× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতি প্রয়োগ

রাজনীতিকদের এখন সৃজনশীলতা দেখানোর সময়

এম হুমায়ুন কবির

প্রকাশ : ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১৪:০৮ পিএম

রাজনীতিকদের এখন সৃজনশীলতা দেখানোর সময়

যুক্তরাষ্ট্র ভিসানীতি প্রয়োগ শুরু করেছে। ভিসানীতির বার্তা স্পষ্ট। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন দেখতে চায়। সব রাজনৈতিক অংশীদারের অংশগ্রহণ উৎসাহিত করতেই এই নীতি বাস্তবায়ন করছে। যুক্তরাষ্ট্রের তরফেও বিষয়টি প্রথমেই স্পষ্ট করা হয়েছে। যদিও এর পক্ষে-বিপক্ষে নানা মতামত রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের নীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান উইলসন সেন্টারের দক্ষিণ এশিয়া ইনস্টিটিউটের পরিচালক মাইকেল কুগেন মান সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বলেছেন, মার্কিন ভিসানীতি প্রয়োগ করে বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের লক্ষ্য অর্জন নিয়ে সংশয় রয়েছে। অপরদিকে সরকার ও বিরোধী দলের রাজনীতিকরা দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি দিচ্ছে। বিশেষত আওয়ামী লীগ ও বিএনপি পরস্পরবিরোধী কর্মসূচির দিকেই শুধু হাঁটছে না, একে অন্যের প্রতি তাদের চরম বিষোদগারের বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্রসহ আরও কয়েকটি দেশ বিশেষ পর্যবেক্ষণে রেখেছে। কূটনীতিকরাও তাদের উদ্বেগের কথা জানাচ্ছেন। দেশে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক পরিবেশ স্থিতিশীল না থাকায় এই সংকট বাড়ছে বললে অত্যুক্তি হবে না। কারণ প্রকৃতার্থে আমাদের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা কখনও ছিল না। স্বাধীনতার পর দীর্ঘ বায়ান্ন বছরেও একটি গ্রহণযোগ্য ও সন্তোষজনক নির্বাচনী কাঠামো কিংবা প্রক্রিয়া আমরা এখনও রাষ্ট্রকে উপহার দিতে পারিনি। এই ব্যর্থতার দায় রাজনৈতিক মহলকে নিতে হবে। রাজনীতিতে বিভাজন থাকতে পারে। তবে এই বিভাজনের ফলে গঠনমূলক সমালোচনার জায়গায় বিষোদগারের সংস্কৃতি গড়ে উঠলে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা দুরূহ হয়ে ওঠে। বর্তমান পরিস্থিতিতে সরকার ও বিরোধী পক্ষকে রাজনৈতিক দায়ের বিষয়ে সচেতন হওয়া অধিক জরুরি। ভিসানীতি জনমনে নানা শঙ্কা তৈরি করেছে এবং এর পক্ষে-বিপক্ষে বিষোদগার উদ্বেগ আরও বাড়িয়ে তুলছে।

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কোনো পক্ষই যেন সুষ্ঠু-অবাধ-নিরপেক্ষ নির্বাচনী পরিবেশ বিনষ্ট না করে, এর দায় সম্পর্কে সচেতন হওয়ার বার্তা এই ভিসানীতি। নির্বাচনী পরিবেশ বিনষ্ট করে এমন প্রচেষ্টাকে তারা বিশেষ পর্যবেক্ষণে রাখবে এবং যারা এমনটি করবে তাদের এই ভিসানীতির আওতায় নিয়ে আসা হবে। কাজেই রাজনৈতিক মহলকে এখনই নিজ দায়িত্ব-কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। ইতোমধ্যে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক জটিলতা বাড়ছে। কোন প্রক্রিয়ায় নির্বাচন হবে এই আলোচনাও তুঙ্গে। সরকারি দলের নেতারা বলছেন, সংবিধান মেনে নির্বাচন হবে। অপরদিকে বিরোধী দলের দাবি, সরকারকে পদত্যাগ করে নতুন ব্যবস্থায় নির্বাচন আয়োজন করতে হবে। এই আলোচনা দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরেই হচ্ছে। কিন্তু আমাদের উচিত একটি সর্বজনগ্রাহ্য নির্বাচনীপ্রক্রিয়া ও কাঠামো গড়ার বিষয়ে তৎপর হওয়া। পরবর্তী সময়ে যেন বিতর্ক সৃষ্টি না হয় এই লক্ষ্যে আলোচনা সাপেক্ষে স্থায়ীভাবে নির্বাচনী কাঠামো গড়ে তুলতে হবে। যত দিন পর্যন্ত সর্বজনগ্রাহ্য নির্বাচনী কাঠামো গড়ে তোলা যাবে না তত দিন পর্যন্ত এই বিতর্কের অবসান ঘটবে না এবং সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বিষয়টি আমাদের জন্য সম্মানজনক কিছু নয়।

চলতি বছরের প্রথমদিকে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রধান উপদেষ্টা ডেরেক শোলে বাংলাদেশ সফর করেছিলেন। সফরের সময় তিনি সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন, ‘বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনী পরিবেশ না থাকলে দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্কের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।’ যুক্তরাষ্ট্র বাদেও ইউরোপীয় ইউনিয়ন বা গণতান্ত্রিক বিশ্বের প্রতিনিধিরা বহুবার এমন বক্তব্য দিয়েছেন। অর্থাৎ নিরপেক্ষ এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনী পরিবেশ না থাকলে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন থাকে। গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক পরিবেশ নিয়ে আন্তর্জাতিক মহল যদি এমন প্রশ্ন দাঁড় করায় তাহলে আগামীতে আমাদের বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ উত্তরণের পথটিও কণ্টকাকীর্ণ হয়ে উঠবে। ভবিষ্যতে আমরা উন্নয়নশীল দেশের কাতারভুক্ত হওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছি। এ ছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়নের জিএসপি সুবিধা প্রাপ্তির জন্যও আমরা কূটনৈতিক তৎপরতা অব্যাহত রেখেছি। মার্কিন বাজারে আমাদের আয় বাড়ানোর পাশাপাশি মার্কিন বিনিয়োগ আদায়ের জন্যও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কোন্নয়ন জরুরি। তবে এসব লক্ষ্য উত্তরণের জন্য আন্তর্জাতিক মহলে আমাদের ভাবমূর্তি ইতিবাচক রাখা জরুরি। এই ইতিবাচক ভাবমূর্তি আন্তর্জাতিক মহলের সঙ্গে আমাদের জাতীয় স্বার্থ বিষয়ে দরকষাকষির সুযোগ করে দেয়। সেজন্য সুষ্ঠু নির্বাচনী কাঠামো ও গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক পরিবেশ নিশ্চিত করার বিষয়ে আমাদের মনোযোগী হতে হবে।

ইউরোপীয় ইউনিয়ন আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পূর্ণাঙ্গ পর্যবেক্ষক মিশন পাঠাচ্ছে না। এ ব্যাপারে তারা তাদের আর্থিক সীমাবদ্ধতার পাশাপাশি এ কথাও বলেছে, মার্কিন ভিসানীতি প্রয়োগ করে বাংলাদেশে অবাধ ও সুস্থ নির্বাচনের লক্ষ্য অর্জন নিয়ে সংশয় আছে। তবে সরকারের কয়েকজন মন্ত্রী বলেছেন, নির্বাচন পর্যবেক্ষণে কে এলো না এলো সেটি তাদের দেখার বিষয় নয়। সব ছাপিয়ে আমাদের নির্বাচনী কাঠামোর ওপর আন্তর্জাতিক মহলের অনাস্থার বিষয়টিই উঠে আসে। এ ক্ষেত্রে দুটো বিষয় দেখা যাচ্ছে। প্রথমত আন্তর্জাতিক মহলের বক্তব্যের ক্ষেত্রে সরকারের নেতৃত্বস্থানীয় ব্যক্তিদের নিজস্ব ব্যখ্যা-বিশ্লেষণ রয়েছে। দ্বিতীয়ত আন্তর্জাতিক পরিসরে বাংলাদেশের নীতিগত অবস্থান তুলে ধরার প্রচেষ্টা। আমরা এখন মাল্টিপোলার বিশ্বে অবস্থান করছি। ভূরাজনীতিতে বৈচিত্র্যতা থাকায় বিশ্বের সব দেশের সঙ্গেই আমাদের পারস্পরিক সম্পর্ক ধরে রাখতে হচ্ছে। ফলে আমাদের ভালো-মন্দ যেমন আন্তর্জাতিক মহলের কাছে গুরুত্বপূর্ণ তেমনি তাদের ভালো-মন্দও আমাদের কূটনৈতিক বিবেচনায় রাখতে হয়। আর আন্তর্জাতিক মহলের ভালো-মন্দের বিষয়টির ক্ষেত্রে দ্বিপক্ষীয় আস্থা একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। এই আস্থা অর্জনের জন্য গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার প্রাণ অর্থাৎ নির্বাচনী ব্যবস্থাকে সর্বজনীন ও সর্বজনগ্রাহ্য করে তোলা জরুরি। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সরকার পরিচালিত হলে আন্তর্জাতিক মহলের আস্থা অর্জন করা যায় এবং দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কোন্নয়নের পথ সুগম হয়।

বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব বেড়েছে, এ নিয়ে মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন। আর ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব বাড়ছে বলে আমাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির বিষয়ে বিদেশিদের আগ্রহও বাড়ছে। এই আগ্রহের সঙ্গে তাদের স্বার্থও জড়িয়ে রয়েছে। রাজনৈতিক বিবৃতিতে নীতিগত অবস্থান স্পষ্ট করার জন্য সরকারের মন্ত্রীরা নানা মন্তব্য তুলে ধরছেন। কিন্তু মুখে যা-ই বলা হোক, নির্বাচনী প্রক্রিয়া সুষ্ঠু না হলে আন্তর্জাতিক মহলে আমাদের আস্থা ও ভাবমূর্তি নিম্নগামী হবে। বিষয়টি আমাদের স্বার্থের জন্য অনুকূল না-ও হতে পারে।

বিএনপির কয়েকজন নেতা ইতোমধ্যে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতি আমাদের ভাবমূর্তির ওপর বড় আঘাত এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও তা বড় প্রভাব ফেলবে। যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতির প্রয়োগ নিশ্চিতভাবেই একটি চাপ। এই প্রেক্ষাপটে সরকার ও বিরোধীদলীয় রাজনীতিকদের সচেতন ও সতর্ক থেকে রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনের কোনো বিকল্প নেই। এই একটি বিষয় আমাদের বহু ইতিবাচক অর্জনকে ম্লান করে দিয়েছে। বহির্বিশ্বে বাংলাদেশ সম্পর্কে বহু প্রশ্ন দেখা দিতে শুরু করেছে। মার্কিন ভিসানীতি আরোপের ঘটনাটি দেশেই নয় বহির্বিশ্বেও আলোচনার জন্ম দিয়েছে। কাজেই বিষয়টি আমাদের ভাবমূর্তির ওপর বড় আঘাত বটে। তবে সমস্যা জটিল হলেও এর সমাধান অত জটিল নয়। এই সমস্যার সমাধান আমাদের অভ্যন্তরীণভাবেই খুঁজতে হবে। সহিংসতা নয় রাজনৈতিক দল এবং অংশীজনদের আলোচনার মাধ্যমে একটি সর্বজনগ্রাহ্য এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনী কাঠামোর বিষয়ে ঐকমত্য গড়ে তুলতে হবে। মনে রাখতে হবে, আমাদের রাজনৈতিক অর্জন কম নয়। অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে আমাদের সংকট নিজেদেরই সমাধান করতে হবে। সহিংসতা কোনো দিন আমাদের সমাধান দেয়নি। বরং পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে করে তুলেছে।

জনগণের সত্যিকার অংশগ্রহণ ও সম্মতির ভিত্তিতে সরকার পরিচালনার নীতিমালা বাস্তবায়ন, জনগণের কাছে সরকারের দায়বদ্ধতা নিশ্চিতকরণ জরুরি। আবারও বলি, এ ক্ষেত্রে রাজনীতির অংশীদারদের সচেতন ও সতর্ক হওয়া জরুরি। স্বাধীনতার পর দীর্ঘ বায়ান্ন বছরের ইতিহাসে বহুবার রাজনৈতিক অঙ্গনে রাজনীতিকরা সৃজনশীলতা দেখিয়েছেন। এখন আবার সেই সৃজনশীলতা দেখানোর সময় এসেছে। সহিংসতা কিংবা দোষারোপের রাজনীতি নয়, গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে সৃজনশীলতার মাধ্যমে ইতিবাচক পরিবর্তন আনা জরুরি। সেই প্রেক্ষাপটে ভিসানীতিকে অবলম্বন করে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এই ইতিবাচক পরিবর্তন আনার একটি সম্ভাবনা ও সুযোগ আমাদের তৈরি হয়েছে। আমরা অতীতেও নিজেদের সমস্যার সমাধান নিজেরাই করেছি এবং এখনও সংকট সমাধানের দায় আমাদেরই নিতে হবে।


  • যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা