদ, লোককথা, গীতে মিশে আছে তাল।


এ তো গেল সরাসরি মানুষ-তালগাছ সম্পর্কের এক টুকরো ফিরিস্তি। তালের প্রাকৃতিক ও পরিবেশগত অবদান আরও বিস্তর। বিশেষ করে গ্রামীণ বাস্তুতন্ত্রে তাল সবচেয়ে উচ্চতম ‘সবুজ ছাতা’ তৈরি করে। বাবুইসহ বহু পাখি বাসা বানায় তালগাছে। তক্ষক, গিরগিটি, শামুক, সাপ, পতঙ্গ আশ্রয় নেয় তালগাছে। বহু লতানো বীরুৎ, গুল্ম, শৈবাল, ছত্রাক কিংবা লাইকেনের বিস্তার হয় তালবৃক্ষে। তালকাণ্ডে পাখির বিষ্ঠা থেকে জন্ম নেয় বট, অশথ কিংবা ডুমুর। পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রে এত যার অবদান সেই তালবৃক্ষ কেন বাংলাদেশে নিরাপদে নেই? কেন নির্দয় নিষ্ঠুরভাবে তালগাছ হত্যা করা হচ্ছে? তাল-অনুরাগী এ ব-দ্বীপের কিছু মানুষ কেন হঠাৎ এমন তালবিরোধী হয়ে উঠলেন?

তালের প্রতি এই চরম নিষ্ঠুরতাও কিন্তু প্রাণ-প্রতিবেশের অসুস্থতা প্রমাণ করে। হয়তো এখনকার বহুজনের জীবনে তালগাছ আর চিরসখা হয়ে উঠছে না। বিল-জলাভূমি নেই, তালের ডোঙা বানাতে জানা মানুষ কম। জীবাশ্ম জ্বালানিনির্ভর কলের মেশিনের কারণে তালের গাইল-ঢেঁকি উধাও। গৃহনির্মাণ স্থাপত্য ও উপকরণ বদলেছে। তালের মতো প্রকৃতিসহনশীল উপকরণ পায়ে ঠেলে কাচ, বিষাক্ত রঙ আর প্লাস্টিক সামগ্রীর মাধ্যমে অবকাঠামো বানিয়ে আমরা অভ্যন্তরীণ তাপ বাড়াচ্ছি। তালগাছ কমাতে গাছি ও গুড় প্রস্তুতকারীরা পেশা বদলাতে বাধ্য হয়েছেন। তালগাছের অভাবে বাবুইপাখির প্রজনন অভ্যাস বদলে যাচ্ছে। বাধ্য হয়ে ঘাসের ঝোপ বা কলাগাছেও বাসা বানাচ্ছে বাবুই। সরকারি নানা প্রকল্প তালগাছকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে প্রাকৃতিক বজ্রনিরোধক হিসেবে সরকারি বহু প্রকল্প তালবীজ রোপণ করেছে। কিন্তু রাষ্ট্র তালগাছের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা দিতে বারবার ব্যর্থ হচ্ছে। তাহলে তালবীজ বপন করা আর বজ্রনিরোধক হিসেবে তালের প্রচারে লাভ কী? যদি একটি পূর্ণবয়স্ক তালবৃক্ষের নিরাপত্তা নিশ্চিত না হয়। সম্প্রতি জয়পুরহাটের ক্ষেতলাল উপজেলার নিশ্চিন্তা-পাঠানপাড়া সড়কের দুই পাশের প্রায় ৪০টি তালগাছ নির্মমভাবে জখম করেছে পল্লী বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষ। বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক রাখা এবং দুর্ঘটনা থেকে বাঁচার লোকদেখানো অজুহাত তুলে পল্লী বিদ্যুৎ সারা দেশে এই বৃক্ষ খুনখারাবি বহাল রেখেছে। গাছ ও পরিবেশ সুরক্ষায় আমাদের জাতীয় ও বৈশ্বিক আইন, নীতি ও ঘোষণা থাকা সত্ত্বেও আমরা গাছেদের বাঁচাতে পারছি না।

কেবল জয়পুরহাট নয়, তালগাছ নিধন হচ্ছে দেশজুড়েই। তালগাছ কাটার জন্য কেন অপরাধীর দৃষ্টান্তমূলক বিচার হচ্ছে না? কেবল তালবীজ বপন কোনোভাবেই বজ্রপাতের ঝুঁকি কমাবে না, বরং দেশের সর্বত্র টিকে থাকা সব তালগাছের সুরক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাজশাহীর তানোর পৌর এলাকায় তানোর-রাজশাহী সড়ক এবং কালীগঞ্জ হাটের দক্ষিণে পল্লী বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষ তালগাছের মাথা কেটে ফেলে। পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার মহিপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান গ্রামীণ সড়ক উন্নয়নের নামে বনবিভাগের লাগানো ৩০টি তালগাছ কেটে ফেলেন। প্রায় ২০ লাখ টাকা ব্যয়ে ১.৫ কিলোমিটার মাটির রাস্তা সংস্কার করতে গিয়ে ‘জলবায়ুসহিষ্ণু গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের’ অংশে স্থানীয় চেয়ারম্যান খুন করেন প্রাপ্তবয়স্ক তালগাছগুলো। তালগাছ হত্যা করে কোনো সড়ক সংস্কারের কার্যক্রম কীভাবে ‘জলবায়ুসহিষ্ণু প্রকল্প’ হতে পারে তা আমাদের বোধগম্য নয়। মে থেকে আগস্ট মূলত বাবুইপাখির প্রজনন মৌসুম। প্রজনন মৌসুমে পুরুষ ও স্ত্রী বাবুই মিলে বাসা বানায়। দেখা গেছে বেশিরভাগ তালগাছ কাটা পড়ছে বাবুইয়ের প্রজনন মৌসুমের আগে। প্রজনন মৌসুমে বাবুইয়েরা আর বাসা বানানোর গাছ খুঁজে পাচ্ছে না। এভাবে বাবুইয়ের স্বভাব ও প্রজনন অভ্যাসেও পরিবর্তন আসছে। তালের সঙ্গে বাবুইপাখির জীবনও হয়ে উঠছে ঝুঁকিপূর্ণ।

বাংলাদেশের আদিসংস্কৃতি তালমুখী। তালগাছের সুরক্ষায় গ্রামীণ নিম্নবর্গের আছে গুরুত্বপূর্ণ সব সাক্ষ্য। কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার জগন্নাথদীঘি ইউনিয়নের সাতঘরিয়া এমনই এক তালগ্রাম। নওগাঁর নিয়ামতপুর উপজেলার ঘুঘুডাঙা তালতলি দেশের অন্যতম তাল পর্যটন অঞ্চল। ১৯৮৬ সালে ইউপি চেয়ারম্যান থাকা অবস্থায় বর্তমান খাদ্যমন্ত্রী সাধনচন্দ্র মজুমদার এ তালবীজ বপন করিয়েছিলেন। ১৯৯৭ সালে ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলার লংগাইর ইউনিয়নের মাইজবাড়ি-বাবুইহাটি সড়কে তালবীজ বপন করেন রফিকুল ইসলাম। ঠাকুরগাঁও সদরের চিলারং ইউনিয়নের পাহাড়ভাঙা গ্রামের প্রবীণ পল্লীচিকিৎসক খোরশেদ আলী নিজের জমি বিক্রি করে মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের স্মরণে ৫২ হাজার তালবীজ বপন করেছেন, স্বপ্ন ১ লাখ। তবে তালবৃক্ষ রোপণে পৃথিবীতে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন নওগাঁর মহাদেবপুর উপজেলার শিকারপুরের গহের আলী। ভিক্ষা করে গ্রামের সড়কজুড়ে তালের সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিলেন। তালগাছের সুরক্ষায় গহের আলীরাই আমাদের পথপ্রদর্শক। তালের ওপর পল্লী বিদ্যুৎসহ নানা প্রভাবশালী ও কর্তৃপক্ষকে আইন ও বিচারের আওতায় এনে তালের জীবনচক্র সুরক্ষায় রাষ্ট্রকে সক্রিয় হতে হবে। 

  • লেখক ও গবেষক
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা