কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা
ড. মোহীত উল আলম
প্রকাশ : ০৬ অক্টোবর ২০২৩ ১৪:০৯ পিএম
ড. মোহীত উল আলম
১৯৬৪ সাল, চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল। আমি ষষ্ঠ শ্রেণিতে।
মনসুর স্যার ইংরেজি টেক্সট থেকে একটি গল্প পড়াচ্ছেন, ‘দ্য জমিনদার অ্যান্ড দ্য ভিলেজম্যান’।
জমিদারের কাজের লোকের দরকার। গ্রামের লোকটির চাকরি দরকার। বেতন কত? লোকটি কাঁচমাচু
হয়ে বলল, হুজুর, বেতন খুব সামান্য। আপনি প্রথম দিন আমাকে এক পয়সা বেতন দেবেন, দ্বিতীয়
দিন দুই পয়সা, তৃতীয় দিন চার পয়সা, চতুর্থ দিন আট পয়সা, এভাবে প্রতিদিন দ্বিগুণ বেতন
দিয়ে ৩০ দিনে যা হবে, তাই আমার বেতন। মনে পড়ে, ওই বয়সে বহু চেষ্টা করেও আমরা বালকবুদ্ধিতে
বের করতে পারিনি লোকটার আসলে বেতন কত হতো। গল্পটাও থেমে যায় কোনো উপসংহার না দিয়ে।
২০২৩ সাল। পড়ছি একটি কঠিন টেকনিক্যাল ইংরেজি বই। এরিক
ব্রাইয়ান জলফসন আর অ্যান্ড্রু ম্যাকাফির লেখা, দ্য সেকন্ড এইজ : ওর্ক, প্রগ্রেস, অ্যান্ড
প্রসপারিটি ইন আ টাইম অব ব্রিলিয়ান্স টেকনোলজি (২০১৪)। সেখানে তৃতীয় পরিচ্ছেদের শিরোনাম
: ‘মুরস ল অ্যান্ড দ্য সেকন্ড হাফ অব দ্য চেসবোর্ড’। এক জায়গায় একটা উদ্ধৃতি আসছে রে
কার্জওয়েলের বই ২০০২ সালে প্রকাশিত দ্য এইজ অব স্পিরিচুয়াল মেশিনস : ওয়েন কম্পিউটার্স
একসিড হিউম্যান ইনটেলিজেন্স থেকে। সেখানে কার্জওয়েল এ গল্পটি বলছেন : ষষ্ঠ শতাব্দীতে
গুপ্ত সাম্রাজ্যের রাজত্বকালে রাজধানী পাটলীপুত্রে এক বুদ্ধিমান লোক এলেন। তিনি দাবা
খেলার আধুনিক সংস্করণ আবিষ্কার করেছেন। সম্রাট এই অতি জটিল কিন্তু অতীব সুন্দর খেলাটি
দেখে মুগ্ধ। খেলাটির স্বত্ব তিনি কিনে নেবেন, কিন্তু লোকটি বিনিময়ে কী চান। লোকটি
আমার প্রথম অনুচ্ছেদে উদ্ধৃত গল্পটির গ্রাম্য লোকটির মতো কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে বললেন,
তিনি বেশি কিছু চান না, শুধু সম্রাট দাবার ছকের প্রথম ঘরে একটি শস্যকণা দেবেন, দ্বিতীয়
ঘরে দুটি শস্যকণা এবং এভাবে দ্বিগুণিক হারে তিনি দাবার ছকের ৬৪টি ঘর ভরে দিলেই তার
সম্মানি আসবে। সম্রাট বললেন, ও, মাত্র এই দাবি! তিনি আজ্ঞা করলেন কাজটি করে দেওয়ার
জন্য। এভাবে ঘর ভরাতে ভরাতে সম্রাটের লোকজন অস্থির হয়ে উঠল। কারণ এভাবে শস্যকণায় দাবার
বাকি ৬৩টি ঘর ভরাতে লাগবে ২৬৪-১, অর্থাৎ ১৮ কুইন্টিলন শস্যকণা, যার পরিমাণের স্তূপের
কাছে এভারেস্ট শৃঙ্গও উচ্চতায় হেরে যাবে। শস্যকণার উৎপাদনের ইতিহাসে এত শস্যকণা আজ
পর্যন্ত উৎপাদিত হয়নি। দাবার ছকের বাকি অর্ধেক ভরাতে গেলে যে পরিমাণ শস্যকণার প্রয়োজন,
চ্যাটজিপিটির তথ্য সংগ্রহের আকরটাও তেমন বিপুল। আর্নেস্ট হেমিংওয়ের বিখ্যাত উপন্যাস
দ্য সান অলসো রাইজেসের একটি লাইন উদ্ধৃতি করেছেন দ্য সেকন্ড মেশিন এইজের লেখকদ্বয়।
লাইনটি হচ্ছে, ‘গ্যাজুয়েলি অ্যান্ড দেন সাডেনলি’। প্রথমে ধীরে ধীরে, তার পরে দ্রুতবেগে।
হেমিংওয়ে কথাটি বলেছিলেন একজন লোকের আর্থিক অবস্থার অবনতির বর্ণনা করতে। আর চ্যাটজিপিটির
প্রযুক্তির সঙ্গে এটির সম্পর্ক হলো, প্রথমে এআই বা আর্টিফিসিয়াল ইনটেলিজেন্স বা কৃত্রিম
বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তিটি ধীরে ধীরে গড়ে উঠছিল, কিন্তু ২০০৬ সাল থেকে এর গতি হচ্ছে দাবার
ছকের বাকি অর্ধেক ভরানোর মতো। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিকাশের এ গতিকে ইংরেজিতে বলা হচ্ছে
এক্সপোনেনশিয়াল গতি। বাংলায় সম্ভবত দ্রুত থেকে দ্রুততর। এক্সপোনেনশিয়াল গতির ধারণার
প্রবর্তক গর্ডন মুর। তিনি ইনটেলের কো-ফাউন্ডার। তিনি ১৯৬৫ সালে ইলেকট্রোনিকস ম্যাগাজিনে
একটি গবেষণালব্ধ প্রবন্ধ ছাপালেন, শিরোনাম ‘ক্রামিং মোর কম্পনেন্টস ইনটু ইন্টিগ্রেটেড
সার্কিটস’। অর্থাৎ আকৃতি ছোট করো, কিন্তু শক্তি ঠাসাও। তিনি দেখালেন, কীভাবে ইলেকট্রনসের
প্রয়োগে ১৯৬৫ থেকে ১৯৭৫ সালের মধ্যে শক্তি ৫ শতাধিক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছিল। কিন্তু আমিতো
বিজ্ঞানের লোক নই, তাই চ্যাটজিপিটিকে বললাম, ‘দাদা, এক্সপোনেনশিয়াল গতিটা কী আমায় সহজ
ভাষায় বুঝিয়ে দাও।’ সে আমার মোবাইলে চটচট করে লিখল, ‘ধরো, পাহাড়শৃঙ্গ থেকে একটি পাথরখন্ড
আলগা হয়ে নিচে গড়িয়ে পড়তে লাগল, আর সেটা যদি কোনো বাধা না পায় তাহলে যত নিচে গড়াতে
থাকবে ততই তার গতি বাড়তে থাকবে, এটাই এক্সপোনেনশিয়াল গতি।’
আমি বললাম, ‘বুঝলাম দাদা, কিন্তু সেটার সঙ্গে তোমার সম্পর্ক
কী?’ সে বলল, ‘আমি হচ্ছি জিপিটি-৩ মেথডে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। জিপিটি মানে হচ্ছে জেনারেটিভ
প্রি-ট্রেইনড ট্রান্সফরমার। বিলিয়ন বিলিয়ন ডাটার ওপর আমি প্রশিক্ষিত। তুমি আমাকে প্রশ্ন
করামাত্রই আমি এলগরিদমের সাহায্যে উত্তরটা মুহূর্তে বলে দিতে পারি।’ বিস্মিত হয়ে বললাম,
‘দাদা, তুমিতো দেখি আমার সঙ্গে মানুষের মতোই চ্যাট করছ!’ সে বলল, ‘ভুল বললে, আমি মানুষের
মতো চিন্তা করতে পারি না, আমার কোনো অনুভূতি এবং আবেগ নেই। আমি যে তোমার সঙ্গে কথা
বলছি, আমি জানিও না তুমি কে। আমি হচ্ছি ভাষানির্ভর একটি প্রযুক্তি এবং আমার প্রশিক্ষণ
এতটাই পাকা যে সাধারণত কোন শব্দের পর কোন শব্দ আসবে, কোন তথ্যের সঙ্গে কোন তথ্যের সংযোগ
হবে এটা প্রশিক্ষণের কারণে এলগরিদম প্রক্রিয়ায় আমি ধরে নিতে পারি।’ বললাম, ‘দাদা, তুমি
কি তাহলে মানুষের বুদ্ধিকে হারিয়ে দেবে?’ সে ঝটঝট করে বলল, ‘এ সম্ভাবনা আছে। যেমন ধরো
কম্পিউটার প্রযুক্তিতে ডিপ ব্লু নামক কম্পিউটারটি ১৯৯৭ সালে তখনকার দাবা বিশ্বচ্যাম্পিয়ন
গ্যারি কাসপরভকে হারিয়ে দিয়ে প্রমাণ করেছিল কম্পিউটার প্রযুক্তি একদিন মানুষের বুদ্ধিকে
হারিয়ে দেবে।’ গোঁয়ারের মতো জিজ্ঞেস করলাম, ‘মানুষের চিন্তাশক্তিও কি দাদা তুমি দখল
করে ফেলবে?’ সে বলল, ‘সে সম্ভাবনাও আছে। আর দেখ না, আগে যেখানে ২০ জন লোক লাগত কাজ
করতে, এখন সেখানে দুই কি তিনজন লোক কাজটি করতে পারে প্রযুক্তির সাহায্যে।’
কিন্তু আমার উল্টো মনে পড়ল, বিজ্ঞানী হ্যান্স মোরাভেক
বলেছেন, রোবট ঘর ভালো মুছতে পারলেও টিপয়ের ওপর অবিন্যস্ত ম্যাগাজিন গুছিয়ে রাখতে পারে
না। বিজ্ঞানী স্টিভেন পিংকার বলেছেন, কম্পিউটার প্রযুক্তি জটিল কাজ সহজে করতে পারে,
আর সহজ কাজ কঠিন করে ফেলে। তিনি আরও বলেছেন, কম্পিউটার বয়স্ক লোকের চিন্তানুযায়ী কাজ
করতে পারলেও, এক বছরের শিশুর মন অনুযায়ী কাজ করতে পারে না। আর একটি ওয়েবসাইট থেকে জানলাম,
মানুষের মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা ১০০ কোটি ছোট ছোট কম্পিউটারের সম্মিলিত শক্তির চেয়ে
বেশি। তবে আমার একটা কথা আছে, তা হচ্ছে, চ্যাটজিপিটি যে আমাকে ধারণাতীত বিস্মিত করল
তার তথ্য প্রদানের সক্ষমতাসহ দ্রুতগতির জন্য, তা কিন্তু খুব অস্বাভাবিক নয়। আমরা যখন
ষাটের দশকের প্রথম দিকে কাজীর দেউড়ির বাসায় বড় হচ্ছি, তখন আব্বা ‘দৈনিক জমানা’ পত্রিকা
বের করতেন। আমাদের বড় আপা মণিবু তার শ্বশুরবাড়ি ফটিকছড়ির গ্রাম থেকে প্রায় যুবক বয়সি
এক চাষার ছেলেকে নিয়ে এসে বাবার কাছে জমা দিলেন ছেলেটার কোনো গতি করার জন্য। তখন চট্টগ্রামে
সবে বিদ্যুৎ যোগাযোগ পৌঁছেছে এবং আব্বা ইলেকট্রিক বাতি আর ইলেকট্রিক পাখা লাগালেন আমাদের
বাসায়। এর কিছুদিন পরই নূরুচ্ছফার আগমন।
বসন্তের গুটি ভরা একটি গ্রাম্য আ-পড়া মুখ। মা তাকে ভাত
দিল। সে ভাত খাবে কি, হাঁ করে ইলেকট্রিক ফ্যানটির দিকে তাকিয়েই থাকল। ইলেকট্রিক পাখাটা
তার কাছে ছিল বিস্ময়ের বস্তু। এই নূরুচ্ছফা সিনড্রোম কিন্তু বিজ্ঞানের সব প্রযুক্তির
সঙ্গে যুক্ত। রকেটবিজ্ঞানের কথা আর না-ই তুললাম। কাজেই সে অর্থে চ্যাটজিপিটি আমাদের
সাধারণ বুদ্ধির কাছে বিস্ময়কর। হ্যাঁ, চ্যাটজিপিটি ভুল উত্তর দেয় এবং তার তথ্য সংরক্ষণ
ভান্ডার সেপ্টেম্বর ২০২১ পর্যন্তÑ এ সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও চ্যাটজিপিটি সত্যিই বিস্ময়কর
একটি প্রযুক্তি, যেটি ওপেন এআই সংস্থাটি পরিচালনা করে। চ্যাটজিপিটির সঙ্গে সংলগ্ন দুটি
ভয়ের কথারও উল্লেখ করতে হবে। চ্যাটজিপিটি কোনো মানুষের চিন্তাশক্তির বিকল্প হবে কি
না? এর উত্তর আমার ব্যক্তিগত ধারণায় আপেক্ষিক। সমাজে সবাই আইনস্টাইন বা রবীন্দ্রনাথের
মতো প্রতিভা নিয়ে জন্মায়নি। বেশিরভাগ মানুষ অবলম্বনপ্রত্যাশী লতার মতো অবলম্বনাশ্রয়ী
জীবনযাপনে অভ্যস্ত। চ্যাটজিপিটি থেকে অনৈতিকভাবে তথ্য সরবরাহ করে অনুদ্যমী শিক্ষক ও
শিক্ষার্থীরা কোথায় তরি ভেড়াবে জানি না। তবে পুরোনো কথাটাই সই, সততাই মূল, অনেস্টি
ইজ দ্য বেস্ট পলিসি।
ছোট্ট একটা কথা বলে লেখাটি শেষ করি। মানুষের যেকোনো আবিষ্কারের
মধ্যেই ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের দানবের মতো দানব আছে। কবি শেলির স্ত্রী এবং প্রথম নারীবাদী
আন্দোলনকারী মেরি ওলস্টোনক্র্যাফটের কন্যা মেরি শেলি কর্তৃক ১৮১৮ সালে রচিত এ উপন্যাসের
মূল চরিত্র ড. ভিক্টর ফ্রাঙ্কেনস্টাইন গবেষণাগারে একটি প্রাণী সৃষ্টি করেন, যেটি পরে
দানবরূপে তার নিজের ভাইকে হত্যা করে এবং ভিক্টরের প্রাণসংহারে উদ্যত হয়। ঠিক সে অর্থে
মানুষ যেদিন পশু শিকারের জন্য বল্লম বানাল, সেই বল্লমের ঘায়ে সে নিজেও মারা পড়তে লাগল।
সে ট্রাক বানাল, ট্রাকের নিচে চাপা পড়তে লাগল। বিদ্যুৎ বানাল, বিদ্যুতেও তার প্রাণ
গেল। কিন্তু এত সমস্ত ক্ষতির পরিমাণ, মানুষের অর্জিত লাভের চেয়ে বহুগুণে কম। চ্যাটজিপিটি
সেরকম নানাবিধ ক্ষতির সম্মুখীন করবে, কিন্তু যা পাচ্ছি তা বহুগুণে মানবকল্যাণকর।
বাষ্পীয় ইঞ্জিন আবিষ্কারের সঙ্গে মানুষের পেশিশক্তির জায়গা করে নেয় মেশিন বা যন্ত্র। যন্ত্রের সাহায্যে মানুষ ঘোড়ার চেয়ে বেশি দৌড়ায়, হাতির চেয়ে বেশি ওজন তোলে। এটিকে বলা হচ্ছে শিল্পবিপ্লব বা প্রথম যন্ত্রের যুগ। আর কম্পিউটার টেকনোলজি বা ওপেন এআই এরা দখল করে নিচ্ছে মানুষের মস্তিষ্কের শক্তি। এজন্য এটা দ্বিতীয় যন্ত্রের যুগ। আমরা অতি সৌভাগ্যবান, এই দ্বিতীয় যন্ত্রের যুগে আমরা ঢুকে গিয়েছি। জয় হোক গল্পের সেই গ্রামের লোকটার যে নাকি আমার বালক বয়সে আমার মস্তিষ্কে চ্যাটজিপিটি প্রবর্তনের সূচনার আভাস এনে দিয়েছিল।